প্রতিবেদন
ধর্ষণ সংস্কৃতি ও ভারতীয় রাজনীতি
dddar

প্রযুক্তির কল্যাণে দৃশ্যটি এখন ‘ভাইরাল’। অভিযোগ, কংগ্রেসের এক নেত্রী উপনির্বাচনে ধর্ষণে অভিযুক্তকে টিকিট দেওয়ার  বিরোধিতা করেছিলেন। তার যুক্তি গ্রাহ্য না হওয়ায় তিনি নাকি ক্ষোভে দলীয় নেতার উদ্দেশে ফুলের তোড়া ছুঁড়ে মারেন এবং তাতে মূর্চ্ছা না গিয়ে উল্টে তেড়িয়া হয়ে কয়েকজন নেতা-কর্মী তাকে যথেচ্ছ কিল চড় লাথি ঘুঁষি মারেন। – নিঃসন্দেহে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নিন্দনীয়। এর জেরে দলটিকে তড়িঘড়ি সেই বীরপুঙ্গবদের (মহিলা নিগ্রহে অভিযুক্তদের) বহিষ্কার করে মুখরক্ষা করতে হয়।

ব্যাপারটা ঘটেছে উত্তর প্রদেশের দেওরিয়ায়। তাতে একটা বাড়তি মাত্রা যোগ হয়েছে। কারণ উত্তর প্রদেশ নারীনির্যাতনে শীর্ষে। কারণ উত্তর প্রদেশ মনুবাদের ঘোষিত চর্চাভূমি। অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মুখের হাসি চওড়া হয়েছে। বিশেষ করে শাসকদল বিজেপি’র। কেউ মুচকি-হাসিত। কিন্তু ব্যাপারটা ‘ঘুঁটে পোড়ে, গোবর হাসে’-র মতো! হ্যাঁ অত্যন্ত লজ্জা ও দুঃখের সঙ্গেই কথাটা বলতে হচ্ছে। ভারতীয় রাজনীতির আজ এমনই বাহুবলীগ্রস্ত বেহাল অবস্থা।

নিগৃহীতা নেত্রীর ক্ষোভ সঙ্গত। একজন ধর্ষণ- অভিযুক্তকে টিকিট দিতে হয় কেন? তিনি বাহুবল পেশীবল ধনবল লোকবলের অধিকারী বলে! হ্যাঁ এগুলো তাৎক্ষণিক ভাবে ভোটবৈতরণী পারে মোক্ষম অস্ত্র তো বটেই! বিশেষ করে দুর্বৃত্তকবলিত রাজনীতির চৌহদ্দিতে। নাকি, ‘ঠক বাছতে গাঁ  উজাড়’? সব সম্ভাব্য প্রার্থীই ধর্ষণ-অভিযুক্ত? হতেও পারে! ধর্ষণ সংস্কৃতি তো কোনো একটি দলের একচেটিয়া দখলদারিতে থাকতে পারে না। অনুকূল পরিস্থিতিতে তার সংক্রমণ ব্যাপকভাবেই ঘটছে, ঘটবে-দলের সীমানা পেরিয়ে। স্থানমাহাত্ম্যে তা স্বাভাবিক অনুমোদনও পেয়ে যাচ্ছে!

রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থতায় লুঠতরাজ হত্যা অগ্নিসংযোগের সঙ্গে ‘ধর্ষণ’ তো একটা অঘোষিত আবশ্যিক কর্মসূচী বাহুবলী রাজনীতির কাছে, রাষ্ট্রের কাছেও; দলীয় কর্মী তথা ভাড়াটে বাহিনীর দ্বারা, কখনও রাষ্ট্রীয় বাহিনী-পুলিশ মিলিটারির দ্বারা। যেমনটি আমরা দেখেছি বিহারে, বস্তারে, কাশ্মীরে, মণিপুরে, গুজরাটে। রাষ্ট্রের অনুমোদিত এবং অনুশীলিত এই ধর্ষণ-সংস্কৃতির ছায়া তো সমাজেও পড়ে। জাত-পাত ভিত্তিক লিঙ্গ-বৈষম্যের সমাজের নিজস্ব একটা পরম্পরা তো আছেই। তথাকথিত রাজনীতিক নেতা-কর্মীরা তো অন্তঃরীক্ষ-নিক্ষিপ্ত সুবর্ণ গোলক নন। জনবিরোধী কলুষিত রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের আবিলতার মধ্যে বেড়ে ওঠা জীবমাত্র। তাই ধর্ষণ সংস্কৃতিতে আক্রান্ত, সংক্রমিত হওয়াটা কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। হ্যাঁ, বামপন্থী রাজনীতিতে অবশ্যই সেটা অস্বাভাবিক, গর্হিত এবং বিরলদৃষ্ট। কারণ তারা জাত-পাত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের সমানাধিকারের সঙ্গে নারী-পুরুষের সমানাধিকারেও বিশ্বাসী। রাজনৈতিক অনুশীলনেও সাধারণভাবে তার সর্বজনগ্রাহ্য মান্যতা আছে। ভারতের জাতীয় বা আঞ্চলিক দলগুলির ক্ষেত্রে, দলের ইশতেহারে যা-ই থাক না কেন, একজন সম্ভাব্য জনপ্রতিনিধি বাছাইয়ের সময় এটা বিচার্য নয় যে তিনি কতটা পরিশ্রমী, সৎ, সত্যিই সধারণ মানুষের কতটা কাছের এবং কাজের মানুষ, যেটা সাধারণভাবে বামপন্থী রাজনীতির ক্ষেত্রে মূল এবং আবশ্যিক শর্ত। বরং এটাই দেখার যে তিনি কতটা পেশী আস্ফালনের মাধ্যমে যেন তেন প্রকারে দলের জন্য জয়কে ছিনিয়ে আনতে পারবেন। সেটাই হয়েছিল আর কি!

ভারতীয় রাজনীতিতে মহিলাদের অংশগ্রহণ নিয়ে একটু ভাবা যাক। সাধারণভাবে ভারতীয় সংসদে নির্বাচিত মহিলা সদস্যের অনুপাত গড়ে ১০%। বিগত লোকসভা নির্বাচনে একমাত্র আঞ্চলিক দল তৃণমূল কংগ্রেস (যদিও সেখানে তৃণমূল স্তর থেকে গড়ে পিটে উঠে আসা নেত্রীর থেকে টলিউড অভিনেত্রীদেরই ভীড় বেশি) এবং নবীন পট্টনায়কের বিজেডি ৩৫% এর উপরে মহিলা – মনোনয়ন দিয়েছিল। সেক্ষেত্রে জাতীয় দলগুলোর মনোনয়নের অনুপাত ছিল ১০-১২%। মহিলা সংরক্ষণ বিল রাজ্য সভায় পাস হলেও লোকসভায় তা পেশই হতে পারল না। অথচ এই অতিমারীর মধ্যেই দেখা গেল চরম অগণতান্ত্রিকভাবে কত জনবিরোধী বিল পাস হয়ে গেল! কারণ নিঃসংশয়ে, সমাজে রাজনীতিতে বহমান পিতৃতন্ত্র, পুরুষ আধিপত্য। পুরুষ-শাসিত রাজনীতি মহিলা-সংরক্ষণ আসলে চায়ই না। কিন্তু মতাদর্শগত ভাবে লিঙ্গ সাম্যে বিশ্বাসী হলেও বাম দলগুলোর অবস্থা এ ক্ষেত্রে করুণতর। কেন? মহিলা নেত্রীর অনুপাতও তুলনামূলকভাবে অনেক কম। কেন? তাহলে এখানেও সেই পুরুষ আধিপত্য? লিঙ্গ বৈষম্য?

এই পরিস্থিতিতে নিগৃহীতা কংগ্রেস নেত্রী তারা দেবী যাদব – অন্ধকারে এক রূপোলি আলোকরেখা। প্রবল বিরোধিতার মধ্যেও তিনি ধর্ষকের প্রার্থীপদের প্রতিবাদ করেছেন। এভাবে যদি সমস্ত দলের মধ্যেই নারীকণ্ঠ ধর্ষক বিরোধিতায় সরব হয় তাহলে দলগুলি কিছুটা হলেও নিজেদের সংশোধন করতে বাধ্য হবে। কিন্তু সেই জোরের জায়গাটা নারীকে অর্জন করতে হবে।

নারীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ক্ষমতায়ন ছাড়া সেই ‘জোর’ সম্ভব নয়। লিঙ্গসাম্যও অসম্ভব। পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে  লড়াইয়ে তাই নারীদের দল মত শ্রেণী বর্ণ সম্প্রদায় নির্বিশেষে একজোট হওয়া আজ অত্যন্ত জরুরি। আন্দোলনে পথে নামাটা অত্যন্ত জরুরি। যেমনটি দেখিয়েছে শাহিনবাগ!

– জয়ন্তী দাশগুপ্ত      

খণ্ড-27
সংখ্যা-37