সম্পাদকীয়
প্রধান প্রতিপক্ষ বিজেপির ছল-বল-কৌশল
mai

বিজেপি যে বাংলা দখলে কত বেপরোয়া তার পরিচয়গুলো ইতিমধ্যেই দিতে শুরু করেছে। বিহার নির্বাচনের আগে থাকতেই শুরু তার বিশেষ ঝাঁকি দেওয়া। বাংলায় শারোদৎসবের মধ্যে মোদী শুনিয়েছিলেন এক ভার্চুয়াল বার্তা। তাতে বাংলার মনীষী ও পুরোধাদের বহুজনার স্মৃতিচারণ উঠে আসে, যার মধ্যে ধরা পড়ে সুপরিকল্পিত উদ্দেশ্যটি। তা হল উল্লেখিত সবারই প্রভাবিত জনতার ভোট বিজেপির প্রভাবে নিয়ে আসার জন্য উঠেপড়ে লাগা। সেই স্মরণ তালিকায় কার নাম নেই! মনুবাদী থেকে মনুবিরোধী অনেককেই রাখা হয়েছে। শ্রীরামকৃষ্ণ, স্বামী বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাবা লোকনাথ, অনুকূলচন্দ্র, পঞ্চানন বর্মা, হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ ঠাকুর, নজরুল ইসলাম, সত্যজিৎ রায়, উত্তমকুমার...। হিন্দুমহাসভা ও জনসঙ্ঘের পুরোধা শ্যামাপ্রসাদ ‘মধ্যমনি’! মোদী আক্ষেপ শুনিয়েছেন সময়াভাবে সবার নাম উল্লেখ করতে পারেননি। তবে সুযোগ পেলেই তাঁরা যে ‘বন্দনায়’ মুখিয়ে সেটা তাঁরা বুঝিয়ে দিচ্ছেন, তা সেই ব্যক্তিত্ব চিন্তাভাবনায় বিজেপির প্রবল বিরুদ্ধবাদী বা তাঁদের বিজেপির সঙ্গে আদৌ কোনও মিলজুল নেই বুঝেও। যেমন, প্রহসনের ঘটনা হল, দক্ষিণবঙ্গে আদিবাসী বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজের ফটোশুট ফেরতা পথে শিকাররত আদিবাসীর মূর্তিদেখে ফুলমালা দিলেন অমিত শাহ — বিজেপি রটিয়ে দিল ‘শ্রদ্ধা নিবেদন’ করলেন ‘বীরসা মুন্ডা’র মূর্তিতে। এতে প্রচন্ড ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আদিবাসী সমাজ ও তাদের সংগঠন। তারপরে অতুলনীয় আইকন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াণে দেখতে হল মোদী-অমিত শাহ’দের ‘শ্রদ্ধাঞ্জলি’ প্রদর্শন! যে প্রয়াত ব্যক্তিত্বের গোটা সৃষ্টিশীল জীবন-ইতিহাস নিবেদিত ছিল বামপন্থা, প্রগাঢ় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, বহুত্ব ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি; রাষ্ট্রীয় দমন-দলতন্ত্র-সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদ ও পুঁজির দৌরাত্মের বিরুদ্ধে। তিনি সোচ্চার ছিলেন মব লিঞ্চিং-লাভ জেহাদের বিরুদ্ধে; সিএএ-এনপিআর-এনআরসি’র বিরুদ্ধে। তাঁর নাগরিক জীবনে লেখনীর স্বাক্ষর রেখে গেছেন সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক বর্বরতার বিরুদ্ধে। মোদী- শাহজী’রা এসব খবর রাখেন না তা নয়, তবু সামনে যে ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনের ভোট, তা টানার স্বার্থেই নির্লজ্জের মতো যতসব ভন্ডামী ভরা ‘শোক-শ্রদ্ধা’র প্রদর্শন।

নির্বাচনকে ‘পাখির চোখ’ করতে বিজেপি এক মুহূর্ত থামাথামিতে নেই। দলের নয়া সর্বভারতীয় সভাপতি নড্ডা তো বটেই, খোদ তস্য মাথা-যুগল প্রধানমন্ত্রী-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যাতায়াত বাড়িয়ে দিয়েছেন, আরও বাড়াবেন।

তাছাড়া, এখন থেকেই এসে ঘাঁটি গাড়ছেন দলের কেন্দ্রীয় কমান্ড থেকে পাঠানো একগুচ্ছ ‘ভোটকুশলী’ পালোয়ান নেতা। এদের নিয়োগ করা হচ্ছে কয়েকটা বড় অঞ্চল ভিত্তিতে। একইসঙ্গে আমদানি হয়েছেন বিজেপির ‘আই টি সেল’-এর ‘সবসেরা’ মাথা মালব্য, মোদী-শাহ জোড়া ফলার পেয়ারের চাঁই, যিনি নাকি ডিজিটালি কৃত্রিম কলকাঠিতে ‘সাদাকে কালো কালোকে সাদা’ করে তুলতে সিদ্ধহস্ত! যার টিম দলকে অনবরত প্রচারের মালমশলা সরবরাহ করবে। চাঁদমারি ছকে দেওয়া হয়েছে পঁচাত্তর হাজারের বেশি বুথকে। এই বিনিয়োগ নেহাতই লোক দেখানো নয়, নিছক দলের রাজ্য ও জেলা নেতৃত্বের নানা খাস স্বার্থ জড়িত গোষ্ঠী সংঘাতের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ন্ত্রণ করতে শুধুমাত্র নয়। এরা কেউ ‘ত্রিপুরা’, কেউ ‘হরিয়ানা’, কেউ ‘উত্তরপ্রদেশ’, ‘মধ্যপ্রদেশ’, ‘উত্তরাখন্ড’ প্রমুখ দখলে ওস্তাদির পরিচয় দিয়েছে। তাই এদের ঠিকানা এখন বাংলা। সদর্থক কোনো ইস্যু ভিত্তিক সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রচার বিজেপির পক্ষে সম্ভব নয়। সর্বার্থেই সেই বিষয়ও নেই, মুখও নেই। তার বদলে বিদ্বেষ-বিভাজনের রাজনীতি ছড়িয়ে একদিকে হিন্দুভোটকে সংহত করা, অন্যদিকে এরাজ্যে সংখ্যালঘু ভোট যেহেতু শতাংশের বিচারে ও নির্বাচনী ফলাফল নির্ধারণে বিরাট গুরুত্বপূর্ণ, তাই সংখ্যালঘু জনতাকে সন্ত্রস্ত করা থেকে শুরু করে সাপ-লুডো খেলার সামগ্রীতে পরিণত করাই বিজেপি’র বিশেষ লক্ষ্য। আর লক্ষ্য হাসিল করতেই কাজ করাতে আমদানি করা হয়েছে ঐসব ঝানুদের।

বিজেপি ‘মাস্টার স্ট্রোক’ দিতে চাইছে আই টি সেল-এর মাথাকে নিয়ে এসে বসিয়ে। বিজেপি’র ‘আই টি সেল’ যে ভূয়ো তথ্য সম্প্রচারের হাতিয়ার তা যেমন বাইরে থেকেও ধরা যায়, তেমনি তার তথ্যপ্রমাণ ফাঁস হয়ে গেছে তাদের নিয়োগের জায়গা থেকেও। মূল পরিচালকের জায়গায় নিয়োজিত বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিটি বহু আগেই সংস্রব ছেড়ে চলে যান। সেই জায়গায় বিরাজমান মালব্য খোরাক যোগাচ্ছেন ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনের সময় থেকে। ‘কারসাজির অবদান’ রেখে আসছেন দুটি লোকসভা নির্বাচন সহ বেশ কয়েকটি বিধানসভা নির্বাচনে। বিজেপি এবার তাঁকে কাজে লাগাতে চায় বাংলায়। তার এই সব মিলে বাংলার নির্বাচনে রণনীতি-রণকৌশল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার বিপদকে খাটো করে দেখা কোনোমতেই উচিত নয়। বিপদের এই ভয়ঙ্কর ধারাটা যথাযথ বুঝে নিতে পারলে তাকে প্রধান প্রতিপক্ষ হিসাবে নির্দিষ্ট করা সহজ হয়, একে কার্যকরীভাবে মোকাবিলার দুর্জয় সাহস আর দূরন্ত নীতি ও কৌশলগত প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব আয়ত্ত্ব করাও সম্ভব; সম্ভব বাম ও গণতান্ত্রিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা, আর বাংলার মাটিতে বিজেপিকে পর্যূদস্ত করার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে প্রয়াসী হওয়া।

খণ্ড-27
সংখ্যা-41