মোদীর মসনদ কাঁপিয়ে দিল্লীর বুকে কৃষকদের মহাজাগরণ
mmm

প্রধানমন্ত্রী মোদী বিরোধীশূন্য শাসনের পক্ষপাতী। তিনি সর্বশক্তিমান এবং সারা দেশকে একটি শিকলে বেঁধে ফেলার জন্য যাবতীয় হাতিয়ারকে তিনি জড়ো করেছেন। তাঁর আয়োজনে বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবার প্রবলভাবেই সক্রিয়। কিন্তু আপাত শান্ত, দেশের অগণিত অন্নদাতা কৃষকদের অস্তিত্ব ও অধিকারের ওপর জোর খাটাতে গিয়ে মোদীজির সমস্ত ফ্যাসিবাদী প্রকল্প জনরোষে ঝলসে উঠেছে। মোদী জমানায় কৃষকদের প্রতি উপর্যুপরি প্রতারণা ও শঠতার ফলে তলে তলে যে ক্ষোভের আগ্নেয়গিরি সৃষ্টি হচ্ছিল, কোম্পানিরাজ কায়েমের তিন কৃষি আইন তার জ্বালামুখকেই উন্মুক্ত করে দিয়েছে।

সত্যিই আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত

২৪ নভেম্বর রাত থেকেই পাঞ্জাব, রাজস্থান, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশের মিরাট, আগ্রা প্রভৃতি স্থান থেকে হাজার হাজার কৃষক রাজধানী দিল্লীর দিকে রওনা দিয়েছেন। দলে দলে নারী, পুরুষ হাঁটছেন। আবার ট্রাক, ট্রাক্টর, টেম্পো ইত্যাদিতে চেপেও আসছেন বিক্ষুব্ধ কৃষকেরা। তাঁদের দাবি – ন্যায্য দামে সরকারের উদ্যোগে ফসল কেনার ব্যবস্থাকে লোপাট করা চলবে না। কোম্পানিরাজ কায়েমের লক্ষ্যে তৈরি নতুন তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহার করতে হবে। চুক্তি চাষের নামে কৃষকদের দেশী-বিদেশী কর্পোরেটদের ক্রীতদাসে পরিণত করা চলবেনা। চাল, গম, ভোজ্য তেল, তৈলবীজ, আলু, পেঁয়াজ ইত্যাদি কৃষিপণ্যকে ‘অত্যাবশ্যকীয়’ তালিকা থেকে বাদ দেওয়া চলবেনা। সর্বনাশা বিদ্যুৎ বিল ২০২০ বাতিল করতে হবে। হাড় হিম করা ঠান্ডা, রাতের শিশির ইত্যাদি শত কষ্ট সত্বেও মুখে হাসি নিয়ে কৃষকরা দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছেন দিল্লী অভিমুখে। তবে কি মোদীর দুর্গ ভেঙ্গে পড়বে! প্রবল প্রতাপ রাষ্ট্রশক্তি অবাধ্য কৃষকদের ‘আবদার’ কি সহজে মেনে নেবে? কখনোই না। রাজধানীর পথে পথে সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী। বিশাল বিশাল ব্যারিকেড খাড়া করে, জলকামান ও কাঁদানে গ্যাস নিয়ে তৈরি আছে উর্দিধারীরা। দিল্লী প্রবেশের মুখে সমস্ত রাজপথে হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশে মোদীর স্তাবক দুষ্মন্ত চৌতালা ও যোগী আদিত্যনাথের পুলিশ লাঠি চালিয়ে মাথা ফাটিয়ে দিচ্ছে নিরস্ত্র কৃষকদের। কুছ পরোয়া নেই। রক্তাক্ত হলেও দিল্লী অভিযান থামবেনা। দিল্লী-হরিয়ানা জাতীয় সড়কে সিঙ্ঘু বর্ডারে পুলিশী ব্যারিকেড নদীর জলে ফেলে দিলেন কৃষকেরা।  আম্বালা, ভিওয়ানি, কার্নাল, বাহাদুরগড়, ঝাজ্জর, শোনপত সর্বত্রই কংক্রিট আর লোহার খাঁচা রুখতে পারছেনা কৃষক মিছিলের ঢলকে। শীতের সন্ধ্যায় জলে ভিজে চুবচুব, তবু কৃষকের দল অদম্য।

নবদীপ সিং, গুরমিত লহরাঃ শৌর্য্য ও আত্মত্যাগের নয়া ইতিহাস লেখা হল

হরিয়ানার আম্বালা। দিল্লী অভিমুখী সারে সারে ট্রাক, ট্রাক্টর দাঁড়িয়ে পড়েছে। জলকামান থেকে প্রবল জলের ধারায় ভিজে যাচ্ছে কৃষকদের শরীর। এই জলের তোড় ভেদ করে গাড়িগুলোর এগিয়ে চলা অসম্ভব। দিশাহারা কৃষকেরা। তাহলে কি ছত্রভঙ্গ হয়ে যাবেন তাঁরা? কী আশ্চর্য্য! সকলকে অবাক করে একটি ট্রাকের ওপর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল এক যুবক, এ্যাক্কেবারে জলকামানের নলের মাথায়। সে প্রাণপণ শক্তিতে চেপে ধরল কামানের নল। রুদ্ধ হয়ে গেল জলের ধারা। জলকামান অচল হয়ে যেতেই হু হু করে কৃষক বোঝাই ট্রাক ও ট্রাক্টরগুলি এগিয়ে গেল সামনের দিকে। এই অসমসাহসী কৃষক যুবকের নাম নবদীপ সিং। সারা দেশ মুগ্ধ বিষ্ময়ে তারিফ করছেন নবদীপকে। বিপরীতে হরিয়ানার বিজেপি জোট সরকার নবদীপের বিরুদ্ধে সরকারীকাজে বাধা দান ও হিংসা ছড়ানোর অভিযোগে মামলা রুজু করেছে।

হরিয়ানার রোহতক-পানিপথ সরক ধরে হেঁটে চলেছেন ক্লান্ত কৃষকের দল। শরীর বইছে না তবু অন্যদের সঙ্গে হাঁটতে সঙ্কল্পবদ্ধ তরুন কৃষক গুরমিত লহরা। জান কবুল আর মান কবুল। কৃষকদের দাবির প্রতি নির্বিকার মোদীকে জবাবদিহি করতেই হবে। সুতরাং গুরমিতকে থামলে চলবেনা। কিন্তু হৃদযন্ত্র অচল হয়ে যেতে গুরমিত লহরার দেহ লুটিয়ে পড়ল শীতের রাজপথে। কিন্তু লেখা হয়ে গেল নতুন ইতিহাস। সরকারের কৃষক বিরোধী আইন প্রত্যাহার তথা নীতি বদলের দাবিতে সংগ্রামে প্রথম শহদ হিসেবে চিরজীবী হয়ে থাকবেন গুরমিত লহরা।

শুধু পাঞ্জাব ও হরিয়ানার কৃষকরাই বিক্ষোভে উত্তাল?

বিজেপি অপপ্রচার করছে, পাঞ্জাব-হরিয়ানার ধনীচাষিরা প্রভাব খাটিয়ে ছোট, মাঝারি চাষিদের কাছ থেকে কমদামে ফসল কিনে মান্ডিতে এসে এফসিআই-এর কাছ থেকে বেশীদাম হাতিয়ে নিয়েছে। তারাই এখন লোক ভাড়া করে এনে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে। দেশের অন্যত্র কৃষকরা এই আন্দোলনের পাশে নেই। এ ডাঁহা মিথ্যে কথা। উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরাখন্ড, কর্নাটক, তেলেঙ্গানা – বিভিন্ন রাজ্য থেকে কৃষকরা সামিল হয়েছেন দিল্লী অভিযানে। দিল্লী আসার পথে উত্তরপ্রদেশের আগ্রায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে বহু আন্দোলনকারীকে। ধৃতদের মধ্যে রয়েছেন মধ্যপ্রদেশের কৃষক নেতা যশবিন্দর, প্রতিভা সিন্ধে, কর্নাটক কৃষকসভার নেতা যশবন্ত, সমাজকর্মী মেধা পাটকর প্রমুখ। গুরগাঁওয়ে দিল্লীর রাস্তা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে যোগেন্দ্র যাদব সহ অন্তত ৫০ জনকে। আর মোদী যখন কৃষকদের নিন্দামন্দ  করছে তখন দিল্লীর সর্বস্তরের মানুষ এবং দিল্লীর সীমান্তবর্তী হরিয়ানার জনপদগুলিতে ব্যাপক জনগণ কৃষকদের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছেন। শিখ গুরুদ্বারগুলি যেমন কৃষকদের জন্য খাবার পরিবেশন করছে তেমনই মসজিদগুলি থেকেও তাঁদের খাদ্য সরবরাহ করা হচ্ছে। (আন্দোলনের অভিঘাতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা থেকে কয়েকদিন আগেই আকালি দলের মন্ত্রী হরসিমরত কাউর ইস্তফা দিয়েছেন। আর দিল্লীর স্টেডিয়ামগুলিকে কৃষকদের জন্য অস্থায়ী বন্দিশালারূপে ব্যবহারের কেন্দ্রীয় প্রস্তাবে কেজরিওয়াল ‘না’ করে দিয়েছেন) সর্বক্ষণ বিজেপি যখন ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও ঘৃণার রাজনীতি ফেরি করছে তখন এই বিশাল কৃষক আন্দোলন এক ঐক্যবদ্ধ ভারতের চেহারাকেই নতুন করে সামনে আনতে সাহায্য করেছে। আর শত বাধা পার করে কাতারে কাতারে কৃষক রাজধানীকে অচল করে দেওয়ার সঙ্কল্পে যখন অটল তখন মোদী সরকারকে সুর নরম করতে হয়েছে। কেন্দ্রের কৃষিমন্ত্রী নরেন্দ্র তোমর বলছেন, কৃষক নেতাদের সঙ্গে তিনি ৩ ডিসেম্বর আলোচনায় বসতে রাজি। আর মোদী সরকার নিরুপায় হয়ে জানিয়েছে, উত্তর দিল্লীর নিরাঙ্কারি ময়দানে (যা আসলে দিল্লীর প্রায় বহির্ভাগে এক জনবিরল প্রান্তর) কৃষকরা সমাবেশ করতে পারে। সংযুক্ত কৃষক মোর্চা বা এআইকেএসসিসি-র নেতারা অবশ্য জানিয়েছেন, হয় তাঁদের রামলীলা ময়দান অথবা যন্তর মন্তরে সমাবেশ করতে দিতে হবে নয়ত কৃষকরা দিনের পর দিন দিল্লী ও দিল্লীগামী নিকটবর্তী রাজপথগুলি অবরুদ্ধ করে রাখবেন। হ্যাঁ, লাগাতার অবরোধের কথা তাঁরা বলতেই পারেন কারণ কৃষকরা এসেছেন কোমর বেঁধে, বেশ কিছুদিনের খাদ্যসামগ্রী বস্তাবন্দি করে।

ki

কৃষকদের দিল্লী অভিযান গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের এক মাইল ফলক হয়ে থাকবে

কৃষিপণ্যের বাণিজ্য ও বিপণন, চুক্তিচাষ ও অত্যাবশ্যক পণ্য (সংশোধনী) সংক্রান্ত তিনটি আইন আন্দোলনের চাপে প্রত্যাহার হবে কিনা, তা সময়ই বলবে। কিন্ত মোদী সরকারের ভণ্ডামির মুখোশ উন্মোচনে এবং গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কৃষকদের আন্দোলন সমগ্র দেশবাসীকে বিপুল শক্তি জোগাবে। ২০১৪-তে প্রথমবার ক্ষমতায় এসেই নরেন্দ্র মোদী জোর করে জমি অধিগ্রহণের জন্য এক অধ্যাদেশ এনেছিল। দেশজোড়া প্রতিবাদের মুখে সে যাত্রায় পিছু হটলেও মোদী সরকার কৃষিক্ষেত্রকে কর্পোরেটদের হাতে সঁপে দেওয়ার জন্য এই কুৎসিত আইনগুলি প্রণয়ন করেছে। মোদীপন্থীরা বলছে, ফড়েদের হাত থেকে কৃষকদের স্বাধীনতা দেওয়াই নাকি আইনগুলির লক্ষ্য। বাজপেয়ী জমানার মন্ত্রী শান্তাকুমারকে দিয়ে একটা রিপোর্ট তৈরি করিয়ে মোদিজিরা বলছেন, কৃষকদের মাত্র ৪% সরকারি দরে ফসল বেচার সুযোগ পায়। সুতরাং বাকি ৯৬% কৃষকের স্বার্থেই নাকি নয়া আইন। সরকারী উদ্যোগে ফসল কেনার ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থাকে মেরামত করে আরো বেশি বেশি কৃষকের কাছ থেকে ফসল কেনার বন্দোবস্ত না করে আদানি-আম্বানি জয় শাহদের কোম্পানিসমূহের কবলে কৃষকদের ঠেলে দেওয়ার চক্রান্ত কিন্তু ছোট-বড় সমস্ত কৃষক বুঝে ফেলেছেন। ঠেলায় পড়ে বিজেপি নেতারা বলছেন “সরকারী উদ্যোগে ফসল কেনার ব্যবস্থাও বহাল থাকবে।” তাহলে কোনোমতেই এমএসপি’র নীচে কোনো সংস্থা ফসল কিনতে পারবে না – আইনের মধ্যে স্পষ্টভাষায় এই ধারা সংযোজিত হলনা কেন? এর আগে স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশ কার্যকরী করবেন বলে মোদী ক্ষমতায় এসেছিলেন। আর গদিতে বসেই স্বামীনাথন কমিটির রিপোর্টকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। ছ’বছর আগে সেই বিশ্বাসঘাতকতা দেখে কৃষকরা হয়ত হতবাক হয়েছিলেন। কিন্তু গঙ্গা-যমুনা-বিতস্তা-বিপাশা দিয়ে এরপর জল অনেক গড়িয়েছে। এবার মোদীর নতুন বিশ্বাসঘাতকতা বিনা চ্যালেঞ্জে দেশ মেনে নেবেনা। কৃষকদের দ্বারা অবরুদ্ধ দিল্লীতে ছাত্র-যুবরাও যখন আন্দোলনকারীদের পাশে তখন মোদী জমানার পতনের যে কাউন্টডাউন শুরু হল, তা দিনের আলোর মতেই পরিষ্কার।

  - মুকুল কুমার    

খণ্ড-27
সংখ্যা-43