সৌরপ্রতিম সৌমিত্র
mm

একষট্টি বছর আগে দেখা সত্যজিৎ রায়ের ছবি ‘অপুর সংসার’। সদ্য-বিবাহিত অপু-অপর্ণার আটপৌরে রোমান্তিকতার এক ঝলক। যা বাংলা ছবির দর্শক প্রথম দেখলেন। সে রোমান্তিকতা ছিল স্বাভাবিক ও সত্য, কৃত্রিমতার কলুষ বা সংক্রাম যাকে স্পর্শ করেনি। বাংলা ছবির দর্শক তার আগে অভ্যস্ত ছিলেন কৃত্রিম রোমান্তিকতার চাপিয়ে দেওয়া সিকোয়েন্সের সাথে। প্রেমিক-প্রেমিকা স্কুটারে চেপে ‘লা ল্লা লা লা/এই পথ যদি না শেষ হ্য়/তবে কেমন হ’ত তুমি বলো না’ গাওয়া। এক আদ্যন্ত অবাস্তব রোমান্তিকতার সিকোয়েন্স। পাঠক যেন না ভাবেন আমি কোনভাবে উত্তম কুমার বা সুচিত্রা সেনকে ছোট করছি, বা বিদ্রূপ করছি। সৌমিত্রবাবু ও সত্যজিৎবাবু দুজনেই উত্তম কুমারকে খুব বড় মাপের অভিনেতা মনে করতেন। আমাদেরও একই অভিমত। প্রেমিক-প্রেমিকাকে স্কুটারে চাপিয়ে হাস্যকর রোমান্তিকতার জন্য উত্তম কুমার বা সুচিত্রা সেনকে দোষারোপ করব কেন? এখানে কালপ্রিট পরিচালক বা প্রযোজক।

‘অপু ট্রিলজি’-র দ্বিতীয় ছবি ‘অপুর সংসার’। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম ছবি। প্রধান চরিত্র অপূর্ব (অপু)-র জন্য তাঁকেই বেছেছিলেন সত্যজিৎবাবু। অপর্ণার চরিত্রে শর্মিলা ঠাকুর - তাঁরও প্রথম ছবি। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অপরাজিত’ উপন্যাসটিকে সত্যজিৎবাবু দুটো ভাগে ছবি করেছিলেন - ‘অপরাজিত’ ও ‘অপুর সংসার’। এভাবেই গড়ে উঠল বিশ্ববন্দিত ‘অপু ট্রিলজি’ যার প্রত্যেকটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছিল। ‘অপুর সংসার’ ১৯৬০ সালে পেয়েছিল লন্ডনের সাদারল্যান্ড ট্রফি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল বোর্ড অফ মোশান পিকচার্স-এর বিচারে সে বছরের শ্রেষ্ঠ বিদেশী ছবি।‘অপরাজিত’ ছবিতে সত্যজিৎবাবু প্রথমে অপুর চরিত্রে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কেই বেছেছিলেন, পরে বয়সের কারণে (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের চেয়ে তরুণোতর কাউকে বাছতে) অপু চত্রিত্রে বেছেছিলেন স্মরণ ঘোষাল। তিনিও অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন। আমার বিচারে ‘অপু ট্রিলজি’-র শ্রেষ্ঠ ছবি ‘অপরাজিত’। কাশীতে হরিহরের প্রয়াণ দৃশ্য এক অনতিক্রম্য সিকোয়েন্স- চক্রাকারে শঙ্খিল পথে গৃহস্থের শান্তির প্রতীক পায়রাদের উড়ে যাওয়া। সে ছবি ১৯৬৭ সালে বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘গোল্ডেন লরেল’ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিল।

তিনশোর বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন। তার মধ্যে ১৪টি সত্যজিৎ রায়-পরিচালিত। শেষ ছবি ‘গণশত্রু’ চলচ্চিত্রে তাঁর অভিনেতা হিশেবে গড়ে ওঠার প্রাথমিক সোপান তৈরি করে দিয়েছিলেন সত্যজিৎবাবু, কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের চৌহদ্দির বাইরে গিয়েও তিনি তার চেয়ে বেশি ছবিতে অসাধারণ চরিত্রচিত্রণ করেছেন। সে তালিকা দীর্ঘ। এই ছোট লেখায় তার সবগুলির উল্লেখের অবকাশ নেই। তবু কয়েকটি উল্লেখ করছি। ‘ক্ষুধিত পাষাণ’-এ উত্তম কুমারের দ্বৈত চরিত্রের সাথে খলনায়ক ময়ূরবাহনের চরিত্র, ‘কোনি’তে ক্ষিদ্দা (কোনি চরিত্রে অভিনেত্রী শ্রীপর্ণা মুখোপাধ্যায় একটা ছবিতেই অভিনয় করেছেন। সৌমিত্রের প্রয়াণের পরে বলেছেন, কোনির শেষ দৃশ্যে ক্ষিদ্দার গলায় 'ফাইট কোনি ফাইট' এখনও যেন অক্সিজেন দেয়), ‘আতঙ্ক’ ছবিতে মাস্টারমশাই। ‘সাত পাকে বাঁধা’য় সুচিত্রা সেনের বিপরীতে কলেজ শিক্ষকের চরিত্রায়ন, প্রভৃতি।

তাঁর ‘কিং লিয়ার’এর চরিত্রায়ন আমার মনঃপূত হয়নি। লিয়ার’এর চেয়ে যেন শাজাহানকে পেয়েছি। লিয়ার’এর শয়তান চরিত্র (বিশেষ করে শয়তানের দর্শন) ফুটে ওঠেনি। ‘কিং লিয়ার’এর চরিত্রায়ন অত্যন্ত কঠিন, জটিল। উৎপল দত্ত কেন, লরেন্স অলিভিয়ারও ‘কিং লিয়ার’এর চরিত্রায়ন-এর সাহস দেখান নি। রাশিয়ায় তিন-চারজন করেছেন, কিন্তু তা পরীক্ষামূলক। এ নিয়ে আলোচনার অবকাশ নেই। সম্ভব হলে বারান্তরে করার বাসনা আছে।

সব্যসাচী অভিনেতা। মঞ্চে ও পর্দায় সমান সাফল্য অর্জন করেছিলেন। অভিনয়ে তাঁর শিক্ষাগুরু নাট্যাঁচার্য শিশির ভাদুড়ি। আগে নাটকাভিনয় করতেন। মঞ্চ থেকে পর্দায় এসেছিলেন। প্রায় চার দশক আগে একবার লিখেছিলেন। ফিল্মে ‘আন্ডারঅ্যাক্টিং, স্টেজে ওভারঅ্যাক্টিং’। আসলে তিনি এক অর্থে চিন্তাবিদ ছিলেন। শ্রীপর্ণা এক সাক্ষাৎকারে বলেছেনঃ “ক্ষিদ্দা চরিত্রের জন্য নিজেকে নিয়ে প্রচুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন সৌমিত্র। শ্রীপর্ণা বলছেন, 'একবার শ্যুটিং করতে করতে আমরা বলি, ক্ষিদ্দার সঙ্গে আমাদের কোচ অনিলদার(অনিল দাশগুপ্ত) অনেক মিল রয়েছে। আমাদের সেই কথাটাকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন সৌমিত্রদা। সেটা তখন বুঝলাম, যখন দেখলাম, পরেরদিনই ভোর সাড়ে ৫টায় উনি আমাদের সুইমিং ক্লাব আইএসএল-এ হাজির হয়ে গিয়েছেন। দিনের পর দিন উনি ক্লাবের একটা কোণায় বসে অনিলদাকে লক্ষ্য করতেন। শ্যুটিং-এ দেখেছিলাম, সত্যিই আমাদের কোচের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ অবিকল আয়ত্ত করে ফেলেছেন সৌমিত্রদা।'

কোনির শেষ দৃশ্যে অভিনয় করতে গিয়ে আবেগে কেঁদে ফেলেছিলেন সৌমিত্রদা। গ্লিসারিনের প্রয়োজন ওনার পড়ত না। আমার মনে হয়, উত্তমকুমারের চেয়েও বড়মাপের অভিনেতা ছিলেন উনি।'

অভিনয়ের পাশাপাশি দীর্ঘকাল তিনি আবৃত্তিকার হিসেবে সুপরিচিত। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা নিয়ে আলোচনা হয়নি তেমন। কিন্তু না হওয়ার কোনো কারণ ছিল না।

কবিতা লেখার শুরু ছাত্র অবস্থায়— প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘অন্তমিল’, ‘স্বেচ্ছাবন্দি আষাঢ় কুহকে’, ‘জলপ্রপাতের ধারে দাঁড়াবো ব’লে’, ‘ব্যক্তিগত নক্ষত্রমালা’, ‘শব্দরা আমার বাগানে’, ‘পড়ে আছে চন্দনের চিতা’, ‘হায় চিরজল’, ‘হে সায়ংকাল’, ‘জন্ম যায় জন্ম যাবে’, ‘হলুদ রোদ্দুর’, ‘মধ্যরাতের সংকেত’ প্রভৃতি। তাঁর একটি পদ্যাংশ উদ্ধৃত করছি।

ভালোবাসা

ভালোবাসা মানে কেবলই যাওয়া
কোলকাতা রোল করা গালিচার মত কেবলই খুলে
        যাচ্ছে কেবলই
আমাদের পায়ের নিচে
ফুরোচ্ছে না।

তবু ভালোবাসা ফুরায়ে গেলে
আমি অপ্রেম থেকে চলে যাব ব’লে
অভিমানে বাসস্টপে এসে হাত নেড়ে ডাকি

ভালোবাসা কখনও কখনও চলে যাওয়া
ঘর গ’ড়ে ঘর ভেঙে ফেলা
তারপর উঠে পড়া
পেয়ে গেলে নিকটতম ট্রাম
পড়ে থাক রাজবংশ বৈভব যা কিছু
সব ছেড়ে চলে যেতে পারে শুধু ভালোবাসাই—

সেই কোনোদিন
ফিরে এসে তাকাতে পারে অকপটে অনিমেষ
ক্যাথিড্রালে ঘণ্টা বাজলেই
কিনতে থাকবে মুহূর্ত এন্তার
একরাশ ব্যক্তিগত নীল নক্ষত্রমালা।

ভালোবাসা বহুদিন আগে
ভালোবাসা বহুদিন আগেই
বাসে উঠে পড়তে না পেরে
দাঁড়িয়ে গেছে

হয়ত এখনও বাসস্টপে
মুখ তার
আঠারো বছরের শ্যামল ইস্পাত
হয়ে দাঁড়িয়ে আছে
এক একদিন ইচ্ছে করে
ফিরতি বাসে উঠে চলে যাই
দেখে আসি তাকে

এক একদিন আমার যাওয়ার সম্ভাবনায়
বৃষ্টি আসে
আকাশকে আষাঢ় ব’লে ডাকতে ইচ্ছে করে।
‘এই যে, এত দেরী করলে কেন’
ব’লে কেউ কব্জিটা শক্ত ক’রে
ধ’রে নামিয়ে নেবে
আঠারো বছরের মুখে কিছুটা ইস্পাত থাকে

এখন হাতে পিস্তল রাখা বারণ
তাই নীল ইস্পাতটুকু মুখে

ভালোবাসার কাছে কিছুই নেই এখন
কার্তুজ বন্ধুরা রাজনীতি
একটি বর্ষাতিও নয়
বরষায় তাকে খুব একা দেখব বোধহয়
যদি ফিরতি বাসে যাই।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ৮৫ বছরে জীবনাবসান। হাসপাতালে ভর্তি হবার কয়েক দিন আগেও সক্রিয়। ইংরেজীতে বলতে হয়, ‘আ ভার্সেটাইল ট্যালেন্ট। দি ওয়ার্ল্ড অ্যারাউন্ড আস উইল নট বি সেম আগেন’।

-- শঙ্কর রায়    

খণ্ড-27
সংখ্যা-42