সম্পাদকীয়
চাই প্রকৃত বাম প্রতিস্পর্ধা
ed

পশ্চিমবঙ্গে ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে পয়লা নম্বর প্রতিপক্ষ নির্ণয় করা নিয়ে বামপন্থার বৃহত্তর মহলে মতপার্থক্য থেকেই যাচ্ছে। কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থবাহী এবং আরএসএস মদতপুষ্ট হিন্দুরাষ্ট্রবাদী সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী বিজেপি-ই যে সন্দেহাতীতভাবে প্রধানতম প্রতিপক্ষ এবং মোকাবিলার রণকৌশলগত অবস্থান যে অনুরূপ সঙ্গত হতে হবে — এই সারসত্যটা বাম-কংগ্রেস জোট প্রয়াসী বাম নেতৃত্ব বুঝে উঠতে হিমশিম খাচ্ছেন। এই ভাবধারার ধরনটা কেবল 'জাতীয় ক্ষেত্রে বিজেপি আর রাজ্যের ক্ষেত্রে তৃণমূল শাসক প্রধান বিপদ', 'তাই লোকসভা নির্বাচন ছিল আলাদা, পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন হবে আলাদা চরিত্রের'! অন্যদিকে আবার সেই একই 'মোদী-দিদি এক হ্যায়' মার্কা যুক্তিহীন হাস্যকর শ্লোগান চলছে! মোদী সরকারের বিরুদ্ধে ঘোষিত সদ্য সংগঠিত ধর্মঘটেও এই নিনাদ চলল! এই ধরনের চূড়ান্ত অবাস্তব কান্ডজ্ঞানহীন সূত্রায়ন কোন 'বাম' চিন্তার পরিচয়? জনতাকে যুক্তি-তর্কে কোন চেতনায় শিক্ষিত করবে? এসব নিয়ে একবারও পুনর্বিবেচনার কোনও সদিচ্ছা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। তৃণমূল এককালে এনডিএ-তে ছিল, প্রায় দু'দশক আগে, সেই জের টেনে এখনও 'এক হ্যায়' আওয়াজ দিয়ে যাওয়ার কোনও মানে হয় না।

দ্বিতীয়ত, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি'র জমি পাওয়ার জন্য শাসক তৃণমূলের অত্যাচার, দুর্নীতি, রাজনৈতিক সন্ত্রাস অবশ্যই পরোক্ষভাবে দায়ি, এর ফলে বহু মানুষ বিজেপি'র হাতছানিতে বিপথে প্রভাবিত হয়েছে। কিন্তু এই ব্যর্থতার দায় তো সেই বাম দলেরও নিতে হবে যাদের ভোট ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে চুপিসারে 'এবার রাম পরের বার বাম' মার্কা আত্মঘাতী কৌশলে বিজেপিতে চলে গিয়েছিল। ভরসার এমন দশা কেন হয়েছিল? ভাবা প্র্যাকটিশ করা দরকার। অতীতের ভুল থেকে অকপটভাবে শিক্ষা না নিয়ে কোনও নতুন যাত্রাপথ উন্মুক্ত করা যায় না। যে ভোট তৃণমূল থেকে বিজেপিতে গেছে বা যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে তা ফেরাতে তৃণমূল মরীয়া হচ্ছে। তাহলে যে ভোট বাম দল থেকে বিজেপিতে চলে গেছে, এখনও চোরাস্রোতের মতো যাচ্ছে, তা ফেরানো-ঠেকানোয় বাম দলগুলো চ্যালেঞ্জ নিয়ে উঠে দাঁড়াবে না কেন? এমনকি একদা বাম-ছুট তৃণমূলে যাওয়া, তারপরে তৃণমূল-ছুট বিজেপিতে যাওয়া সব ভোট আবার বাম শিবিরেই ফেরানোয় কেন ঝাঁপানো হবে না! এটাই তো আজকের নির্দিষ্ট অবস্থায় সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক লক্ষ্য হওয়া উচিত। আর এই লক্ষ্যে বিজেপিকেই মূল নিশানা করা দরকার। তৃণমূলকে মূল লক্ষ্য বানিয়ে তা করা সম্ভব নয়। অথবা বিজেপিকে ঠেকানোর জন্য তৃণমূলকে হটানো আর সেই জায়গায় বাম-জোটের ক্ষমতায় আসার ভাববাচ্যের মধ্যে আদৌ কোনও বাস্তব বিবেচনা বোধ নেই। ওসব জগাখিচুড়ি আকাশকুসুম হয়েই থাকবে, আরও অবক্ষয়-ক্ষয় ডেকে আনবে। তাই বাম বর্শামুখ তাক করা দরকার বিজেপির দিকেই। মতাদর্শ-রাজনীতি-মূল লড়াই-দাবিসনদ তৈরি, প্রধান শ্লোগান সবই স্থির করতে হবে সেভাবেই। এই বামপন্থী কলাকৌশলগত অবস্থানের মধ্যে বিজেপির সাথে তৃণমূলের যা ফারাক টানার এবং একইসাথে তৃণমূলের সঙ্গে বামেদের যা টক্কর দেওয়ার, সব সম্ভব। এর মধ্যে অযথা তৃণমূলের সঙ্গে 'জোট তৈরির ভূত দেখিয়ে' লাভ নেই। এরকম 'ভূত আবিষ্কারে'র বিশেষজ্ঞের তালিকায় দেখা যাচ্ছে আবার কোনও 'নকশালপন্থী' আত্মপরিচিতি দেওয়া বন্ধুও নাম তুলছেন! অদ্ভূত সব উপসংহার টানা হচ্ছে! একদিকে মানছেন বিজেপি চলে এলে আসবে ভয়ঙ্কর বিপদ, আবার দাবি করছেন বিজেপিকে ঠেকাতে তৃণমূলের মোকাবিলা হতে হবে 'পূর্বশর্ত'! কিন্তু বিজেপিকে আজকের পশ্চিমবাংলার পরিস্থিতিতে শাসক তৃণমূলের বিপরীতে নিছক প্রতিদ্বন্দ্বী বিরোধী দলের বর্গে ফেলে রাখাটা হবে বাস্তবের বহু বহু পিছনে পড়ে থাকা। এই ভাবনাকে নির্বুদ্ধিতা আখ্যা দিলে অত্যুক্তি হয় না। মতাদর্শ ও রাজনৈতিক দর্শনের নিরীখে বিজেপিকে প্রধান প্রতিপক্ষ নির্ধারণ না করে পারা যায় না, তার ওপর কেন্দ্রে এবং রাজ্যে রাজ্যে ক্ষমতা দখলের দৌলতে বিজেপি রাষ্ট্রক্ষমতায় অনেকটাই আধিপত্যের জায়গায় চলে গেছে। বাংলায় তার এবারের আগ্রাসন ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে।আর একবার এখানে ক্ষমতায় তাদের চলে আসা মানে কয়েক দশকের বাম গড়ের জায়গায় রাম গড়ের গোড়াপত্তন হয়ে যাওয়া, সেটা হলে তার উপর্যুপরি বিপর্যয়কারী প্রভাব শুধু বাংলায় সীমিত থাকবে না, সারা দেশেই পড়বে। তাই তা হতে না দিতে বিজেপিকে লক্ষ্যবস্তু করতে হবে। বিহারে বাম শক্তি যা চ্যালেঞ্জ নিয়ে করে উৎসাহের সঞ্চার করেছে, বাংলায় সেই প্রতিস্পর্ধাকেই ঊর্দ্ধে তুলে ধরা উচিত।

খণ্ড-27
সংখ্যা-43