জম্মু ও কাশ্মীর, দিল্লী এবং বেঙ্গালুরুর নাগরিক সমাজের কর্মীদের উপর এনআইএ হানা বন্ধ করো!
haha

আমরা জম্মু ও কাশ্মীর, ব্যাঙ্গালোর ও দিল্লীতে নাগরিক সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গের উপর জাতীয় অনুসন্ধান সংস্থার হামলার তীব্র নিন্দা করছি। এনআইএ-র দাবি হচ্ছে “সন্ত্রাসে আর্থিক মদতের বিরুদ্ধে’’ কড়া শাস্তিমূলক পদক্ষেপের জন্যই এই হানা — কিন্তু এটা আদতে যারা জম্মু ও কাশ্মীরের মানুষের অধিকার ও ভালো থাকা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ তথা চিন্তা ভাবনা করছেন, তাদের হেনস্থা ও চুপ করানোর একটা খুব সহজবোধ্য অজুহাত। মানবাধিকার রক্ষাকারী, মানবাধিকার সংগঠন, সাংবাদিক, এবং নাগরিকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য এনআইএ-কে ব্যবহার করে মোদী  সরকার জম্মু ও কাশ্মীরের মানুষের প্রতি যে অপরাধ তারা করে চলেছে তার সাক্ষী যাতে কেউ না থাকে সেটা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে।

যে সব সংগঠন (গ্রুপ) এবং ব্যক্তিকে এনআইএ নিশানা করেছে, তাদের মানবাধিকার রক্ষার ও মানবিক কাজের দীর্ঘ ও হৃদয়গ্রাহী ধারাবাহিক ইতিহাস আছে। যেমন জম্মু ও কাশ্মীর কোয়ালিশন অব সিভিল সোসাইটি (জেকেসিসিএস) অচিহ্নিত গণ কবর, সাজানো সংঘর্ষ, পুলিশি হেফাজতে নির্যাতন, যৌন হিংসা এবং জম্মু ও কাশ্মীরে শিশুদের উপর হিংসার প্রভাব নিয়ে গবেষণা করেছে এবং নথিভিত্তিক রিপোর্ট তৈরি করেছে। জেকেসিসিএস উপত্যকায় নিহত কাশ্মীরি পণ্ডিতদের জন্যও ন্যায় সুনিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে একটি বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের চেষ্টা চালিয়ে গেছে। দ্য অ্যাসোসিয়েশন অব পেরেন্টস অব ডিসঅ্যাপিয়ার্ড পার্সনস (এপিডিপি) এমন একটি সংগঠন যা ন্যায় ও সত্যের জন্য অন্যতম এক দীর্ঘতম লড়াই চালিয়েছে : রাষ্ট্র শক্তির দ্বারা “নিখোঁজ” মানুষদের অভিভাবকদের সংগঠিত করেছে, তাদের স্মৃতিতে প্রতি সপ্তাহে পদযাত্রার আয়োজন করেছে।

এনআইএ-র নিশানায় থাকা আরেক জন হলেন জাফারুল ইসলাম খান, দিল্লী মাইনরিটি কমিশনের প্রাক্তন সভাপতি এবং দিল্লী গেজেট-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক, যিনি চ্যারিটি অ্যালায়েন্স নামে একটি মানবিক সংগঠন চালান। মিস্টার খানের নেতৃত্বে দিল্লী মাইনরিটি কমিশন ফেব্রুয়ারী ২০২০-তে দিল্লী হিংসার একটি রোমহর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে যা মুসলিমদের বিরুদ্ধে সুপরিকল্পিত হিংসায় দিল্লী পুলিশের জড়িত থাকার এক সাক্ষ্যপ্রমাণ সম্বলিত দলিল। চ্যারিটি অ্যালায়েন্স দিল্লী হিংসার শিকার বিপর্যস্ত মানুষদের ত্রাণ বিলি করেছিল।

এনআইএ-র হানার নিশানায় অন্য গ্রুপগুলিও রয়েছে যারা তাদের দীর্ঘ দিনের মানবিক কাজকর্ম, বিপর্যয়কালীন ত্রাণকাজ, জম্মু ও কাশ্মীর অঞ্চলে সাহায্যমূলক কাজের জন্য সুপরিচিত। মোদী সরকার এই গ্রুপগুলির গায়ে “সন্ত্রাসের” রং লাগিয়ে, চরম সংকটের সময় জম্মু ও কাশ্মীরের মানুষের  মানবিক সাহায্য ও ত্রাণ পাওয়াটুকুও বন্ধ করে দিতে চাইছে। এনআইএ ‘গ্রেটার কাশ্মীর’ সংবাদপত্রের অফিসেও হানা দিয়েছে — যে সংবাদ পত্রটি অত্যন্ত পেশাদারিত্বের সাথে সৎ ও সাহসী সাংবাদিকতার জন্য বিশেষ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত।

বেঙ্গালুরুতে এনআইএ স্বাতী শেষাদ্রির বাসস্থানে হানা দিয়েছে — এক সচেতন বিবেকনিষ্ঠ নাগরিক যিনি মানুষের প্রয়োজনে সাড়া দিয়েছেন, এবং নিরবচ্ছিন্নভাবে মানবাধিকার নিয়ে নিজের শহর তো বটেই, ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে সরব হয়েছেন। যেমন, লকডাউনের সময় স্বাতী শেষাদ্রি বৃহত্তর নাগরিক সমাজের জোট “ব্যাঙ্গালোর উইথ মাইগ্র্যান্টস”-এর পক্ষ থেকে, ব্যাঙ্গালোরে আটকে পড়া খাদ্যহীন আশ্রয়হীন ভিন রাজ্যে খাটতে যাওয়া শ্রমিকদের ত্রাণ বিলির কাজ করেছেন।

মোদী জমানায় এনআইএ অন্য বহু সংস্থার মত “খাঁচাবন্দি তোতাপাখি”তে পরিণত হয়েছে : বোমা বিস্ফোরণে অভিযুক্ত বিজেপি সাংসদ প্রজ্ঞা সিং ঠাকুরের বিরুদ্ধে মামলাকে দুর্বল করা, এবং সন্ত্রাসবাদী পাচারে ধৃত জম্মু ও কাশ্মীরের পুলিশ অফিসার দাভিন্দর সিং-এর জামিন পাওয়া নিশ্চিত করা আর অন্যদিকে মানবাধিকারের পক্ষে সওয়ালকারীদের, আইনজীবী ও সাংবাদিকদের ভীমা কোরেগাঁও মামলার সূত্রে তাড়া করে বেড়ানোর জন্য পরিচিত হয়ে উঠেছে। এবার তাদের ডাইনি-খোঁজ সম্প্রসারিত হচ্ছে, নতুন অছিলা জম্মু ও কাশ্মীর।

সারা ভারতবর্ষ জুড়েই গরিব এবং নিপীড়িত মানুষ পুলিশ ও অন্যান্য সরকারী সংস্থাগুলোর অবাধ উন্মত্ত হিংস্রতার সঙ্গে খুব পরিচিত। তুতুকোড়িতে তামিলনাড়ু পুলিশের হাতে জেয়ারাজ ও বেনমিক্স-এর মৃত্যু ভারতে মহামারী হারে বেপরোয়া বন্দি-নির্যাতন ও হাজত-মৃত্যুর ঘটনাকে আলাদাভাবে চিনিয়ে দিয়েছে। অতি সম্প্রতি, বিহারের মুঙ্গেরে দুর্গা প্রতিমার বিসর্জনের জন্য অপেক্ষমান ভক্তদের উপর পুলিশের লাঠিচার্জ ও গুলিচালনার ঘটনায় মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল। মুঙ্গের পুলিশ কর্তৃপক্ষের অফিসে ক্রুদ্ধ জনতা বিক্ষোভ দেখায়, এমনকি বিক্ষোভকারীরা কেউ কেউ গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। পুলিশী লাঠিচার্জের প্রতিক্রিয়ায় ভক্তরা পাথর ছুঁড়তে থাকলে পুলিশ নাকি বাধ্য হয়ে গুলি চালায়—এই পুলিশী অজুহাতকে মানুষ সঠিকভাবেই প্রত্যাখ্যান করেছেন। মানবাধিকার রক্ষাকারীরাই মুঙ্গের, বস্তার, জম্মু ও কাশ্মীরে নাগরিক ও পুলিশ বাহিনীর মধ্যে সুরক্ষা-ঢাল হিসেবে সংবিধানকে তুলে ধরেছেন। সত্যকে উন্মোচিত করেছেন সাংবাদিকরাই — সে মুঙ্গের, তুতুকোড়ি বা কাশ্মীর উপত্যকা যেখানেই ঘটুক। এনআইএ-র মানবাধিকার কর্মী ও সাংবাদিকদের উদ্দেশে হানা ও গ্রেপ্তারি চালানোর আসল উদ্দেশ্য হল সেই সাংবিধানিক ঢালকে সরিয়ে দেওয়া। আমাদের, ভারতবর্ষের মানুষকে অবশ্যই তাদের অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য পাশে দাঁড়াতে হবে যারা নাগরিক এবং মানুষ হিসাবে আমাদের অধিকারকে রক্ষা করে চলেছেন।

সিপিআই(এমএল) কেন্দ্রীয় কমিটি    

খণ্ড-27
সংখ্যা-39