মারাং গোমকে জয়পাল সিং মুণ্ডা সংবিধানসভার ‘জংলি’ মানুষটি
mmmaaa


ভারত যখন তার স্বাধীন সংবিধান রচনা করছিল তখন কেবল দুশো বছরের ব্রিটিশ শাসন থেকে নয়, বরং মুক্তি পেতে চেয়েছিল আরও বহু বহু যুগ ধরে – “ছয় হাজার বছর ধরে চলে আসা” -- ঐতিহাসিক অন্যায়ের শেকল থেকে। ডক্টর ভীমরাও আম্বেদকরের নেতৃত্বে সংবিধান রচনার বছরগুলিতে ভারতেতিহাসের সেই আদি দ্বন্দ্বের বিনম্র প্রতিনিধি হিসেবে সগৌরবে নিজেকে তুলে ধরেছিলেন মারাং গোমকে জয়পাল সিং মুণ্ডা।

ভারতে ব্রিটিশ আসার বহু যুগ আগে থেকেই আদিবাসীরা যে কোনঠাসা এবং ব্রিটিশ চলে যাওয়ার পরও যে সব বদলে যাবে না তা জয়পাল সংবিধানসভার বিভিন্ন বিতর্কে বারবার বলেছেন। ১৯৪৬’র ১৯ ডিসেম্বর সংবিধানসভায় তাঁর প্রথম বক্তৃতাতে নিজেকে তিন কোটি আদিবাসীর ‘জংলি’ প্রতিনিধি হিসেবে পরিচয় দিয়ে সুস্পষ্ট ভাষায় স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, “স্যর, ভারতীয় জনগণের মধ্যে সবচেয়ে হীন আচরণ করা হয়েছে আমার জনগোষ্ঠির সাথেই। বিগত ৬০০০ বছর ধরে অবমাননা আর অবহেলা করা হয়েছে। ... বিগত ৬০০০ বছর আমার মানুষেরা আপনাদের জাতিবিদ্বেষের কারণে ভুগছে, হিন্দু রেসিজম এবং বাকি অন্য সকল রেসিজমের ফল ভুগছে”। যারা সিলেক্ট করলেন তাঁদের মাথায় একবার এল না বিষয়টা! মৌলিক অধিকার কমিটিতে একজনও আদিবাসী প্রতিনিধি নেই কেন? শিক্ষা ও চাকুরিতে এসসি এসটিদের জন্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন জয়পাল সিং মুণ্ডা। বস্তুত সমাজে প্রান্তিক করে রাখা সমস্ত অংশের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার বিষয়ে তাঁর মতো গভীরভাবে সোচ্চার বোধহয় সংবিধানসভায় আর কেউ ছিলেন না। সংবিধানসভার কাঠামো নিয়েই প্রশ্ন তুলে জয়পাল সরাসরি বলেন, “সংবিধানসভায় বড্ড বেশি পুরুষ আধিক্য। আমরা আরও অনেক বেশি মহিলা প্রতিনিধি চাই, বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিতের মতো মহিলা, যিনি আমেরিকাতে রেসিয়ালিজম ধ্বংস করার কাজে জয় অর্জন করেছেন”। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন – পরামর্শদাতা কমিটিতে কোনও আদিবাসী মহিলার নাম নেই কেন? যারা সিলেক্ট করলেন তাঁদের মাথায় একবার এল না বিষয়টা! মৌলিক অধিকার কমিটিতে একজনও আদিবাসী প্রতিনিধি নেই কেন? আদিবাসীদের লোকাচার ও প্রথাগত ঘরোয়া অস্ত্র ধারণকে অপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত করা রোধ করেছিলেন জয়পাল। আদিবাসীদের জন্য স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল গঠনের জন্য লড়েছেন। জল জঙ্গল জমিন থেকে আদিবাসীদের উচ্ছেদের বিরুদ্ধে তীব্র তিক্ত বিতর্ক করেছেন। উন্নয়নের যৌক্তিকতায় উচ্ছেদ ও পুনর্বাসনকে সহজেই মান্যতা দিয়ে দেওয়া প্রসঙ্গে সেই চল্লিশের দশকেই গভীর প্রশ্ন তুলেছিলেন, গরিবমুখী জনমুখী নীতির জন্য লড়েছিলেন জয়পাল। ‘চিত্তরঞ্জন লোকো’ প্রসঙ্গে বলছেন, “উচ্ছেদ হওয়া সাঁওতালদের ক্যাশ টাকা দেওয়া হল, তিন সপ্তাহের মধ্যে তাঁরা ভূমিহীন মজুরে পরিণত হলেন … আমরা কি দেশে ভূমিহীন মজুরের বাহিনীই বাড়িয়ে চলতে চাই?”  ‘দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন বিল’ নিয়ে সংবিধানসভায় ১৯৪৮’এর ১৪ ফেব্রুয়ারী বলেছিলেন, “আমরা ওদের আরও ভালো বাড়ি বানিয়ে দেব – একথা বলে দিলেই তো হবে না। মূল কথাটা হল ওদের আত্মসম্মানবোধটা কি ফিরিয়ে দেবেন? ‘টেগর’-এর শান্তিনিকেতনের উদাহরণ টেনে বলেছিলেন যে, সাঁওতালদের নাচ আসলে ভারতীয় জীবনের ছন্দ। সংবিধানসভার সমগ্র বিতর্কে বারবার একটি বার্তা দিয়ে গেছেন তিনি, “প্রকৃত গণতন্ত্রের অন্তর্বস্তু নিহিত থাকে সহবাসী মানুষের ওপর বিশ্বাস ভরসা না হারানোর ওপর”। আদিবাসীদের ‘সিন্ধু সভ্যতার সন্তান, যারা বহিরাগতদের দ্বারা জঙ্গলে বিতাড়িত হয়েছিল’ বলে বর্ণনা করে বিনীতভাবে জানিয়েছিলেন, “ট্রাইবাল জনতাকে আপনারা গণতন্ত্র শেখাতে পারেন না, বরং তাঁদের কাছ থেকেই আপনাদের শিখতে হবে গণতান্ত্রিক আদব কায়দা”। বহিরাগতদের দ্বারা শোষিত নিপীড়িত ও নিরন্তর উচ্ছিন্ন হওয়ার ধারাবাহিক ইতিহাসে মাঝে মাঝে ছেদ এসেছে কেবল বিদ্রোহের দিনগুলিতে অথবা বিশৃঙ্খলায় –  একথা উল্লেখ করে জয়পাল বলেন যে এসবের পরেও তিনি পণ্ডিত নেহরুর কথা অনুযায়ী মেনে নিচ্ছেন যে – স্বাধীন ভারতে শুরু হচ্ছে সমতা ও সুযোগের এক নতুন অধ্যায় যেখানে কেউই আর অবহেলিত থাকবে না।

ভারতীয় সংবিধান জয়পাল সিং মুণ্ডার এই আশা পুরণের প্রতিশ্রুতি ও সম্ভাবনা তৈরী করেছিল। কিন্তু, অনেক ঝড়ঝাপটার মধ্যে দিয়ে বিগত দশকগুলিতে যেটুকু অর্জন আজ তা বিপন্ন। “বিভিন্ন সাব-কমিটির করা অনুবাদে “আদিবাসী” শব্দটি কখনও ব্যবহার হয় না। কেন? … আদিবাসী শব্দটি আসলে সমীহ জাগায়। আমি ভেবে পায় না কেন এখনও তাদের প্রতি অবমাননাকর ‘বনজাতি’ বিশেষণ প্রয়োগ করা হয় – কিছুদিন আগে পর্যন্তও এই বিশেষণটি দিয়ে অসভ্য বর্বর বোঝানো হত।” – সংবিধান সভায় বলেছিলেন জয়পাল সিং মুণ্ডা। বর্তমান সময়ে আমরা দেখতে পাই যে আরএসএস-বিজেপি কিছুতেই ‘আদিবাসী’ শব্দটিকে স্বীকৃতি দিতে রাজি নয়। তারা সেই পুরনো অবমাননাকর ‘বনবাসী’ বিশেষণই প্রয়োগ করে। অন্যদিকে, বনের ভেতরের গ্রামগুলির আদি বাসিন্দাদের বনের জমি ও সম্পদের ওপর যে চিরাচরিত অধিকার আইনী স্বীকৃতি পেয়েছিল তাকেই কেন্দ্র সরকার লুপ্ত করে দিচ্ছে নয়া বন আইন এনে, সংরক্ষণ ও প্রতিনিধিত্বের প্রশ্ন নস্যাৎ করে দিচ্ছে। সিধু–কানু-ফুলো-বিরসা-জয়পালদের স্বপ্ন ও সংগ্রাম আজ আরও প্রাসঙ্গিক আরও জরুরি হয়ে ওঠে। ৩ জানুয়ারী ২০২০ মারাং গোমকে জয়পাল সিং মুণ্ডার ১০৮তম জন্মবার্ষিকীতে সশ্রদ্ধ সেলাম জানাচ্ছি আমরা।

খণ্ড-27
সংখ্যা-46