প্রতিবেদন
বিতর্ক তবু পিছু ছাড়ে না
bit

সম্প্রতি (১৭ অক্টোবর) ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) প্রবাসে গঠিত (তাসখন্দে) ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ১০০তম প্রতিষ্ঠা দিবস পালনের দিনে পার্টির রাজ্য কমিটির সংক্ষিপ্ত বৈঠকও সেরে নিয়েছে। কাকতালীয়ভাবে দিনটি বহু বিতর্কের সঙ্গে যুক্ত। তাসখন্দে গঠিত পার্টির প্রতিষ্ঠাকে প্রতিষ্ঠা দিবস হিসেবে স্বীকার করা কতটা যুক্তিযুক্ত তা নিয়েও বিতর্ক আছে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (অবিভক্ত) কেন্দ্রীয় সম্পাদকমন্ডলী ১৯৫৯ সালের ১৯ আগস্ট বহু আলোচনার পর ১৯২৫ সালের ২৬ ডিসেম্বর কানপুর সম্মেলনের দিনটিকেই প্রতিষ্ঠা দিবস হিসেবে প্রস্তাব গ্রহণ করেছিল। এই প্রস্তাবের বিপক্ষে কেউ মতপ্রকাশ করেছিল বলে জানা নেই। এমনকি কানপুর সম্মেলনে উপস্থিত কোনো প্রতিনিধিও তাসখন্দ পার্টির প্রসঙ্গ তোলেননি। অন্তত মিনিটসএ তার কোনো উল্লেখ নেই। ফলে কেউ ১৯২৫ সালের পরিবর্তে ১৯২০ সালকে প্রতিষ্ঠা বছর হিসাবে গ্রহণ করতেই পারেন, কিন্তু বিতর্ক পিছু ছাড়বে না। তবে এই সংক্ষিপ্ত ধারাভাষ্য এই প্রসঙ্গে নয়। তা অন্যসময় করা যাবে।

সিপিআই(এম)-এর রাজ্য কমিটির সংক্ষিপ্ত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এই বৈঠকের যে নির্যাস সংবাদ মাধ্যমে এসেছে, তা বাম মহলে যথেষ্ট বিতর্কের জন্ম দিতে বাধ্য। ১৮ অক্টোবরের প্রভাতী আনন্দবাজার রাজ্য নেতৃত্বকে উদ্ধৃত করে জানাচ্ছে, “বিজেপি না তৃণমূল-কে বড় শত্রু, এই বিতর্কে কালক্ষেপও নিস্প্রয়োজন” (বিতর্ক নয়, আসনের তালিকা চান সূর্যেরা)। কমিউনিস্ট আন্দোলনে কে বড় শত্রু বা প্রধান শত্রু কে তা নিয়ে বিতর্ক কবে থেকে অপ্রয়োজনীয় হয়ে গেল? সময় লাগলেও এই প্রধান শত্রু চিহ্নিত করার উপরই তো পরবর্তী কর্মকৌশল ও পদক্ষেপগুলি নির্ভর করে থাকে। এই যে মার্কসবাদী নেতৃবৃন্দ লাগাতার বলেন, নির্দিষ্ট অবস্থার নির্দিষ্ট বিশ্লেষণ (concrete analysis of the concrete situation) করতে হবে, তার কি হবে? একটি নির্দিষ্ট অবস্থায় একাধিক বড়/প্রধান শত্রু থাকে? বিতর্ক কি এতে বন্ধ ‌করা যাবে? যেহেতু আবাপ পার্টি মুখপত্র নয়, মার্কসবাদী পত্রিকাও নয়, তাই প্রকৃত সংবাদের খোঁজে গণশক্তির শরণাপন্ন হতে হলো। ১৮ অক্টোবরের গণশক্তি লিখছে, “রাজ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সিপিএমের স্পষ্ট অবস্থান তৃণমূল হটাও, বিজেপি-কে ঠেকাও। তার জন্য বিকল্প সরকার চাই”। এই উদ্ধৃতিটুকু সিপিএম কাকে বড়/প্রধান শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করছে, তা বুঝতে কারো অসুবিধা হবার কথা নয়। কর্মপন্থাও সেই অনুযায়ী ঠিক করে ফেলেছে। “জনগণের সামনে বিকল্প কর্মসূচি হাজির করে বাম গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ বিকল্প গড়ে তোলা হবে”। আরও একটা ছোট তথ্যও জানানো হয়েছে। সূর্য মিশ্র জানাচ্ছেন, “বামফ্রন্টের বাইরের কিছু বাম দল, যাদের সঙ্গে আন্দোলনের ঐক্য গড়ে উঠেছে তাদেরও কিছু আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেওয়া হবে” (ভাষার ঔদ্ধত্য ক্ষমা করে নেবেন)। তাহলে দাঁড়ালো কী? আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে প্রধান শত্রু তৃণমূল কংগ্রেসকে পরাস্ত করে বিকল্প সরকার গঠন করা। এবং তার জন্য কংগ্রেস ও বাম সহযোগী দলগুলির একটি বিকল্প কর্মসূচির ভিত্তিতে জনগণকে বিকল্প সরকার উপহার।

আজকাল সিপিএম নেতৃত্ব বহুদলীয় বৈঠকে বা ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় ২০১৬ সালে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করতে গিয়ে যে বিরাট ভুল হয়েছে, তা স্বীকার করছেন। এবার যেন তা না হয়, তার জন্য সতর্ক বার্তা জারি করেছেন। “পাঁচ বছর আগের বিধানসভা ভোটের মতো এবার আর কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতা ঘিরে ‘বিভ্রান্তি ও বিতর্কের’ পুনরাবৃত্তি চায় না সিপিএম। আসন ভাগাভাগি যেভাবে হবে নির্দিষ্টভাবে ‌সেই সমঝোতাই মেনে চলার স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হল রাজ্য কমিটির বৈঠকে”।

এবার একটু ধীরে ধীরে এগুনো যাক। যতদূর জানা আছে, এখনও ফ্রন্টের বাইরের কোনো দলের সঙ্গে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের কর্মনীতি কর্মকৌশল নিয়ে সিপিএমের কোনো বিস্তারিত কথাবার্তা হয়নি। এমনকি তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী কংগ্রেসের সঙ্গেও কোন কথা হয়নি। সে যাই হোক, দিন কয়েক আগে ১৬ দলের বৈঠকের যে সংবাদ পেয়েছি, সেখানে রাজ্যে কার বিরুদ্ধে প্রচারের বর্শামুখ থাকবে তা নিয়ে যথেষ্ট জোরালো বিতর্ক হয়। নির্বাচনী লড়াই হোক আর দৈনন্দিন রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক লড়াই হোক গোটা দেশ যেখানে ফ্যাসিস্ট বিজেপি এবং আরএসএস ও তার শাখা প্রশাখার বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াই চালাচ্ছে, সেখানে তাকে প্রতিহত করা, প্রতিরোধ করা, পরাস্ত করা এই নির্দিষ্ট সময়ে এরাজ্যে প্রধান কাজ হবে না কেন? একটি ফ্যাসিস্ট, সাম্প্রদায়িক, দেশবিরোধী, কর্পোরেট দালাল দল এবং একটি আঞ্চলিক ক্ষমতাসীন দুর্নীতিগ্রস্ত, স্বৈরাচারী এবং স্বেচ্ছাচারী দলকে একাসনে বসানো হবে কোন যুক্তিতে? একটি বিকল্প কর্মসূচীর ভিত্তিতে আসন সমঝোতা হবে, সেটাই বা ঠিক হলো কোথায়? যতদূর খবর পাওয়া গেছে, কংগ্রেস বলে বেড়াচ্ছে ৬০:৪০ ভিত্তিতে আসন বোঝাপড়া করা যেতে পারে। ২০১৬-র পর ২০১৯ লোকসভা নির্বাচন গেছে। শুনেছি, ১৬ দলের বৈঠকে কোনো কোনো সংগঠন প্রশ্ন তুলেছে, লোকসভা নির্বাচনে বামফ্রন্টের প্রায় ২২-২৩ শতাংশ ভোট বিজেপির দিকে চলে গেছে কোন রাজনৈতিক কারণে? তা কি তৃণমূল কংগ্রেসকে উচিত শিক্ষা দেবার জন্য? এ ব্যাপারে সিপিএম নেতৃত্বের ব্যাখ্যা কী? ২০১৬ সালের ভুল নিয়ে কথা বার্তা হচ্ছে, ভালো। কিন্তু ২০১৯ থেকে কি কোনো শিক্ষা নেবার নেই? একটা নীতিনিষ্ঠ বাম গণতান্ত্রিক বিকল্প পশ্চিমবঙ্গে গড়ে উঠুক এটা সময়ের দাবি, শ্রমজীবী, মধ্যবিত্ত, বামপন্থী গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, দেশপ্রেমিক মানুষের দাবি।

একটা কথা সিপিএম নেতারা হামেশা প্রচার করেন, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির উত্থান হচ্ছে তৃণমূলের জন্য। কথাটা একদম মিথ্যা মোটেই তা নয়। কিন্তু একই কথা কি ত্রিপুরার সিপিএমের জন্যও সত্য? আর একটু বড় পরিধিতে দেখলে দেশজুড়ে বিজেপির উত্থানের জন্য কি জাতীয় কংগ্রেসের নীতি পদক্ষেপ অপশাসন ইত্যাদি দায়ী নয়? সে কথাই তো জর্জ ডিমিট্রভ বলেছেন, পূর্বতন সরকারগুলির সমস্ত জনবিরোধী নীতি ও পদক্ষেপকে যু্ক্তি হিসাবে কাজে লাগায় ফ্যাসিবাদ। কেউ কেউ বলেন, পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের উত্থানের জন্য দায়ী সিপিএম ও বামফ্রন্ট সরকার। ওরা যদি সিঙ্গুর নন্দীগ্রামে জোর করে কৃষকের জমি দখল করতে না যেত, তাহলে তৃণমূল কংগ্রেস এত সহজে রাজ্যে ক্ষমতায় আসতো কিনা সন্দেহ আছে। আসলে এইভাবে দেখার মধ্যে সরলীকরণের একটা বিপদ থেকে যেতে পারে। একটা ফ্যাসিস্ট শক্তি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বহুবিধ কারণকে কাজে লাগিয়ে তার উত্থানের জমি তৈরি করে। শোনা যায়, ১৬ দলের সর্বশেষ বৈঠকে এসব নিয়েও মত বিনিময় ও কথাবার্তা হয়েছে। এমনকি এ প্রশ্নও উঠেছে যে জাতীয় স্তরের বিভিন্ন বৈঠকে সোনিয়া গান্ধী ও মমতা ব্যানার্জিকে পালা করে সভার কাজ পরিচালনা করতে দেখা গেছে। এর কী ব্যাখ্যা আছে? সিপিএম ও বামফ্রন্টের দলগুলি কি এই উদ্যোগের বিরোধী? কোন গ্রহণযোগ্য উত্তর এখনো মেলেনি। এই কথাগুলো বলার অর্থ মোটেও এটা নয় যে এ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের সাথে নির্বাচনী আসন সমঝোতা করতে হবে। যদিও ১৬ দলের মধ্যেকার একটি সংগঠন তৃণমূলের সঙ্গে আসন সমঝোতার জন্য প্রেস বিবৃতি জারি করেছে! আবার এসইউসিআই(সি) এখনো তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেনি। কিন্তু ইতিমধ্যেই দেখা গেল গত নির্বাচনের প্রাক্কালে হঠাৎ তৃণমূল থেকে দলবদল করে আসা বসিরহাটের সিপিএমের নির্বাচিত বিধায়ক আবার দলবদল করে পূর্বতন দল তৃণমূল কংগ্রেসে ফিরে গেছে! ক্ষমতা দখলের জন্য মরীয়া বিজেপিও নির্বাচনের আগে এমনকি নির্বাচনের পরেও দল ভাঙানো, বিধায়ক কেনাবেচার নোংরা রাজনীতিকে এরাজ্যে আরো গতি দেবে। সেই আবহাওয়া ও পরিবেশ গড়ে তুলতেই রাজ্যপালকে নিয়মিত রাজনৈতিক আসরে নামানো, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নাড্ডার রাষ্ট্রপতি শাসন জারির হুমকি শোনা যাচ্ছে।

এরাজ্যে বিজেপির আরও ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠা বা ক্ষমতা দখল নিছক আর একটা রাজ্য সরকারে আসা নয়। বাম গণতান্ত্রিক লড়াই সংগ্রামের যে দীর্ঘ ঐতিহ্য এরাজ্যে গড়ে উঠেছে, তাকে এক লহমায় মুছে দিয়ে বাংলা বিভাজনের দুঃখজনক স্মৃতিকে আবার জাগিয়ে তুলবে। ফ্যাসিস্ট রাজনীতির এক পাকাপোক্ত পরীক্ষাগার হয়ে উঠবে এই বাংলা। সিএএ, এনপিআর, এনআরসি’র কথাবার্তা তাই আবার হাওয়ায় ভাসছে। বিভাজনের রাজনীতিও তার সমস্ত শাখা প্রশাখা বিস্তার করতে শুরু করেছে। সাম্প্রতিক কালে এরাজ্যে এনআইএ’র অতি তৎপরতা ঐ বিভাজনের রাজনীতিকে রাষ্ট্রীয় সিলমোহর দেবার সঙ্গে জড়িত।

এরকম এক সঙ্কট মুহুর্তে বামপন্থীরা নিজেদের মধ্যে আরও মতামত আদান প্রদান করুক, প্রয়োজনে তীব্র বিতর্ক হোক। বামপন্থার স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে, সর্বোপরি ফ্যাসিস্ট অগ্রগতি প্রতিরোধে, স্বৈরাচারের হাত থেকে বাংলার গণতন্ত্র, জনগণের জীবন জীবিকা ও অধিকার রক্ষার স্বার্থে। কঠিন কাজ, কোনো চটজলদি উত্তর নেই। পাশের রাজ্য বিহারের শ্রমজীবী জনগণ ও বামপন্থী শক্তি এক মহাজোটে সামিল হয়ে এই লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বাংলাকে আবার পথ দেখাতে হবে। শুধু বাংলার নয়, দেশের শ্রমজীবী জনগণ এই দিকে তাকিয়ে আছেন। বিতর্ক চলুক, লড়াই সংগ্রামের ঢেউ ওঠুক। ১৬ দলের নেতৃবৃন্দ নিশ্চয়ই এসব নিয়ে ভাবছেন। নিছক আসনের বাটোয়ারা নয়, রাজনীতির দৃঢ় বন্ধন গড়ে উঠুক পর্যবেক্ষক সেদিকেই তাকিয়ে থাকবে।

- পর্যবেক্ষক    

খণ্ড-27
সংখ্যা-38