প্রতিবেদন
ফ্যাসিবাদী ছকবাজি এখন শেষ পর্বের মাঝামাঝি
fff

ঘুমটা বোধহয় ভেঙেছে, কিন্তু দুঃস্বপ্নের ঘোরটা এখনও কাটেনি। জন্তুটা কী ধরনের তাও বোঝা যায়নি। এমনকি সে এখন জন্তুটার পেটের ভেতরে না বাইরে তাও বুঝে উঠতে পারেনি। জল খেয়েও তার অস্বস্তি গেল না, তাই মাঝরাতেই সে তার বন্ধুকে ফোন করলো।

বন্ধু বললো, “চিন্তা করিস না। এই অদেখা জন্তুটা আমাদের চারপাশের দূষিত হাওয়ার মতো। এর মধ্যেই নিঃশ্বাস নিতে যেমন আমরা অভ্যস্ত হয়ে যাই, তেমনই জন্তুটার শরীরের মধ্যেই তুই অভ্যস্ত হয়ে যাবি।”

আসলে ফ্যাসিবাদ আসে দূষিত হাওয়ার মতোই। সে যে কত ক্ষতি করতে পারে তার খানিকটা আভাস হয়তো প্রথম প্রথম পাওয়া যায় কিন্তু ততদিনে শেষের দিন গোনা শুরু হয়ে গিয়েছে – আমরা তখন ফ্যাসিবাদ নামক জন্তুর পেটে। তাই কিছু আগে থেকেই ফ্যাসিবাদের লক্ষণগুলি চিনে নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ।

দার্শনিক প্লেটো বলেছিলেন, বাস্তবে কোন কিছুই নিখুঁত নয়। একটা নিখুঁত বৃত্ত কিংবা নিখুঁত গণতন্ত্র কোনোটাই বাস্তবে দেখা যায় না। কিন্তু তেমনই বইতে পড়া ফ্যাসিবাদও নিখুঁত আকারে আসে না। কিন্তু আমরা যদি প্রস্তুত থাকি তবে তার কিছু কিছু লক্ষণ দেখে আগে থেকে আন্দাজ করা যায় যে ফ্যাসিবাদী শক্তি থাবা গেড়ে বসতে চলেছে। যেমন বইতে পড়া নিখুঁত গণতন্ত্র বাস্তবে দেখা যায় না, ঠিক তেমনই, যে ফ্যাসিবাদ বাস্তবে আসে তা কোনো বইতে পড়া নিখুঁত তাত্ত্বিক ধারণাগুলির সঙ্গে পুরোপুরি মেলে না।

তাই আগে থেকেই চিনে নেওয়া দরকার ফ্যাসিবাদের সেই রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক লক্ষণগুলি এবং তাদের পরস্পরের সম্পর্ক।

রাজনৈতিক লক্ষণ

‘শত্রু’র বিরুদ্ধে দেশরক্ষার রাজনৈতিক হুঙ্কার সম্ভবত ফ্যাসিবাদের সবথেকে বড় লক্ষণ। উগ্র জাতীয়তাবাদকে সামনে রেখে রাষ্ট্রের শক্তি প্রদর্শন-এর এক অতি পরিচিত বৈশিষ্ট্য। শত্রুর বিরুদ্ধে দেশরক্ষার বাহানা ফ্যাসিবাদের পক্ষে বিশেষভাবে সুবিধাজনক হয় যদি ঘরে বাইরে একই শত্রু আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, এটা লোকেদের পাখিপড়া করে বুঝিয়ে দেওয়া যায়। ফ্যাসিবাদের প্রধান চালিকাশক্তি যে গণউন্মাদনা তা জোরদার করতে দেশের ভেতরেও দেশরক্ষার নামে যত ইচ্ছা দমননীতি চালানো যায় আর বাইরের শত্রুর বিরুদ্ধে একটা ‘যুদ্ধং দেহি’ মার্কা উগ্র জাতীয়তাবাদ প্রদর্শন করাও যায় – এ যেন এক ঢিলে দুই পাখি মারা! লোকেরা অন্ধভাবে নেতাকে অনুসরণ করতে শুরু করে কারণ তাদের বোঝানো হয় যে একটা যুদ্ধের মতো পরস্থিতির উদ্ভব হয়েছে; আর এখনই না হলেও হতেই বা কতক্ষণ! গণতান্ত্রিক আন্দোলন থিতিয়ে দেওয়ার এ এক চমৎকার উপায়। ছোটখাটো বিষয় নিয়ে বিতর্ক-বিবাদের সময় যে এটা নয়, তাও লোকেরা মেনে নেয়। বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতি, নাগরিকত্বের অধিকার নিয়ে আন্দোলন, পরিবেশ দূষণ বা বিপুল ব্যাঙ্ক জালিয়াতির মতো ছোটখাটো সমস্যা সমাধানের পথ খোঁজার কাজ ভবিষ্যতের জন্য মুলতুবি রেখে এখন প্রয়োজন নেতার অন্ধ অনুসরণ। হয়তো যুদ্ধ এখনই হবে না, কিন্তু দেশকে তো প্রস্তুত থাকতেই হবে! সরকার বিশেষভাবে যুদ্ধে শহীদ হওয়া সেনাদের বীরত্বের কথা অবিমিশ্র শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে বলেন। এই সময় ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে উত্তেজিত হওয়া সরকারের মতে দেশদ্রোহ। তার বদলে শহীদদের বীরত্বে আর দেশভক্তিতে অভিভূত হওয়া দেশপ্রেমের মাপকাঠি হয়ে পড়ে।

সামাজিক লক্ষণ

যখন রাষ্ট্রের কাছে রাজনীতি মানে প্রবল জাতীয়তাবাদ, যখন সে ঘরে-বাইরের শত্রুদের বিরুদ্ধে দেশের সুরক্ষার নামে যুদ্ধ-পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে ব্যস্ত আর দাবি করে যে ঘরে-বাইরের শত্রুর বিরুদ্ধে দেশপ্রেম দেখানো দেশের মানুষের প্রধান কর্তব্য, তখন বুঝতে হবে যে রাষ্ট্র ফ্যাসিবাদের রাস্তায় হাঁটছে। আর এই ফ্যাসিবাদী প্রবণতা আরও দ্রুত ছড়িয়ে দেওয়া যায় যদি ধর্মীয়, জাতিগতভাবে বা ভিন্ন সংস্কৃতির সংখ্যালঘুদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করতে পারা যায়। ফ্যাসিবাদ বেড়ে ওঠার জন্য দরকার এসবের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যারা জাতীয় ঐক্য সম্বন্ধে অন্য মত পোষণ করেন তাদের রাষ্ট্রের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা। দরকার হলে লেলিয়ে দেওয়া বুলডগের মতো কিছু নিরূপায় লোকের লিঞ্চিং, যা সরকার নীরব দর্শকের হয়ে দেখবে।

প্রাচীন লোকাচার, সব আধুনিকতা-বিরোধী ধর্মানুষ্ঠান আর কিংবদন্তির লোককথাই হল দেশের গৌরবময় অতীত, সেটাই সত্যিকারের ইতিহাস – এমন একটা ধারনাকে প্রতিষ্ঠিত করা, ফ্যাসিবাদ জোরদার করার জন্য বিশেষভাবে দরকার। কিন্তু এর থেকে এক ধরনের সামাজিক অসঙ্গতি ক্রমশই প্রকট হয়ে ওঠে কারণ ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রশক্তির বিস্তার আধুনিক সামরিক প্রযুক্তি ও ডিজিটাল যুগের প্রচারযন্ত্র ছাড়া সম্ভব নয়। কিন্তু তার সঙ্গে জাতি-ধর্ম-লিঙ্গ-গোষ্ঠীভিত্তিক আধুনিকতা বিরোধী চেষ্টা মেলানো সহজ নয়। আর এই অস্বস্তিজনক সহাবস্থানই ফ্যাসিবাদকে ঠিকভাবে চিনিয়ে দেয়। যতই এই অসঙ্গতি প্রকট হয় ফ্যাসিবাদের ধোঁকাবাজি চেহারাটা ততই যেন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যেমন ধরুন একজন সাধারণ মানুষের ধাঁধা লাগাই স্বাভাবিক যখন সে কোনো রাজনৈতিক নেতার কোনো অত্যাধুনিক যুদ্ধাস্ত্রকে ফুল-মালা দিয়ে পুজো করার ছবি দেখে অথবা শোনে আর এক নেতা একদল নামকরা বৈজ্ঞানিকদের বোঝাচ্ছেন যে গণেশের মাথায় হাতির মুখ লাগানো আসলে আমাদের প্রাচীন শল্যচিকিৎসার অসম্ভব উন্নতির ‘ঐতিহাসিক’ সাবুদ। সাধারণ মানুষ এসব দেখে শুনে প্রাচীন স্বর্ণযুগের কল্পনার সঙ্গে ধর্ম নামক আফিমের মিশ্রনের মাদকতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। শুরু হয় ফ্যাসিবাদী আদর্শের জয়যাত্রা।

এই আদর্শ লোকের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে আধুনিক গণমাধ্যমগুলি এক বিরাট ভূমিকা নেয়। একদিকে ভূয়ো খবর তৈরি করা হয়, অন্যদিকে খবরকে ঝাড়াই বাছাই করে ও দরকার মতো কেটে ছেঁটে বদলিয়ে দিয়ে উগ্র জাতীয়তাবাদ ছড়ানোর কাজ অবাধে চলে। যে খবরে জাতীয়তাবাদের উগ্রতা কমে যায়, যেমন বেকারত্ব, কৃষকের দূর্দশা, ধর্মের ভিত্তিতে হত্যা, দলিত মেয়েদের ধর্ষণ ইত্যাদিকে যথাসম্ভব আড়ালে রাখা হয়, যেন সেগুলি তুচ্ছ খবর।

সাধারণত দুভাবে ভুয়ো খবরকে ছড়িয়ে দেওয়া হয় – একদিকে দরকার মতো খবর ‘ম্যানুফ্যাকচার’ করা হয় আর অন্যদিকে ‘অস্বস্তিজনক’ খবর ছড়িয়ে পড়াকে আটকে রাখা হয়। উইনস্টন চার্চিলের কথা প্রসঙ্গে অল্ডাস হাক্সলের তীর্যক মন্তব্য মনে করা যেতে পারে, “এর আগে কখনো এত কম লোক এত বেশি মানুষকে প্রভাবিত করতে পারেনি”; (ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড রিভিজিটেড, লন্ডন, ভিন্টেজ বুকস, ১৯৯৪, পৃ: ২৭)। কিন্তু এর পরেও যেটুকু বিরোধী মত অবশিষ্ট থাকে তাকে খতম করার জন্য চলে রাষ্ট্রশক্তির দমনমূলক আইনের ব্যবহার। সব বিরোধী কাজ বা ভাবনাকে জাতীয়তাবাদের বিরোধী বলে চিহ্নিত করে ফ্যাসিবাদী উগ্র জাতীয়তাবাদকে আরো প্রবল করে তোলা হয়।

অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্য

অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্যগুলি ততই ক্রমশ প্রকট হতে থাকে যত বেশি করে রাষ্ট্রশক্তির সাহায্যে একটা জরুরি অবস্থার মতো ছদ্ম আবহাওয়া তৈরি হয়। সেই আবহাওয়ায় বিচারব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা, গণমাধ্যম এবং সংবিধান অনুসারে স্বয়ংশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলিকে ছলে-বলে-কৌশল যতটা সম্ভব সরকারের দিকে নিয়ে আসা যায়। কিন্তু ছলে-বলে-কৌশলে সবকিছুকে প্রভাবিত করার এই চেষ্টার মধ্যে জোরদার থাকে টাকার খেলা। তার ফলে ফ্যাসিবাদ অনিবার্যভাবে এক অর্থনৈতিক অসঙ্গতির মুখোমুখি হয়। যদি বেশি করে কর বসানো হয়, তাহলে তার জনপ্রিয় চেহারাটা ধাক্কা খায়। কর যদি শুধু ধনী ব্যবসায়ীদের ওপরে চাপানো হয় তাহলে তারা সরকারের বিরুদ্ধে যেতে পারে। তাই সরকারের আসল মুখ হয় ধনী ব্যবসায়ীদের সাহায্য করা আর মুখোশ হয় গরিবদের উদ্দেশ্যে সহানুভূতি ও প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দেওয়া আর তার সঙ্গে টুকটাক কিছু সাহায্য করা। বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলিকে আরও বড় করতে সরকার সস্তায় ‘জল-জঙ্গল-জমিনের’ অধিকার পাইয়ে দেয়, লোভনীয় কিছু আইন চালু করে – যাতে মুক্ত বাজারের নামে তারা কৃষকদের কাঁচামাল সম্পূর্ণ কব্জা করতে পারে অথবা ব্যবসাকে উৎসাহ দেবার নামে শ্রমিকদের সব রকম সুরক্ষামূলক আইন থেকে বঞ্চিত করতে পারে। অন্যদিকে বড় ব্যবসায়ীর লক্ষ্য, সব রকমের ব্যবসাকে দখল করে, আরও বড় হওয়া। তাই বড় ব্যবসায়ীরাও চায় শাসকের একচ্ছত্র ক্ষমতা। যার ওপরে নির্ভর করে দরকার হলে অসংখ্য গরিব মানুষের দারিদ্র্য আরও বাড়িয়ে দিয়ে নিজেদের ধন-সম্পদ বৃদ্ধি। তাই ফ্যাসিবাদ কৃষি বা শিল্পের ছোট ব্যবসায়িক পরিমন্ডলে স্বচ্ছন্দ নয়, বরং মুক্ত বাজারের নামে, এক শক্তিশালী সরকারের সাহায্যে, মুক্ত বাজারের আসল নিয়মগুলি নিজেদের সুবিধা মতো তৈরি করে নেয়। তার বিনিময়ে অবশ্য বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ফ্যাসিবাদী শাসককে আরও শক্তিশালী ও একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী করে তোলে। এইভাবেই ফ্যাসিবাদে এদের মধ্যে এক গভীর পারস্পরিক নির্ভরতার সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

সেই অবস্থায় শাসক, তার একচ্ছত্র ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে, বিপুল গণবিক্ষোভকেও জনবিরোধী হিসেবে দাগিয়ে দেয়। স্বদেশপ্রেম বা জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে বাইরের শত্রুর ষড়যন্ত্র এমন প্রচার চালিয়ে আরও সহজে তাদের ওপর দমন পীড়নের কাজ চালায়।

তত্ত্ব দিয়ে ফ্যাসিবাদ নামক জন্তুটির আকার এইসব অপরিহার্য রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্যগুলি দিয়ে বোঝা যেতে পারে কিন্তু এক অর্থে তা বিভ্রান্তিকর কারণ তত্ত্ব অপরিবর্তনশীল কিন্তু তত্ত্বের ব্যবহার তো হয় কোনো এক ঐতিহাসিক অবস্থায়; সেই অবস্থা কিভাবে বদলাবে তার নানা সম্ভাবনা থাকে। যেমন ছোট বীজের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে বিশাল মহীরুহ হওয়ার অথবা ছোট চারা হয়েই মরে যাওয়ার সম্ভাবনা। শুধু তত্ত্ব দিয়ে এই পরিবর্তনের নানা সম্ভাবনা বোঝা যায় না; ঠিক যেমন শুধু ব্যাকরণ দিয়ে একটা গোটা ভাষাকে বোঝার চেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য। আসলে তো ভাষা এক জীবন্ত সম্ভাবনার মতো। তেমনই নানা রকম সম্ভাবনা নানা অবস্থায় ফ্যাসিবাদের রকমভেদ হিসেবে দেখা যায়।

ফ্যাসিবাদের আলোচনায় এর গুরুত্ব এই কারণেই, যে কোনো ঐতিহাসিক অবস্থায় এই রাজনৈতিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক লক্ষণগুলি কিভাবে দেখা দেবে তা সময় ও প্রসঙ্গের সঙ্গে সঙ্গেই বদলাবে। যেমন ধরা যাক, এমন একটা সমাজ যা একটু প্রাচীনপন্থী, এবং ঐতিহ্যকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়। এই অবস্থায়, সব নাগরিকই কি সত্যিই এই ঐতিহ্যে বিশ্বাস করেন নাকি কিছু নাগরিক সব সময়ে থাকবেন যাদের নিজেদের ঐতিহ্য এই প্রধান ঐতিহ্যের সঙ্গে মেলে না। এই কথাটি ওঠে, কারণ ঠিক এই প্রশ্নটাই তোলা হয়। আমাদের প্রধান ঐতিহ্য আর ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে অন্য ঐতিহ্য যেমন কিছু সংখ্যালঘু মানুষের ঐতিহ্য মেলে না – এই বলে ভেদাভেদের বীজ পোঁতা হয় আর তার থেকেই তৈরি করার চেষ্টা হয়, আগে যা বলা হয়েছিল, সেই এক যুদ্ধের মতো কাল্পনিক পরিস্থিতি। খেলা শুরু হয় একটা সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর ‘আমাদের কেউ নয়’ বলে শুরু করে কিন্তু কোন পরিচয়ের ভিত্তিতে তাদের বিচ্ছিন্ন করা হবে, তা নির্ভর করে একটি নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক অবস্থায় দাঁড়িয়ে, যেমন কোথাও ধর্ম, কোথাও চামড়ার রঙ, কোথাও কে উদ্বাস্তু হয়ে এল ইত্যাদি। যে খেলার শুরু এই ভেদাভেদ তৈরি করার থেকে, সে খেলার মধ্যভাগে ভেদাভেদকে ঘৃণা ও হিংসায় বদলে সেই বিশেষ গোষ্ঠীকে লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়। সরকার অনেক সময় বলেন ঐ সংখ্যালঘু গোষ্ঠী বেশি বেশি সুবিধা পাচ্ছে যা সংখ্যাগুরুর স্বার্থকে আঘাত করছে। এমন সব প্রচারের মধ্য দিয়ে ঘৃণার মাত্রাকে বাড়িয়ে দেওয়া হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে মার্ক্সের বলে যাওয়া ‘সুবিধাভোগী শ্রেণির’ ধারণাকে বদলে তাকে এক ধর্মীয় রূপ দেওয়া হয়।

সেই সঙ্গে চলে ফ্যাসিবাদের তৈরি মিথ্যা শোষণকারী চিহ্নিত করা সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ঘৃণা সরকার অনুগত গণমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া। থেকে থেকেই সংগঠিত হত্যা, দাঙ্গা বা পিটিয়ে মারার ঘটনা দিয়ে ‘জাতিগত শুদ্ধতার’ ধারণাকে আরও জোরদার করা। সেই সঙ্গেই, জাতীয় সংস্কৃতির গরিমার জন্য, এক সম্পূর্ণ ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র দরকার – এই বলে প্রচার চলে এবং এই সব ঘটনাকে তুচ্ছ বলে উপেক্ষা করে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এইভাবে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র সমস্ত পার্থক্যকে মুছে দিয়ে প্রতিশ্রুতি দেয় এক অলীক অতীতের স্বর্ণযুগে দেশকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার।

আমরা হয়তো ফ্যাসিবাদের শেষ পর্যায়ের খেলার মাঝামাঝি কোথাও, যেখানে তৈরি হচ্ছে মাস্তানদের মতো এক অন্য ধরনের সম্মান পাওয়ার ধারণা। রাষ্ট্র যেন হুঙ্কার দিচ্ছে – কিছু দেখে না, শোনে না, বলে না এমন নাগরিকেরই থাকবে শুধু বেঁচে থাকার অধিকার।

- অমিত ভাদুড়ি  
(দ্যা টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধটি অনুবাদ করেছেন প্রতীপ কুমার দত্ত)  

খণ্ড-28
সংখ্যা-1