আজাদী: ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্তির সন্ধান
az

আজাদী। মূল পারসিয়ান বা ফারসি ভাষা থেকে উৎসারিত এই শব্দটি আজ ভারতের অধিকাংশ ভাষাতেই যথেষ্ট পরিচিত ও ব্যবহৃত। অনেকটা ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগানের মতো। আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রগতির সাক্ষ্য হিসেবে বিগত একশ বছর ধরে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় ছড়িয়ে গিয়েছে এই ধ্বনি। প্রতিবাদের ভাষা, প্রত্যয়ের ছন্দ।

এখানে যে আজাদী নিয়ে আমরা আলোচনা করব তা কিন্তু একটি ইংরেজী বইয়ের শিরোনাম। অরুন্ধতী রায়ের সাম্প্রতিকতম রচনা সংকলন ‘AZADI’। ২০১৮ সালের মাঝামাঝি থেকে কোভিড-কবলিত ২০২০ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে ন’টি ভাষণ, বিবৃতি বা রচনার সংকলন হিসেবে এই ভাষ্য আমরা হাতে পেয়েছি। ‘আজাদী’ শিরোনামের নীচে রয়েছে তিনটি উপশিরোনাম – ফ্রীডম, ফ্যাসিজম, ফিকশন। এই তিনটি শব্দ একটি বাক্যে সম্মিলিত করে বলা যায় – ফিকশন দ্যাট গ্রোজ ফ্রম দ্য ফাইট ফর ফ্রীডম ফ্রম ফ্যাসিজম। ফ্যাসিবাদ থেকে আজাদী বা স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রাম থেকে উঠে আসা রচনা।

অরুন্ধতীর সঙ্গে অধিকাংশ পাঠকেরই প্রথম পরিচয় বিগত শতাব্দীর শেষ প্রান্তে তাঁর আলোড়ন সৃষ্টিকারী উপন্যাস ‘দ্য গড অফ স্মল থিংগস’-এর মাধ্যমে। পরবর্তী উপন্যাস ‘দ্য মিনিস্ট্রি অফ আটমোস্ট হ্যাপিনেস’-এর জন্ম ঠিক দু-দশক পরে ২০১৭ সালে। এই দীর্ঘ অন্তরাল পর্বে আমরা পেয়েছি প্রাবন্ধিক অরুন্ধতী রায়কে। ক্ষুরধার বিশ্লেষণ ও সুগভীর অন্তর্দৃষ্টিতে সমৃদ্ধ এই রচনাসম্ভারও সম্প্রতি আর একটি সংকলন হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে ‘মাই সিডিশাস হার্ট’। ‘আমার বিদ্রোহী হৃদয়’।

আজাদী সংকলনটি একই সাথে ঔপন্যাসিক ও প্রাবন্ধিক অরুন্ধতী রায়ের রচনাযাত্রার এক আত্মজৈবনিক ধারাভাষ্য। উপন্যাস ও প্রবন্ধসাহিত্য – ইংরেজীতে ফিকশন ও নন-ফিকশন – এই দুই পায়েই অরুন্ধতী হেঁটে যেতে চান, দুয়ের সমন্বয়েই গড়ে উঠেছে তাঁর রচনার ভাষা ও ছন্দ। তিনি এই সমন্বয়ে সিদ্ধহস্ত হলেও তাঁর পাঠকবর্গের একাংশের কাছে এ এক সংঘাত। হায়দ্রাবাদের এক আলোচনাসভার কথা উল্লেখ করে অরুন্ধতী আমাদের জানিয়েছেন সেই অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা যখন তাঁর দুপাশে উপবিষ্ট দুই বিদগ্ধ বিশ্লেষক একই সময়ে তাঁকে দু’রকম পরামর্শ দিচ্ছিলেন। একজন বলছিলেন উপন্যাস ছেড়ে প্রবন্ধসাহিত্যে আরও মনোযোগ দিতে, অন্য জনের কাছে ছিল প্রবন্ধ রচনায় সময় অপব্যয় না করে প্রকৃত সাহিত্যে মনোনিবেশ করার উপদেশ। অরুন্ধতীর কাছে উপন্যাস ও প্রবন্ধসাহিত্যের এই সমন্বয়ের মূলে রয়েছে তাঁর মুক্তিকামী চেতনা, প্রতিবাদী সত্তা যার মূল কথা বর্তমান পর্যায়ে ফাসিবাদ থেকে স্বাধীনতা। আজাদী।

অরুন্ধতী এই আজাদী শব্দকে মূলত কাশ্মীরী জনগণের মনের কথা হিসেবেই তুলে ধরেছেন। ব্রিটিশ শাসন থেকে দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করা একটি দেশ কীভাবে কাশ্মীরী জনগণের স্বাধীনতার আকাঙ্খার প্রতি এত উদাসীন হতে পারে বা এমন নিষ্ঠুর দমনের পক্ষে দাঁড়িয়ে যেতে পারে এই ধাঁধা তাঁকে ভাবিয়ে তোলে। তিনি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন অসমাপ্ত দেশভাগের অ্যাজেণ্ডাকে সমাপ্ত করার সঙ্গে কাশ্মীরের কোনো ঐতিহাসিক যোগাযোগ নেই। কাশ্মীর ব্রিটিশ ভারতের অঙ্গ ছিল না, পরবর্তী পর্যায়ে ভারতের সঙ্গে একীকরণের প্রশ্নে উদ্ভুত সমস্যাই ঐতিহাসিকভাবে কাশ্মীর প্রশ্ন। সমস্যাটা বিভাজনকে ঘিরে নয়, জোর করে একীকরণ করার ক্রমবর্ধমান সামরিক প্রক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া হিসেবেই আজ কাশ্মীর পরিস্থিতি এত জটিল ও সংঘাতপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আর এই সমস্যার মানবিক ও গণতান্ত্রিক সমাধান না হলে তা গোটা ভারতবর্ষকে এক বৃহত্তর কাশ্মীরে পরিণত করবে। কোভিড পরবর্তী নিষ্ঠুর লকডাউন ও উত্তরপ্রদেশের মতো বড় রাজ্যে ও দিল্লী রাজধানীর বুকে পুলিশী তাণ্ডবের ক্রমবর্ধমান ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ দ্রুত ভারতীয় গণতন্ত্রকে এই বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে।

কাশ্মীরের লক্ষ লক্ষ মানুষকে আইনী প্রতারণা ও সামরিক পরিবেষ্টনের বেড়াজালে আটকে রাখা আর অসমের মতো রাজ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষকে নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করে নিজের দেশে পরবাসী করে ফেলা, একই রাষ্ট্রের দুই নির্মম আগ্রাসী অভিযান। বর্তমান সংকলনে অরুন্ধতীর বিভিন্ন রচনায়, বিশেষ করে ১৯ নভেম্বর ২০১৯ নিউইয়র্কের ক্যুপার ইউনিয়ন গ্রেট হলে প্রদত্ত ভাষণে (ইনটিমেশনস অফ অ্যান এণ্ডিং: দ্য রাইজ অ্যাণ্ড রাইজ অফ দ্য হিন্দু নেশন) কাশ্মীর ও অসম প্রসঙ্গ খুবই তথ্যনিষ্ঠভাবে আলোচিত হয়েছে। সংবিধানের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদকে অকেজো করে দিয়ে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের যাবতীয় সংবিধানিক অধিকার কেড়ে নেওয়া এবং বাংলাদেশী অনুপ্রবেশের আতঙ্ক ও প্রতিবেশী দেশে হিন্দু নির্যাতনের প্রশ্নকে সামনে রেখে এনআরসি-এনপিআর ও নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের মাধ্যমে নাগরিকত্বের পরিভাষাকে বদলে দেওয়া – এ’দুটি পদক্ষেপই হিন্দুরাষ্ট্রের লক্ষ্যের অভিমুখে আরএসএস-এর ঐতিহাসিক অভিযানের দুই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। রাষ্ট্রের চরিত্র বদলে দাও, জাতি বা নেশনের সংজ্ঞা বদলে দাও, নাগরিকত্বের পরিভাষা বদলে দাও – এটাই তো আরএসএস ও সংঘ পরিবারের রণনৈতিক লক্ষ্য। আর আজ ক্ষমতার ভারসাম্যকে নিজের পক্ষে ঝুঁকিয়ে নিয়ে এক এক করে এই অভীষ্ট সিদ্ধ করার পথে পা বাড়িয়েছে মোদী-শাহ-যোগীর বিজেপি জমানা।

ভারতের বর্তমান এই রাজনৈতিক পর্যায়কে অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় ফ্যাসিবাদের উত্থান হিসেবে চিহ্নিত করেছেন অরুন্ধতী রায়। রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করে গণতন্ত্র ও মানবতার নিধন যজ্ঞে মেতে ওঠাটাই ফ্যাসিবাদের নীল নকশা। কিন্তু শুধুমাত্র এই ধ্বংসের তাণ্ডবলীলার তীব্রতা দিয়ে ফ্যাসিবাদকে চিনতে গেলে অনেক দেরী হয়ে যাবে। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ইউরোপীয় ফ্যাসিবাদের অভিজ্ঞতালব্ধ ইতিহাস চেতনা যদি আমাদের থাকে তাহলে আজকের মোদী-শাহ-যোগী জমানার অ্যাজেণ্ডা ও রাজনৈতিক চরিত্র সম্পর্কে বিতর্কের কোনোই অবকাশ থাকতে পারে না। মোদী সরকারের বিভিন্ন নীতি ও পদক্ষেপ থেকে যেমন এই ফ্যাসিবাদকে চেনা যায় ততটাই গুরুত্বপূর্ণ হল আরএসএস-কে চেনা ও বোঝা।

মনে রাখা দরকার ইউরোপে ফ্যাসিবাদের জন্মলগ্নেই ভারতে আরএসএস-এর জন্ম এবং এটা ইতিহাসের কোনো কাকতালীয় সমাপতন নয়। অনেক দিক থেকেই ইউরোপীয় ফ্যাসিবাদের (ইটালিতে মুসোলিনী ও জার্মানীতে হিটলার) অনুপ্রেরণায় ও আদলে ভারতে আরএসএস-এর যাত্রা শুরু হয়। ইউরোপে সেই ফ্যাসিবাদ দ্রুত রাষ্ট্রক্ষমতায় চলে আসে, তার বিধ্বংসী তাণ্ডবের কথা স্মরণ করে আজও পৃথিবী শিউরে ওঠে। ভারতে আরএসএস-কে দীর্ঘদিন অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে। স্বাধীনতা আন্দোলনের পর্যায়ে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ও দেশভাগের দুঃস্বপ্নের মাঝেও আরএসএস-কে দেশের মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন এক প্রান্তিক শক্তি হিসেবেই থাকতে হয়েছে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই গান্ধীহত্যার কলঙ্ক নিয়ে নিষিদ্ধ অবস্থায় কোণঠাসা হতে হয়েছে। কিন্তু আরএসএস-এর ধারাবাহিকতায় কখনও কোনো ছেদ পড়েনি।

স্বাধীনতা পর্যায়ের বিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে আসএসএস ধীরে ধীরে শুধু তৃণমূল স্তরে সংগঠন বিস্তার করেনি, রাষ্ট্রক্ষমতায়, নিভিন্ন নীতিনির্ধারক সংস্থায় এবং জনমত সংগঠিত ও প্রভাবিত করার বিভিন্ন মাধ্যমে ধীরে ধীরে তার অনুপ্রবেশ বাড়িয়েছে। ভারত-চীন যুদ্ধের অব্যবহিত পরে প্রজাতন্ত্র দিবসের প্যারেডে আরএসএস-এর অংশগ্রহণের মাধ্যমে নেহেরু আমলের শেষপর্যায়েই দেশের তথাকথিত মূল স্রোতে সংঘ পরিবারের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল। সাতাত্তরে জনতা পার্টিতে জনসংঘের বিলয়ের মাধ্যমে কেন্দ্র সরকারে সরাসরি অংশগ্রণের সুযোগ পেয়ে যায় আরএসএস। পরবর্তীতে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থন দিয়ে ও নব্বইয়ের দশকের শেষ পর্যায়ে রামমন্দির, ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ বা ইউনিফর্ম সিভিল কোডের মতো ইতিমধ্যেই চিহ্নিত বিতর্কিত প্রশ্নগুলিকে স্থগিত রেখে মোর্চা গঠনের মাধ্যমে বাজপেয়ী জমানার সূত্রপাত – এভাবে আরএসএস ক্রমাগত শক্তি সঞ্চয় ও প্রভাব বিস্তার করে গেছে।

২০১৪ সালে তারা পেয়ে যায় সুবর্ণ সুযোগ। দশ বছরের ইউপিএ শাসনের পর ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি, দুর্বল প্রধানমন্ত্রী ও দুর্বল সরকারের অভিযোগতুলে শক্তিশালী নেতা, শক্তিশালী সরকারের ধ্বজা উঁচিয়ে নরেন্দ্র মোদী ও তথাকথিত গুজরাট মডেলকে সামনে রেখে বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় চলে আসে আরএসএস। ক্ষমতায় এসে কিছুদিন আচ্ছে দিন, স্বচ্ছ অর্থনীতি, স্বচ্ছ ভারতের কথা বলে কেন্দ্রে ও বেশ কয়েকটি রাজ্যে শক্তি সংহত করে নিয়ে আরএসএস তার সমগ্র অ্যাজেণ্ডাকে দ্রুত প্রকাশ্যে আনতে ও চাপিয়ে দিতে শুরু করে। একদিকে ভীড় হিংসার মাধ্যমে গোটা দেশ জুড়ে আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করা, অন্যদিকে রাষ্ট্রক্ষমতা ও প্রশাসনের উত্তরোত্তর কেন্দ্রীকরণের মধ্য দিয়ে আইন কানুন, অর্থব্যবস্থা ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশ সবকিছু ওলট পালট করে ফেলা – মোদী রাজত্বে আজ এমনই এক দক্ষযজ্ঞের মধ্যে আমরা রয়েছি। সংবিধানসম্মত আইনের শাসনের বদলে শিবঠাকুরের আপন দেশের সর্বনেশে আইন-কানুন আমাদের ঘিরে ফেলেছে। অরুন্ধতীর ভাষায় আরএসএস-ই হয়ে উঠেছে আজ রাষ্ট্র। নিছক অনুপ্রবেশ নয়, সমান্তরাল ব্যবস্থা নয়, আরএসএস নির্দেশিত রাষ্ট্রব্যবস্থা। হিটলারী জমানার গ্যাসচেম্বার ও বিশ্বযুদ্ধ বাদ দিলে ভারতীয় ফ্যাসিবাদের মোদী মডেল বা আরএসএস ঘরানায় অন্য কোনো উপাদানেরই ঘাটতি নেই।

ভারতীয় ফ্যাসিবাদ ও ইটালি বা জার্মানীর ইউরোপীয় ফ্যাসিবাদের তুলনামূলক অধ্যয়নে সাদৃশ্যের পাশাপাশি বহু বৈসাদৃশ্য স্বাভাবিকভাবেই চোখে পড়বে। মুসোলিনী ও হিটলার জমানা থেকে মোদী আর ট্রাম্পের জমানা প্রযুক্তিগতভাবে সম্পূর্ণ অন্য স্তরে পৌঁছে গেছে। বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তির যুগান্তকারী পরিবর্তন রাষ্ট্রকে সাধারণভাবেই এক দৈত্যকায় পাহারাদারে পরিণত করেছে। নাগরিক জীবনে গোপনীয়তা ও ব্যক্তিস্বাধীনতার পরিসর ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে, বিপরীতে রাষ্ট্রের উপর নাগরিক সমাজ বা নির্বাচকমণ্ডলীর গণতান্ত্রিক নজরদারি বা নিয়ন্ত্রণ ছেঁড়া কাগজে পরিণত হচ্ছে। আমেরিকায় নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর ট্রাম্পবাহিনী যেভাবে নির্বাচনী ফলাফলকে মানতে ও ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকার করছে বা ভারতে বিজেপি যেভাবে একের পর এক রাজ্যে বিধায়কদের কিনে নিয়ে বিরোধী দল শাসিত সরকারকে ভেঙে দিচ্ছে বা সংসদে বিনা ভোটেই জোর করে আইন পাশ করিয়ে নিচ্ছে তাতে সংসদীয় গণতান্ত্রিক প্রণালী সাধারণভাবেই এক গভীর সংকটের মুখে।

অর্থনীতির চূড়ান্ত বেসরকারীকরণের সাথে সাথে রাজনীতি ও শাসনব্যবস্থারও বেসরকারীকরণের বিরাট চাপের মুখে পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের গোটা কাঠামো আজ টলায়মান। কোভিড অতিমারী এবং বর্ণবিদ্বেষী স্বৈরতান্ত্রিক ট্রাম্প শাসনে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এবং তথাকথিত প্রাচীনতম গণতন্ত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আজ গভীর সংকটে। গণতন্ত্র রপ্তানির নামে যে দেশ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন সময়ে যুদ্ধ, সামরিক অভ্যুত্থান ও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র রপ্তানি করে এসেছে আজ সেদেশ নিজেই এক তীব্র দক্ষিণপন্থী অভ্যুত্থানের মুখে।

ভারতে ফ্যাসিবাদের উত্থানের বর্তমান পর্যায়ে আজকের এই আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটের অবশ্যই সুস্পষ্ট ছাপ রয়েছে। কিন্তু আরএসএস-এর প্রায় এক শতাব্দী দীর্ঘ ইতিহাসকে বাদ দিয়ে যেমন আজকের এই সময়কে ভারতের নির্দিষ্ট পরিপ্রেক্ষিতে মোটেই চেনা যাবে না, তেমনি ভারতের সামাজিক ইতিহাস ও সমাজব্যবস্থার নির্দিষ্ট প্রসঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্নভাবেও ভারতীয় গণতন্ত্রের আজকের এই গভীর অসুখকে বোঝা যাবে না। অরুন্ধতী তাঁর রচনায় বারবার আমাদের সেই অসুখের উৎসে নিয়ে যান। এই রোগের নাম কাস্ট। হিন্দীতে জাতি, আর বাংলায় এই রোগের কথা সেভাবে গুরুত্ব পায়নি বলেই বোধকরি বাংলায় এর জন্য নির্দিষ্ট কোনো শব্দই নেই। বাংলায় জাতি বলতে আমরা বুঝি নেশন আর কাস্টের সমার্থক হিসেবে আমরা যথেষ্ট উন্নাসিকতা ও উপেক্ষার সঙ্গে বলে থাকি ‘জাতপাত’। কিন্তু জাতি বা কাস্ট সম্পর্কে এই নীরবতা শুধু বাংলা ভাষার ব্যাপার নয়, আমাদের ইতিহাসবোধ বা সমাজ চেতনার এ এক জটিল চারিত্রিক সমস্যা। এর ফলে আজাদী বা স্বাধীনতা সম্পর্কে আমাদের বোধও গভীরভাবে অসম্পূর্ণ ও খণ্ডিত হয়ে থেকেছে।

স্বাধীনতা আন্দোলন বলতে আমরা শুধু ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির আন্দোলনকে বোঝাই, ভারতীয় সমাজের অভ্যন্তরে সামাজিক দাসত্ব (মহাত্মা ফুলের শব্দ) থেকে মুক্তি সংগ্রামের কথা মাথায় রাখিনা। স্বাধীনতা বলতে আমরা স্বাধীন সার্বভৌম দেশের কথা বোঝাই, স্বাধীন নাগরিক বুঝিনা। স্বাধীনতা সংগ্রামী বলতে আমরা গান্ধী-নেহেরু-সুভাষ বোস থেকে শুরু করে ভগৎ সিং, চন্দ্রশেখর আজাদ, ক্ষুদিরাম, মাস্টারদা, বিনয়-বাদন-দীনেশ, বাঘা যতীন অনেকের নামই নিই, কিন্তু ভুল করেও আম্বেদকারের নাম নিই না, সাবিত্রীবাই ফুলের নাম নিই না, বিরসা মুণ্ডা বা এমনকি বিদ্যাসাগরকেও ভুলে বসে থাকি। এর কারণ হল সামাজিক দাসত্ব থেকে মুক্তির অত্যন্ত বুনিয়াদী প্রশ্নটি আমাদের সাধারণ ইতিহাসবোধে স্বাধীনতার প্রশ্ন হয়ে ওঠেনি। অর্থাৎ যে সামাজিক দাসত্ব থেকে মুক্তি, সমাজের এক বড় নিপীড়িত অংশের কাছে মানবিক মর্যাদা বা মানবাধিকার অর্জনের গোড়ার কথা, ঐতিহাসিকভাবে এই দাসত্বের যাঁরা প্রত্যক্ষ ভুক্তভোগী নন এবং সেই অর্থে যাঁদের সুবিধাভোগী বা প্রিভিলেজড বলা যায়, তাঁদের কাছে এটা মোটেই ততটা কেন্দ্রীয় প্রশ্ন নয়। শ্রমিক-কৃষক খেটে খাওয়া মানুষের অধিকারের প্রশ্নের মতো দলিত জনগণের মুক্তি, আদিবাসী জনগণের মর্যাদা, নারী স্বাধীনতার প্রশ্নও ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল প্রশ্ন হয়ে ওঠেনি।

আম্বেদকার বলেছিলেন কাস্ট বা জাতের সঙ্গে কোনোরকম সহাবস্থান সম্ভব নয়। নজরুলের কথাকে একটু ঘুরিয়ে বললে জাতের নামে বজ্জাতি শুধু নয়, জাতের মানেই বজ্জাতি। কাস্টকে তিনি চিহ্নিত করেছিলেন নেশন গঠনের প্রশ্নে সবচেয়ে বড় অবরোধ বা এ্যান্টি-ন্যাশনাল শক্তি হিসেবে। আর তাই তিনি ডাক দিয়েছিলেন অ্যানাইহিলেশন অফ কাস্ট বা জাতি উন্মূলন বা জাতি বিনাশের। জাতি বিনাশের চেয়ে বড় আমূল পরিবর্তনের ডাক ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ভেতর থেকে কমই উঠে এসেছে। জাতি বিনাশের ডাক দেওয়া সেই আমন্ত্রিত ভাষণ আম্বেদকার দেওয়ার সুযোগ পাননি, ফলে ভাষণ প্রবন্ধ হিসেবেই প্রকাশ পায়। আম্বেদকারের এই আহ্বান ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে ইনকিলাব জিন্দাবাদ বা ইংরেজ ভারত ছাড়ো বা করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গের মতো গোটা স্বাধীনতা আন্দোলনের রণধ্বনি হয়ে ওঠা উচিত ছিল, কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য এমনকি আম্বেদকারবাদীদের অনেকেও এই বৈপ্লবিক আহ্বানের সঙ্গে পরিচিত নন। অরুন্ধতী আমাদের ভাবিয়েছেন কেন রিচার্ড অ্যাটেনবরোর গান্ধী ছবিতে আম্বেদকার অদ্ভুত ভাবে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত।

acvv

 

এই কাস্ট সিস্টেম বা জাতি ব্যবস্থাকে আম্বেদকার চিহ্নিত করেছেন সংগঠিত ও প্রাতিষ্ঠানিক হিন্দু ধর্মের মূল স্তম্ভ হিসেবে। অথচ এই জাতি ব্যবস্থার মূল কথা হল বংশপরম্পরায় সামাজিক বৈষম্য বজায় রাখা, তাকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে পরিণত করা। জন্মসূত্রে এমন একটা উঁচু আর নীচু ব্যবধানের বিধান তৈরি করে দেওয়া যেখানে নীচু থেকে উঁচুতে ওঠা যাবে না, বাইরে থেকে ভেতরে আসা যাবে না। সাম্য, স্বাধীনতা ও ভ্রাতৃত্ব বা মৈত্রীর নীতির উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে আমাদের সংবিধান, সেই সংবিধানের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে আমাদের আধুনিক গণতন্ত্র। অথচ ভারতের ব্যাপক জনগণ আটকে রয়েছেন এই জাতিব্যবস্থার মধ্যে যে জাতি ব্যবস্থা সাম্য, স্বাধীনতা ও মৈত্রীর ভিত্তির মূলেই কুঠারাঘাত করে।

আম্বেদকার তাই খোলাখুলি বলেছেন ভারতবর্ষ যদি কোনোদিন হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত হয় তবে তা হবে এ দেশের ব্যাপক জনগণের জন্য সবচেয়ে বড় বিপর্যয়। স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে সংবিধানের মাধ্যমে প্রাপ্ত গণতন্ত্র, মাটির উপরের পাতলা পরত, নীচে মাটিটা কিন্তু যথেষ্ট গণতন্ত্র বিরোধী। জাতির বিনাশের ডাক দেওয়ার পাশাপাশি তাকে বাস্তবায়িত করার কিছু সূত্র তিনি তাঁর রচনায় ও ব্যক্তিজীবনে তুলে ধরেছেন। জাতিকে বর্ণাশ্রম বলে শ্রম বিভাজনের বৈধতার মোড়কে নিছক উৎপাদনের পদ্ধতি হিসেবে বা শ্রমের ও জ্ঞানের বিশেষীকরণের নকশা হিসেবে দেখেননি, স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে জাতি শ্রম নয়, শ্রমিকের বিভাজন। তাই জাতিকে ভাঙতে হলে শ্রমিককে, শ্রমজীবী জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। জাতির সীমানা ধরে রাখা হয় জাতির ভেতরে বিবাহকে আবদ্ধ রেখে। তাই সেই সীমানা ভাঙার জন্য জাতির সীমানা পেরিয়ে জাতি বহির্ভূত বৈবাহিক বন্ধনের উপর জোর দিয়েছেন। জীবনের শেষপর্যায়ে এসে জাতিকে অস্বীকার করার জন্য ধর্ম পরিবর্তন করে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছেন।

জাতি বহির্ভূত বিবাহ হোক বা ধর্ম পরিবর্তন অথবা শ্রমজীবী জনগণের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার অধিকার – এসবই আম্বেদকারের নেতৃত্বে রচিত ভারতীয় সংবিধানে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। আমরা সংরক্ষণের জন্যই সবচেয়ে বেশি আম্বেদকারকে স্মরণে রেখেছি, অথচ আম্বেদকারের কাছে সংরক্ষণ ছিল, সামাজিক বৈষম্যকে প্রশমিত করার এক প্রয়োজনীয় আশু পদক্ষেপ, জাতিকে সমূলে নাশ করার কোনো বৈপ্লবিক পদক্ষেপ নয়। আজ অবশ্য সংরক্ষণ থেকে শুরু করে সংবিধানের সমস্ত অধিকারগুলিই আক্রান্ত ও বিপন্ন। লাভ জেহাদ নিরোধক আইনের নামে ধর্ম পরিবর্তন ও নিজের পচ্ছন্দমতো জীবনসঙ্গী বেছে নেওয়ার অধিকার, দুইয়ের ওপরেই কুৎসিত আক্রমণ নামিয়ে আনা হচ্ছে। আজ ধর্মবহিভূত বিবাহে নিষেধাজ্ঞা, আগামীদিনে দ্রুতই নেমে আসবে জাতিবহির্ভূত বিবাহের উপর নিষেধাজ্ঞা, (খাপ পঞ্চায়েত ও তথাকথিত ‘অনার কিলিং’-এর মাধ্যমে সামাজিক নিষেধাজ্ঞা বলবৎ করার চেষ্টা অনবরতই চলছে) এবং পরিবারের স্বীকৃতি বা ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিবাহের উপর নিষেধাজ্ঞা।

জাতি, শ্রেণী ও লিঙ্গের টানাপোড়েনের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে ভারতীয় সমাজে বৈষম্য ও নিপীড়নের ঠাসবুনট। সংবিধানের মাধ্যমে প্রাপ্ত গণতন্ত্রের উপরি পরত সেই বুনটকে কিছুটা দুর্বল করলেও আজ ফ্যাসিবাদী মতাদর্শে ও নেতৃত্বে পরিচালিত ভারতীয় রাষ্ট্র আবার সেই ঠাসবুনটের মধ্যে সমাজকে আটকে রাখতে চাইছে। গেটেড কমিউনিটির মতো এক রেজিমেন্টেড সমাজ যেখানে সরকার বিরোধিতার মানেই দেশদ্রোহ এবং বিজেপি’র বিরুদ্ধে কথা বলার মানেই হিন্দুবিরোধিতার তকমা গায়ে লাগিয়ে নেওয়া।

ডেনমার্কে নির্বাসনে থাকা অবস্থায় জার্মান কবি ও নাট্যকার বের্টোল্ট ব্রেখট লিখেছিলেন “In the dark times will there also be singing? Yes, there will be singing. About the dark times”। হিটলারী জমানার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের ভাষা এভাবেই ছড়িয়ে পড়েছে সময় ও দেশের সীমানা পেরিয়ে, ফ্যাসিবাদী নিষেধাজ্ঞা ও নীল নকশাকে অগ্রাহ্য করে। অরুন্ধতী এখনও নির্বাসিত নন, যদিও মোদী জমানার আগমনের আগে থেকেই আদালত অবমাননার পুরস্কার তাঁর ভাণ্ডারে জমা হতে শুরু করেছে। দাভোলকার, পানসারে, কালবুর্গী, গৌরী লঙ্কেশদের জীবন থেকে নির্বাসিত করা হয়েছে, আনন্দ তেলতুম্বরে ও ভারভারা রাওদের জেলে পুরে দেওয়া হয়েছে, সোস্যাল মিডিয়া ও গোদী মিডিয়াতে প্রতিদিন রাশি রাশি ঘৃণা উগরে দেওয়া হচ্ছে সত্য কথা সরাসরি সহজভাবে বলার স্পর্ধার বিরুদ্ধে। সেই সমস্ত শিল্পী, গায়ক, অভিনেতা ও হাস্যরস পরিবেশকদের বিরুদ্ধে যাঁরা আচ্ছে দিনের অন্ধকারে মব লিঞ্চিং বাহিনীর ফতোয়াকে উপেক্ষা করে ভালোবাসার ও মানবতার কথা বলার অভ্যাসটাকে ধরে রেখেছেন। যাঁরা হাল ছাড়েননি।

ট্রাম্পের ভারত সফর ও দিল্লীতে সংগঠিত সাম্প্রদায়িক হিংসার ঠিক অব্যবহিত পরেই সিএএ-এনপিআর-এনআরসি বিরোধী লেখক শিল্পীদের এক সর্বভারতীয় কনভেনশনে সেই হাল না ছাড়া প্রতিরোধের বার্তা শুনিয়েছেন অরুন্ধতী। বলেছেন ভারতে গণতন্ত্র যখন কোভিড১৯-এর মতো গভীর অসুখে আক্রান্ত তখন আমাদের ঝুঁকি নেওয়ার সাহস চাই, সত্যি কথা বলার প্রস্তুতি চাই। সাহসী সাংবাদিক, সাহসী আইনজীবী, সাহসী লেখক, কবি, সঙ্গীতশিল্পী, চিত্রশিল্পী, চলচ্চিত্রশিল্পী – সাহসের সৌন্দর্য আজ আমাদের চাই। আজাদী সংকলনের ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে রয়েছে সেই সাহসের সৌন্দর্য। ২০১৯এর নির্বাচনের আগে তাঁর রচনায় আমরা মোদী জমানা থেকে নির্বাচনী মুক্তিলাভের তীব্র আবেদন ও আশার অনুরণন শুনেছি। সেই আশার বিপরীতে ২০১৯এর নির্বাচনে মোদী জমানার দ্বিতীয় দফা শুরু হয়, ফ্যাসিবাদের নগ্ন চেহারা পরিণত হয় দৈনন্দিন বাস্তবতায়। এই বিপরীত পরিস্থিতিতেও অরুন্ধতীর রচনায় কিন্তু কোন হতাশা ও ক্লান্তির ছোঁয়া নেই। তার বিপরীতে ধ্বনিত হয়েছে দীর্ঘমেয়াদী প্রতিরোধের ধৈর্য্য ও প্রত্যয়। ফ্যাসিবাদী শাসকের বিরুদ্ধে সত্যি কথা বলার সুন্দর সাহস এবং সেই সাহসে অটল থাকার শান্ত প্রতিজ্ঞায় দৃপ্ত অরুন্ধতীর এই প্রতিবাদের ভাষা প্রতিরোধের আগুন হয়ে দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ুক।

- দীপঙ্কর ভট্টাচার্য  

খণ্ড-28
সংখ্যা-2