প্রতিবেদন
পথে এবার নামো সাথী
ppp

আজ থেকে আঠাশ বছর আগে ৬ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক স্থাপত্য কীর্তি হিসেবে মান্য বাবরি মসজিদকে যেদিন ধ্বংস করে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়ার মতো অপকর্মটি করেছিলেন বিজেপি সহ সংঘপরিবারের বিভিন্ন নেতৃত্ববৃন্দ এবং তাদের উচ্ছৃঙ্খল হিন্দুত্ববাদিরা, সেদিন যে কলঙ্ক রেখা লিপিবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল ইতিহাসের পাতায় তার অপনোদন বোধহয় কখনও সম্ভব নয়। তবু দেশের কোটি কোটি মানুষ আশা করেছিলেন দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয়ের নিকট থেকে একটা আশাপ্রদ রায় মিলবে যাতে করে ভারতীয় গণতন্ত্রের মুখের কালিমা অনেকটাই মুছে যাবে।

এই ঘটনার পরেরদিনই ‘দ্য হিন্দু’ পত্রিকার সম্পাদকীয় কলামে এই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে লেখা হয়েছিল : হিন্দু ধর্মীয়  উন্মত্ততা তার কুৎসিত অপকর্মের একটা সাক্ষ্য রেখেছে গতকাল। প্রায় সাড়ে চারশ’ বছরের সুপ্রাচীন বাবরি মসজিদের মতো একটি ঐতিহাসিক স্থাপত্যশিল্পকে উন্মত্ত করসেবকরা ভেঙে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে এক দুঃস্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটিয়েছে। তাদের এই অপকর্ম ভারতীয় গণতন্ত্রের ঐতিহ্যকে কলঙ্কিত করেছে। অল্পসংখ্যক রাজ্য-পুলিশ বাহিনীর বিপ্রতীপে সেখানে উপস্থিত ছিল অনেক অনেক বেশি সংখ্যক ত্রিশূলধারী ধর্মোন্মত্ত করসেবক বাহিনী। আরএসএস, বজরংদল, বিশ্বহিন্দু পরিষদের জঙ্গি বাহিনী নিয়ে বিজেপি নেতৃবৃন্দ বাস্তবিক এক ফ্যাসিস্ত কার্যক্রমের মহড়া দিয়েছে। আদবানি সহ বিজেপির নেতৃবৃন্দ এই ন্যক্কারজনক কর্মের ব্যাপারে দায় অস্বীকার করলেও তাঁরা তাঁদের এই কলঙ্কিত হাত ধুয়ে ফেলতে পারবেন না। এসব কথা লেখার পর এই সম্পাদকীয় নিবন্ধে আরও লেখা হয়েছিল : দেশের সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে একত্র হয়ে এই খাদের কিনার থেকে দেশকে রক্ষা করার উদ্যোগ নিতে হবে এবং অবিলম্বে এই ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে নতুন করে বাবরি মসজিদ সংস্থাপন করে ভারতীয় গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধার করতে হবে। (The Hindu, December 7, 1992)

কিন্তু এই সম্পাদকীয় নিবন্ধের বক্তব্য বা আবেদন হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্তদের কাছে মান্যতা পায়নি, দেশের ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিও এমন কোনও ভূমিকা বা উদ্যোগ নিয়ে ব্যর্থ হয়েছিলেন যাতে করে সেই ধ্বংসস্তূপে বাবরি মসজিদের পুনর্নিমাণ সম্ভবের শিল্প হয়ে ওঠে। সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা সমবেত হয়ে আইন এবং বিচারব্যবস্থার ওপর নিবিড় আস্থা রেখেছিল।

তাঁর ‘বঙ্গদেশের কৃষক’-এ বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন: আমাদের দেশে ‘ভাল আইন’ ছিলনা, তাই ‘বিলাত’ থেকে ‘ভাল আইন’ আনা হয়েছে। এখন সেই আইন দেশে দেশে ‘চড়া দামে’ বিক্রি হচ্ছে। আর এর ফলেই ওকালতি, হাকিমি, আমলাগিরির অত ‘আধুনিক ব্যবসায়ের’ সৃষ্টি হয়েছে। আগে যারা নিজেদের পণ্যদ্রব্যের প্রশংসা তথা বিজ্ঞাপন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন অথচ দারিদ্র্য ঘুচত না, এখন এই আইনের আগমনে তাঁরা রীতিমত ‘বড়লোক’ হয়ে উঠেছেন। ফলে দেশের ‘শ্রীবৃদ্ধির আর সীমা’ নেই। কেননা দেশের সর্বত্রই ‘আইন’ মোতাবেক ‘বিচার’ হচ্ছে, ‘বে-আইনি’ কাজ করে এখন আর কেউ ‘সুবিচার’ এড়িয়ে যেতে পারেন না।

এই ‘সুবিচার’-এর পরিণতিতে বাবর-মির বাকি-র বংশধরেরা আজ আর ‘সুবিচার’-এর নির্মম হাত থেকে  নিষ্কৃতি পেলেন না! আটাশ বছর আগে এক ৬ ডিসেম্বরে যে অপকর্ম করেছিল  হিন্দুত্ববাদিরা সেইকাজ যে কত যথার্থ ছিল গত বছর ৯ নভেম্বর (২০১৯) আমাদের দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয়ের সুবিচারের মাধ্যমে তা সপ্রমাণ হয়েছে! পাঁচজন বিচারপতির বেঞ্চ একদিকে যেমন নিছক বিশ্বাসকে গুরুত্ব দেননি, তেমনই অন্যদিকে তাঁরাই আবার বিতর্কিত স্থানে ‘ভগবান’ রামচন্দ্র যে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তা বিতর্কাতীত বলে জানিয়েছেন! একারণেই তাঁরা অবলীলায় ‘রামলালা’-কেই ওই জমি দান করে দেন! ফলে দেশের মানুষের দীর্ঘদিনের ন্যায়বিচারপ্রাপ্তির আশা চিরতরে তিরোহিত হয়েছে।

দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয় ভগবান নামক ‘রামচন্দ্র’-এর অলীক অস্তিত্ব এবং তাঁর নির্দিষ্ট জন্মস্থান(!)কে মান্যতা দিয়ে স্পষ্টতই একটা সাম্প্রদায়িক অবস্থান নিয়ে প্রতিপক্ষের ওপর তা চাপিয়ে দিয়েছেন! ইতিহাসের তথ্যের বিপ্রতীপে হিন্দুত্ববাদিদের ‘বিশ্বাসই’ তাঁদের নিকট গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে! বাবরি মসজিদ ধ্বংসের কাজকেও তাঁরা পরোক্ষভাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন! ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার ঘোষিত উচ্চারণকে আজ তাঁরা খারিজ করে দিয়েছেন একটি সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পরিপোষণার মধ্যে দিয়ে! বাবরি মসজিদের জায়গায় রামমন্দির-ই হবে -- চারজন বিচারপতির ‘বিরোধহীন’ রায়ের মধ্যে দিয়ে দেশে ‘সুপবন’ প্রবাহিত হলো, আর সেই সুপবনে হিন্দুত্বের বিজয় পতাকা উড়িয়ে দিয়ে তাতে লেখা হয়েছে ‘জয় শ্রীরাম’! হিন্দু ভারতবর্ষের অনেক কাছে চলে এলো মোদীর স্বপ্নের ভারত! রায়ে বাবরি মসজিদ ভাঙার কাজ প্রথামাফিক নিন্দিত হলেও আসলে তা নন্দিতই হয়েছে এবং সেই ভাঙার-কাজে যুক্ত যাঁরা ছিলেন তাঁরা কোনও শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেননি, এই রায়ই তার প্রমাণ! এই রায়ের পর ‘সংযত’ আবেগের উচ্ছ্বাসময় যৌবনের জলতরঙ্গ আর ধরে রাখতে পারেনি হিন্দুত্ববাদীরা। আরএসএস প্রধান বলেই দিয়েছেন মন্দির তো তাঁরা পেয়েই গিয়েছেন! আর পেয়ে যে গিয়েছেন তা তো গত ৫ অগাস্ট স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর পৌরোহিত্যে সেই একদা বিতর্কিত স্থানে রামমন্দির নির্মাণের লক্ষ্যে ‘পূজন’ সমাপনের মাধ্যমেই তা সপ্রমাণ হয়েছে। আর গত ৩০ সেপ্টেম্বর সিবিআই-এর স্পেশাল বিচারপতি সুরেন্দ্রকুমার যাদব তাঁর রায়ে জানিয়েছেন যে বাবরি মসজিদ ধ্বংস আসলে ছিল একটি ‘অপরিকল্পিত’ কাজ! কোনও পূর্ব পরিকল্পনামাফিক এই ধ্বংসকার্য সম্পন্ন হয়নি! ফলে এই মসজিদ ধ্বংসের কাজে অভিযুক্ত স্বয়ং আদবানি সহ সবাই অভিযোগ থেকে নিঃশর্ত মুক্তি পেয়েছেন! অথচ সেদিন (১৯৯২-এর ৬ ডিসেম্বর) বাবরি ধ্বংসের সময় আওয়াজ তোলা হয়েছিল: এক ধাক্কা আউর দো, বাবরি মসজিদ তোড় দো। (The Quint, September 30, 2020) আর এদিন (৩০ সেপ্টেম্বর) বিচারপতি জানালেন এই মসজিদ ধ্বংস আদৌ পূর্বপরিকল্পনা মাফিক ছিলনা!

গতবছরের ৯ নভেম্বর দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বাবরি মসজিদ বিবাদ সংক্রান্ত মামলার নিস্পত্তিমূলক রায়ের সঙ্গে এবছরের ৩০ সেপ্টেম্বরের সিবিআই আদালতের স্পেশাল বিচারপতির রায় একই মুদ্রার অন্যপিঠ হিসেবেই শাসক শ্রেণীর হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ত রাজনীতির পরিপোষণা দিয়েছে। স্বভাবতই এই হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদিদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ পথের লড়াই-ই আজ একমাত্র কর্তব্য হিসেবে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। এবারের ৬ ডিসেম্বর সেই লড়াইয়ের নবসূচনার উদ্বোধন করুক। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে কেবল স্ট্রিটের যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ ফ্যাসিবিরোধিরা আওয়াজ তুলেছিলেন: ‘নো পাসারন’। এর পাশাপাশি আরও একটা আওয়াজ উঠেছিল: ‘নসোত্রোস পাসারেমোস’, যার অর্থ আমরা যাবোই। আজ দিল্লীতে কৃষকরা সরকারী ব্যারিকেড ভেঙে তো এই কথাটি বলে চলেছেন: আমরা যাবোই। তাঁরা এগোচ্ছেন। তাঁদের বাধা দিতে ব্যর্থ হয়েছে সরকারি বাহিনী। এবারের এই ৬ ডিসেম্বরও পথে নেমে এই আওয়াজ দুটিই উঠুক: আমরা ফ্যাসিবাদিদের আসতে দেবো না (নো পাসারন) এবং আমরা এগোবোই (নসোত্রোস পাসারেমোস)।

- অশোক চট্টোপাধ্যায়     

খণ্ড-27
সংখ্যা-43