প্রতিবেদন
বিদূষক ও মোসাহেব
bik

রামগরুড়ের ছানা
    হাসতে তাদের মানা,

হাসির কথা শুনলে বলে, 
“হাসব না-না, না-না!”

সদাই মরে ত্রাসে -- ওই বুঝি কেউ হাসে!

এক চোখে তাই মিটমিটিয়ে
তাকায় আশেপাশে।

ঘুম নাহি তার চোখে      
আপনি বকে বকে

আপনারে কয়, “হাসিস যদি 
মারব কিন্তু তোকে!”

হাসতে এত ভয় পায় কারা? সুকুমার রায়ের কবিতাটা ছোটবেলা থেকে অসংখ্য বার পড়তে গিয়ে আপামর বাঙালির মনে এই প্রশ্নটা জাগে, এবং নেহাত খেয়াল রসের আজগুবি কবিতা ভেবে প্রশ্নটা পাশে সরিয়ে রেখে আমরা প্রাণ খুলে হাসি। কিন্তু বড় হতে হতে ক্রমশ মালুম হয়, এমন রামগরুড়ের ছানা আমাদের চারিদিকে নেহাত কম নেই। ব্যতিক্রমহীনভাবে তারা সকলেই ক্ষমতাবান। দোর্দণ্ডপ্রতাপ জ্যাঠামশাই, অফিসের বস, ক্লাবের প্রেসিডেন্ট, পুলিশকর্তা, অমুক মন্ত্রী তমুক মন্ত্রী -- এদের মধ্যেই রামগরুড়ের ছানাদের দেখা যায়। কখনো হাসতেন না এমন জেঠিমার স্মৃতি খুব বেশি লোকের আছে কি? কারো অফিসে সদা গোমড়ামুখো চাপরাশি আছে? যে রোজ ক্লাবঘর ঝাঁট দেয়, তার পক্ষে কি রামগরুড়ের ছানা হওয়া সম্ভব? নাকি পুলিশ কনস্টেবল গাম্ভীর্য দেখাতে পারে? রাশভারী ফুটপাথবাসী দেখেছেন কখনো? আসলে ক্ষমতা বজায় রাখতে চাই কর্তৃত্ব। আর হাসলেই কর্তৃত্ব হারিয়ে যাওয়ার ভয় পায় ক্ষমতাশালী। যার ক্ষমতার ভিত যত দুর্বল, সে ভিতে যোগ্যতার মাটি যত কম, তার ক্ষমতা হারানোর ভয়ও তত বেশি। অতএব হাসতে ভীষণ ভয়। যারা হাসায়, তাদেরও ভয়। আর ক্ষমতাশালীর ভয়ের প্রকাশ আক্রমণে। যারা হাসায়, তাদের নিষিদ্ধ করতে হয়, তাদের বিরুদ্ধে এফআইআর করতে হয়, আদালত অবমাননার মামলা ঠুকতে হয়। কারণ হাসির মতো বিপজ্জনক জিনিস আর নেই। হাসি ভয় ভেঙে দেয়। ক্ষমতাশালীর চোখে স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান কুণাল কামরা তাই উমর খালিদ, স্ট্যান স্বামী বা ভারভারা রাওয়ের চেয়ে কম বিপজ্জনক নন।

কুণাল অবশ্য এই প্রথম ক্ষমতাশালীর চাঁদমারি হলেন তা নয়। এর আগেও একাধিক জায়গায় তাঁর অনুষ্ঠান নিয়ে গোলমাল হয়েছে, এফআইআর হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর দলকে খোঁচা মেরে লোক হাসান বলে তিনি নিয়মিত প্রকাশ্যে (ইন্টারনেটে) খুনের হুমকি পেয়ে থাকেন। ইউটিউবে দেখতে পাবেন, আরেক স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান বরুণ গ্রোভার তাঁর এক অনুষ্ঠানে বলছেন “অনেকে আমাকে জিজ্ঞেস করে ‘আপনি এইসব জোক বলেন, আপনার ভয় করে না?’ তা আমি বলি হিট লিস্টে আমার আগে কামরার লাইন আছে। ওকে উড়িয়ে দিলে তারপর ভয় পাবখন।”

তবে এবার কুণাল নরেন্দ্র মোদী বা বিজেপির পা টেনেই থামেননি। সরাসরি সুপ্রিম কোর্টকে হাসির পাত্র করে দিয়েছেন। সুপ্রিম কোর্টকে সুপ্রিম জোক বলেছেন। প্রাসাদোপম আদালতের মাথায় যেখানে জাতীয় পতাকা লাগানো থাকে, ফোটোশপে সেখানে বিজেপির পতাকা বসিয়ে ছবি টুইট করেছেন, মহাত্মা গান্ধীর জায়গায় আইনজীবী হরিশ সালভের ছবি টাঙানোর পরামর্শ দিয়েছেন। দুঃসাহস এমন জায়গায় পৌঁছেছে, যে অ্যাটর্নি জেনারেল কে কে বেণুগোপাল তাঁর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা শুরু করতে অনুমতি দেওয়ার পর কুণাল নাতিদীর্ঘ টুইটার বিবৃতিতে পরিষ্কার বলে দিয়েছেন ক্ষমাও চাইবেন না, টুইটগুলো প্রত্যাহারও করবেন না। মুখ গোমড়া না করে উপায় আছে?

কমেডিয়ানদের দুঃসাহস অবশ্য নতুন কিছু নয়। আমাদের দেশে প্রাচীনকাল থেকে এঁদের বলা হয় বিদূষক। বস্তুত দুঃসাহস না থাকলে বিদূষক হওয়ার মানে হয় না। রাজা রাজড়াদের আমলেও অন্য কেউ যা বললে গর্দান যাওয়ার ভয় থাকত, বিদূষক অনায়াসে রাজাকে সেসব বলতে পারতেন। বাদশা আকবরের বিদূষক বীরবল বা মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের গোপাল ভাঁড়ের প্রচলিত গল্পগুলো থেকে তা পরিষ্কার। যদিও গল্পগুলোয় ইতিহাস আর গল্পকথার মিশেল কতটা তা বলা দুঃসাধ্য, তবু বিদূষকের অধিকারের সীমানা যে বহুদূর বিস্তৃত, তা বোঝা যায়। যা রটে তার কিছু তো বটে। সত্যজিৎ রায়ের অনুবাদে বিপুল জনপ্রিয় মোল্লা নাসিরুদ্দিনের গল্পগুলো বিদেশ থেকে এসেছে, কিন্তু সেখানেও মোল্লার দুর্দমনীয় স্পর্ধা। এ যুগে যা নতুন, তা হল বিদূষক কেবল বিদূষক থাকতে পারছেন না। তাঁকে এমন অনেক কাজ করতে হচ্ছে যা তাঁর করার কথা নয়।

তাঁকেই সরকারের রাজনৈতিক বিরোধী হয়ে উঠতে হচ্ছে। বিরোধীরা কোন ইস্যুতে সরকারের কৈফিয়ত দাবি করবেন, তা বুঝতেই অনেক সময় হিমশিম খাচ্ছেন। অথচ স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ানরা হাসির ছলে সরকারকে বিবস্ত্র করে দিচ্ছেন সেইসব ইস্যুতে। গোরক্ষার নামে মুসলমান নিধন থেকে শুরু করে চীনা দ্রব্য বয়কট পর্যন্ত বহু ইস্যুতেই এই ঘটনা দেখা গেছে। তার চেয়েও বেশি করে যে ভূমিকা কমেডিয়ানদের নিতে হচ্ছে, তা সাংবাদিকের। দেশের সংবাদমাধ্যম -- গণতন্ত্রের তথাকথিত চতুর্থ স্তম্ভ -- সরকারের কণ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়েছে। উপরন্তু বাবু যত বলে পারিষদ-দলে বলে তার শতগুণ। সরকার নোট বাতিল করে দিলে নিউজ চ্যানেল বলে নতুন নোটে নাকি মাইক্রোচিপ বসানো আছে। মাটির নীচে পুঁতে রাখলেও সিগনাল পাঠাবে। ফলে কালো টাকা ধরা পড়বে। সংবাদমাধ্যম তার প্রধান দুটো কাজই বিস্মৃত হয়েছে। (১) প্রচার থেকে মিথ্যা সরিয়ে সত্য উদ্ঘাটন, (২) বঞ্চিত, ক্ষমতাহীন মানুষের কথা প্রচার করা। ক্ষমতাকে প্রশ্ন করা। এক নম্বর কাজটা পুরোপুরি ছেড়ে দিয়ে অধিকাংশ সংবাদমাধ্যম এমনই কলের গান কুকুর মাথা হয়ে উঠেছে, সত্যাসত্য বিচার যে সাংবাদিকতার অ আ ক খ, সে কথা আমরা ভুলেই গেছি। আলাদা করে ফ্যাক্ট চেকিং ওয়েবসাইট তৈরি হয়েছে। আর ক্ষমতাকে প্রশ্ন করার দায়িত্ব পড়েছে কমেডিয়ানদের ঘাড়ে। কুণাল কামরা তাই স্ট্যান্ড আপ কমেডি করেই থেমে থাকেন না, ‘শাট আপ ইয়া কুণাল’ নামে সাক্ষাৎকারের অনুষ্ঠানও করেন। সেখানে আগত রাজনীতিবিদ বা অন্য ক্ষেত্রের বিখ্যাত মানুষদের জিজ্ঞেস করা হয় না “আপনি কি আম চুষে খান না ছাড়িয়ে খান?” প্রশংসায় ভরিয়ে দেওয়া হয় না আগত মানুষটিকে, বলা হয় না “এক ফকিরি হ্যায় আপ মে”।

কুণাল, বরুণ বা অন্যরা অবশ্য এখনো জন অলিভারের মতো হাসতে হাসতে খবরের সম্পূর্ণ কাটাছেঁড়ায় প্রবেশ করেননি। হয়ত শিগগির করতে হবে, কারণ বিদূষকের অবস্থান সবসময়ই মোসাহেবের বিপরীত মেরুতে। আর যে দেশের সংবাদমাধ্যম মূলত রাজার মোসাহেব হয়ে গেছে, সে দেশে বিদূষকদের আরো বেশি সংবাদে মন দিতেই হবে। সবচেয়ে বিখ্যাত মোসাহেবটির সাথে আবার কুণালের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। তাঁকে নিয়ে কুণাল যারপরনাই রসিকতা করে থাকেন। ভদ্রলোককে সবচেয়ে ফাঁপরে ফেলেছিলেন এ বছরের জানুয়ারি মাসে। বিমানে তাঁর দেখা পেয়ে কুণাল তাঁকে কিছু প্রশ্ন করতে চেয়েছিলেন। সিংহহৃদয় অর্ণব গোস্বামী, যিনি নিজেকে জাতির কণ্ঠ মনে করেন, গগনবিদারী চিৎকারে নিজের অপছন্দের লোকেদের কাছে নেশনের দিব্যি করে জবাব চান, তিনি মুখ খোলা দূরে থাক, নিজের মোবাইলের পর্দা থেকে চোখ তুলে তাকাতে পর্যন্ত পারেননি। রাজানুগ্রহে তাঁর লাঞ্ছনার প্রতিকার হয়েছিল ছ’মাসের জন্য কুণালের বিমানে চড়ার অধিকার কেড়ে নেওয়া।

কুণালের সুপ্রিম কোর্টকে নিয়ে দুর্বিনীত রসিকতার পিছনেও তাৎক্ষণিক কারণ এই মোসাহেবটি। আত্মহত্যার প্ররোচনা দেওয়ায় অভিযুক্ত অর্ণব হাইকোর্টে নাকচ হওয়া জামিনের আবেদন নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে দরবার করতেই শুনানির দিন পেয়ে গেলেন এবং জামিন পেয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামীর মতো হাত নাড়তে নাড়তে বেরিয়ে এলেন। অথচ গত বছরের আগস্ট মাস থেকে কাশ্মীরের বাসিন্দাদের কয়েকশো habeas corpus (বন্দী প্রত্যক্ষীকরণ) পিটিশন শোনার সময়ই পাচ্ছেন না সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা। অর্ণবের গ্রেপ্তারির নিন্দা করে বিচারপতি চন্দ্রচূড় ব্যক্তিগত স্বাধীনতার পবিত্রতা সম্বন্ধে বিস্তর ভাল ভাল কথা বলেছেন। অথচ স্ট্যান স্বামী, ভারভারা রাও, আনন্দ তেলতুম্বড়ে, উমর খালিদ বা শার্জিল ইমামের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য নেই। সিএএ বিরোধী আন্দোলন করার অপরাধে আরো বহু নাম না জানা মানুষ গ্রেপ্তার হয়ে আছেন, জামিন পাচ্ছেন না। তাঁদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা নিয়েও কোন উচ্চবাচ্য দেখা যায় না। এমনকি অর্ণবের মতই পেশায় সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পানের ব্যক্তিগত স্বাধীনতাও বিচারপতিদের কৃপা দৃষ্টি পায়নি। তাই কুণাল তাঁর টুইটার বিবৃতিতে লিখেছেন “আমার অবমাননার পিটিশনের শুনানিতে যে সময় খরচ হবে (প্রশান্ত ভূষণের শুনানির কথা মাথায় রাখলে অন্তত ২০ ঘন্টা তো বটেই) সেটা আমি তাঁদের দিতে চাই, যাঁদের আমার মত লাইন টপকে আদালতের সামনে আসার সৌভাগ্য হয়নি।”       (ভাষান্তর আমার)

বিবৃতির শেষ দিকে কুণাল লিখেছেন “ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এখনো আমার টুইটগুলো সম্বন্ধে কিছু বলেননি। কিন্তু যখন বলবেন, তখন ওগুলোতে আদালত অবমাননা হয়েছে বলে রায় দেওয়ার আগে আশা করি একটু হেসে নেবেন।” বিচারকরা হাসবেন কিনা জানি না, অর্ণব গোস্বামী কিন্তু হাসেন না।

- প্রতীক  

খণ্ড-27
সংখ্যা-41