ক্রান্তিজ্যোতি সাবিত্রীবাই নারীবাদী সমাজবিপ্লবের অগ্রদূত
sav

সাবিত্রীর জন্ম সাতারা জেলার নইগাঁওয়ে। বছর বারো আগে ১৮১৮ সালে ভীমা কোরেগাঁওয়ের যুদ্ধে মহারাষ্ট্রে পেশোয়া শাসনের অবসান ঘটেছিল, কুখ্যাত ‘পেশোয়া রাজ’ যেখানে ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসন অত্যন্ত হীন ও নৃশংস চেহারা নিয়েছিল। কিন্তু, ব্রিটিশ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হলেও সমাজে ব্রাহ্মণ্যবাদী অনাচার শেষ হয়ে যায়নি। সেরকম পরিস্থিতিতে ঊনবিংশ শতকের শেষার্ধে সাবিত্রী ও জোতিরাও ফুলে, তাঁদের দুই বন্ধু দুই ভাইবোন উসমান শেখ ও ফতিমা শেখ এবং আরও সঙ্গীসাথীদের নিয়ে মহারাষ্ট্রের শুদ্রাতিশুদ্র সমাজের প্রান্তিক অন্ধকার জগত থেকে নবজাগরণের আলোকশিখা উৎসারিত করেছিলেন। সেই সময়ে ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে সাবিত্রী ফুলের জীবন ও সংগ্রাম ভারতের সমাজবিপ্লবে এক অন্যতম আলোকবর্তিকা। ভারতীয়দের দ্বারা আধুনিক স্কুলের প্রথম প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম শিক্ষয়িত্রীই নন কেবল, বহু বিষয়েই পিতৃতান্ত্রিক লক্ষণরেখা পেরনোর তিনিই পথিকৃৎ।

১৮৯০ সালে বন্ধু ও সহকর্মী, স্বামী ও শিক্ষক মহাত্মা জোতিরাও ফুলের মৃত্যুর পর শেষকৃত্যের লোকাচার নিজের হাতে সম্পন্ন করেন সাবিত্রী। হাজার বছরের ইতিহাসে সম্ভবত সেই প্রথম কোনও নারীর হস্তে শেষকৃত্যের লোকাচার সম্পন্ন হয়েছিল। ব্রাহ্মণ্যবাদী বিধানে শেষকৃত্যের অধিকার কেবলমাত্র পুরুষ উত্তরাধিকারীর ওপরই অর্পিত। সাবিত্রীবাই এই পিতৃতান্ত্রিক বিধান অমান্য করেছিলেন। ১৮৯৩ সালে সাবিত্রীবাই ফুলের সভানেতৃত্বে সাসওয়াড়ে ‘সত্যসোধক সম্মেলন’ সংগঠিত হয়। সম্মেলনের সর্বোচ্চ পদে একজন মহিলার অধিষ্ঠানও ছিল এক বৈপ্লবিক ঘটনা।

জ্যোতির পিসিমা বাল্যবিধবা সাগুনাবাইয়ের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৮৪৮ সালে ভিদেওয়াড়ায় মেয়েদের জন্য প্রথম স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন ফুলেরা। সাবিত্রী এই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। যে ভারতবর্ষে হাজার বছর ধরে ব্রাহ্মণ্যবাদী বিধানে শুদ্র ও নারীর জ্ঞানার্জন নিষিদ্ধ ছিল, সেখানে শুদ্র নারী-পুরুষ দ্বারা শুদ্রাতিশুদ্র ছেলেমেয়েদের জন্য আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞান শিক্ষার স্কুল প্রতিষ্ঠা ছিল এক যুগান্তের সূচনা, এক সুদূরপ্রসারী শ্রেণীসংগ্রামের নয়া ঘোষণা। এর কিছুদিনের মধ্যেই জোতির বাবা গোবিন্দরাও সমাজের চাপে পুত্র ও পুত্রবধুকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন। এই সময় পাশে এসে দাঁড়ান উসমান শেখ ও ফতিমা শেখ। ফতিমাদের বাড়িতেই আবার শুরু হয় স্কুল, নাম, ‘ইন্ডিজেনাস লাইব্রেরি’। ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করায় শারিরীক আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে ফুলেদের। জোতিবাকে হত্যার চেষ্টা হয়েছে। সাবিত্রীবাই ও ফতিমা শেখ যখন স্কুলে যেতেন তখন রাস্তায় তাদের দিকে টোনটিটকিরি সহ কাদানোংরা বা গোবর ছোড়া হত। ফতিমাকে ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজের সাথে সাথে নিজের মুসলমান সমাজের মধ্যে থেকেও বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। কিন্তু তাতে মোটেই দমে যাননি তিনি। বাড়ি বাড়ি ঘুরে ছাত্রী জোগাড় করতেন, অসীম ধৈর্য নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা পরিবারের মানুষদের বোঝাতেন মেয়েদেরকে লেখাপড়া শেখানোর প্রয়োজনীয়তা। নারীমুক্তি আন্দোলনের ময়দানে নিপীড়িতের ঐক্যের উজ্জ্বল প্রতীক সাগুনা সাবিত্রী ও ফতিমা। ১৮৫২ সালে ‘মহিলা সেবা মণ্ডল’ গঠন করেন ফুলেরা। এটিই ভারতের প্রথম নারীবাদী সংগঠন। মেয়েদের অধিকার সচেতন করে তুলতে বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে, বিধবা বিবাহের পক্ষে ও বিধবাদের দুর্দশার বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান চলে। বিধবা বিবাহে উৎসাহ দিতে থাকেন। ভ্রূণহত্যার বিরুদ্ধে প্রচার চালান। অন্তঃসত্বা বিধবারা যাতে সমাজের চাপে আত্মহত্যা করতে বা ভ্রূণহত্যা করতে বাধ্য না হন তার জন্য ‘বাল হত্যা প্রতিবন্ধক গৃহ’ প্রতিষ্ঠা করেন। সাবিত্রীর নিজের বাড়িটাও হয়ে ওঠে তথাকথিত ‘অবৈধ’ অনাথ সন্তান এবং সন্তানসম্ভবা বিধবাদের আশ্রয়। অনেক ব্রাহ্মণ বিধবা সাবিত্রীর আশ্রয়ে আসেন। এরকমই একজনের সন্তান যশবন্তকে অফিসিয়ালি দত্তক নেন ফুলে দম্পতি। সাবিত্রীর পরামর্শে ফুলেদের বন্ধু ওয়ালভেকার ‘গৃহিণী’ পত্রিকা প্রকাশ করা শুরু করেন যেখানে কেবলমাত্র নারীমুক্তির প্রশ্নেই লেখা ছাপা হত। ১৮৭৩ সালে স্থাপিত ‘সত্যসোধক সমাজ’ ভারতে তৃণমূল স্তরে প্রথম জাতব্যবস্থা-বিরোধী গণসংগঠন। সংগঠনের দৈনন্দিন কাজকর্ম দেখাশোনা করতেন সাবিত্রী। সংগঠনের মহিলা ইউনিট চলত তাঁর নেতৃত্বে। সত্যসোধক সমাজের আন্দোলনের একটি দিক ছিল সত্যসোধক বিবাহ। ব্রাহ্মণ পুরোহিত তথা ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতান্ত্রিক লোকাচার এবং পণ দেওয়া-নেওয়া বর্জন করে পাত্র-পাত্রীর পারস্পরিক সম্মতি ও মঙ্গলকামনা উচ্চারণের মাধ্যমে সম্পন্ন হত বিবাহ। সাবিত্রী নিজের সন্তান যশবন্তের বিবাহও অসবর্ণ ও সত্যসোধক পথে দিয়েছিলেন। এবং শুধু তাই নয়, বিবাহের বেশ কিছুদিন আগেই হবু পুত্রবধু রাধাকে সাবিত্রীবাই বাড়িতে এনে রেখেছিলেন যাতে বিবাহের আগে তারা পরস্পরকে আরও ভালোভাবে জেনেবুঝে নিতে পারে।

একদিকে প্রত্যক্ষ অ্যাক্টিভিজমের ময়দানে সরাসরি নেতৃত্ব দেওয়া, অন্যদিকে বহু সংখ্যক আশ্রিত ছাত্রছাত্রীদের পালনপোষোন-শিক্ষার কাজ দেখভাল করা — এই দুইয়ের মাঝেও সাবিত্রীবাই লেখালেখি ও সংকলন-সম্পাদনার কাজ চালিয়ে গেছেন। বস্তুত সাবিত্রীবাইকে আধুনিক মারাঠি কবিতার জননী হিসেবে গণ্য করা হয়। ১৮৫৪ সালে প্রকাশিত ‘কাব্য ফুলে’ সম্ভবত ব্রিটিশ ভারতে কোন ভারতীয়র লেখা প্রথম মুদ্রিত কাব্যগ্রন্থ। কবিতাগুলি সমাজে বিদ্যমান বৈষম্যের উন্মোচন ও দরিদ্র নিপীড়িত দলিত মানুষের প্রতি আহ্বান,

জাগো, ওঠো, এবং শিক্ষিত হও
নিজেকে মুক্ত কর — ঐতিহ্য-প্রথা গুঁড়িয়ে দাও!

১৮৯৭-এ প্লেগ মহামারির রোগিদের সেবা করতে গিয়ে রোগ সংক্রমিত হয়ে ১০ মার্চ এই মহিয়সী নারী মৃত্যুবরণ করেন। সাবিত্রীবাই ফুলে উনবিংশ শতকের সেই ব্যতিক্রমী সমাজবিপ্লবী যিনি জাতবর্ণের প্রশ্নকে পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোর সাথে যুক্ত করে বুঝেছিলেন। বাবাসাহেব ভীমরাও আম্বেদকর বুদ্ধ-কবীর-ফুলে ত্রয়ীকে তাঁর জীবনের শিক্ষক ও অনুপ্রেরণা বলে বারবার উল্লেখ করেছেন এবং জাতের বিনাশ ও নারীস্বাধীনতার প্রশ্নকে অবিচ্ছেদ্য বিষয় বলে তাঁর সমস্ত লেখাপত্রে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন। বাস্তবেও ভারতে ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে যে কোনও উত্থানেই নারীসমাজ উৎসাহভরে সামনের সারিতে থেকেছে এবং শ্রেণীসংগ্রামের দিগন্ত প্রসারিত করেছে।

– মলয় তেওয়ারী     

খণ্ড-27
সংখ্যা-46