সম্পাদকীয়
গ্রামবাংলা থেকে উঠুক নতুন রণধ্বনি!
ede

বিজেপি এবার পরিকল্পিত অভিযান শুরু করতে চলেছে — গ্রামে গ্রামে ঢোকার। সঙ্গে আরএসএস। ২০১৬-র বিধানসভা ও ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের সময় থেকে গ্রামবাংলায় গেরুয়া দলের অনুপ্রবেশ ঘটেছে ব্যাপক। তার ঘনীভূত প্রমাণ মেলে উত্তরবঙ্গের জেলায় জেলায় এবং দক্ষিণবঙ্গের জঙ্গলমহল ও রাঢ় এলাকায়। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ-সীমান্ত গ্রামাঞ্চলে তার বিস্তার যথেষ্ট চিন্তার কারণ। বিজেপি এবার কেবল ভালো ফল করার বিগত লক্ষ্যে ক্ষান্ত থাকতে চাইছে না, বাংলা দখলের জিগির তুলে ঝাঁপাচ্ছে। তার জন্য নজর ব্যাপক গ্রামভিত্তিক বিধানসভা কেন্দ্রগুলোর ওপর।

পরিস্থিতি তাই দাবি করছে এর পাল্টা তীব্র ও ব্যাপক উদ্যোগ-সক্রিয়তা শুরু করে দেওয়া দরকার। দিল্লীর দীর্ঘস্থায়ী কৃষকের প্রতিরোধ আন্দোলন গ্রাম ভারতের কৃষকের ভাবমানসে এক নতুন আবহ এনে দিয়েছে। বাংলার গ্রামে গ্রামেও তার উত্তাপ কোনো-না-কোনো মাত্রায় পৌঁছাচ্ছে। তার সাথে তুলতে হবে এরাজ্যের কৃষি ও কৃষক জীবনের দূর্দশার মূল মূল কারণগুলোর প্রতিকারের আওয়াজ। গ্রামে কৃষক জনতা ছাড়াও অন্যান্য পরিচিতির নিম্ন-মাঝারি বিত্তের ও নিম্নবর্ণের মানুষজন বাস করেন, তারাও নানা দিক থেকে ভুক্তভোগী। যথার্থ অভিযোগ ও দাবিগুলো তুলে ধরে সচেতন-সংগঠিত হতে হবে সমস্ত অংশের জনগণকে, পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে মোদীরাজ-বিজেপি-আরএসএস-কে প্রত্যাখ্যান করার।

বিজেপি বলছে, বাংলায় চল্লিশ হাজার গ্রামসভা করবে। লক্ষ্যমাত্রাটা অতিরঞ্জিত ধরে নিলেও হাল্কা করে দেখার নয়। আরএসএস বলছে, জনসংযোগ করবে তেত্রিশ হাজার গ্রামে। দুটো সংগঠনের টার্গেট মোটামুটি একই রকম এবং সংখ্যায় বেশ বিশাল। বিজেপির অতিরিক্ত সুবিধা হল, আরএসএস-এর নেটওয়ার্ক পাবে, যার বহুবিচিত্র শাখা আছে। জন সংযোগে প্রচারের প্রধান প্রধান বিষয় করবে শাসক তৃণমূলের দুর্নীতি-দলতন্ত্র সহ কেন্দ্রের ‘কৃষক সম্মাননা’র প্রকল্প কত ‘কৃষি ও কৃষক দরদী’ তাতে মোহিত করা। বিজেপি কর্মসূচী নিয়েছে ঘর ঘর থেকে এক মুঠো চাল চেয়ে গ্রামেই বসে ভোজনপর্ব সারার। এভাবে দেখাবে যেমন ‘জনগণের কাছ থেকে নেওয়ার’ এক চমক প্রদর্শন, তেমনি কসরত দেখাবে জনতাকে মন ভুলানো ‘সান্ত্বনা’ দেওয়ার। ব্যবহার করবে ‘অনুপ্রবেশকারী’ ও ‘নতুন করে নাগরিকত্ব প্রদানের’ নামে পাকিয়ে তোলা ইস্যু- দুটিকে। রয়েছে মাদ্রাসাকে সন্ত্রাসবাদ ছেয়ে গেছে দাবি করা প্রচার। তারপরে টিএমসি দলত্যাগীকে রাজ্যে জেসিআই-এর চেয়ারম্যান করল, তাতেও ছক রয়েছে, লাভজনক দামে পাট বিক্রির আশায় রেখে পাট চাষিদের প্রভাবিত করতে চাইবে, পাট চাষিদের এক উল্লেখযোগ্য অংশ মুসলিম সম্প্রদায়ের। পাশাপাশি, আরএসএস নামছে জাত-ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণী-সম্প্রদায় ভিত্তিক গ্রাম সমাজের কাঠামো মাথায় রেখে। তবে শ্রেণীভাগ নিয়ে তার তত মাথাব্যথা নেই। মুসলিম বাদে যে অংশে যা প্রচার করলে জাত-বর্ণ নির্বিশেষে সব অংশকেই বৃহত্তর হিন্দু পরিবারের অঙ্গাঙ্গী করে ফেলা যায়, সঙ্ঘ প্রচারকরা সেটাই করবে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জনগণের প্রতি প্রয়োগ করবে খতরনাক দ্বৈত পলিসি। একদিকে হিন্দু সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষে ভয়াতঙ্ক ছড়ানো, যাতে সবদিক থেকে নিরাপত্তাহীনতায় অবসাদগ্রস্ত হয়, অন্যদিকে যত পারা যায় অসংহত করে দেওয়া।

তবে বিজেপি-আরএসএস-কে পাল্টা উন্মোচিত করারও যথেষ্ট রসদ রয়েছে। ‘কৃষক সম্মাননা’ প্রকল্প সাময়িক একটা খয়রাতি প্রকল্প মাত্র। রাজ্যের ‘কৃষক বন্ধু’ প্রকল্পও তাই। মোদী সরকার বলেছিল, ২০২২-এর মধ্যে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করবে। আর ২০২১-এ নিয়ে এল কৃষি ও কৃষক বিরোধী এবং কর্পোরেট স্বার্থসর্বস্ব তিনটি আইন। দেশ প্রত্যক্ষ করছে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে কৃষক জনতার এককাট্টা নাছোড় প্রতিরোধ। কালা তিনটি আইন প্রত্যাহার করতেই হবে। এ লড়াই ছড়িয়ে পড়ছে রাজধানীর রাজপথ থেকে রাজ্যে রাজ্যে, বার্তা যাচ্ছে গ্রাম-গ্রামান্তরে। হরিয়ানায় বিজেপি সরকারের ‘মোদীর কৃষি আইনে’র সপক্ষে তৈরি তথাকথিত মহাপঞ্চায়েতের মঞ্চ কৃষক জনতা লন্ডভন্ড করে দিয়েছেন, সুপ্রীম কোর্টের ‘মধ্যস্থতা’র নামে মোদীর গোমস্তাগিরি কৃষক জনতা মেনে নেননি, পশ্চিমবঙ্গেও জ্বলতে শুরু করেছে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের মশাল। নেতৃত্ব দিচ্ছে বামপন্থীরা। বামেদের চাপে মমতা সরকার বাধ্য হয়েছে জানুয়ারীর শেষে বিধানসভার বিশেষ অধিবেশন ডাকতে, মোদী সরকারের তিন কালা কৃষি আইনের বিরুদ্ধে প্রস্তাব গ্রহণ করবে। বিজেপির দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার স্বরূপ উন্মোচনের আরও অনেক ভিত্তি আছে। ‘পি এম কেয়ারস্’ তহবিলকে ক্ষমতার জোরে হিসাব পরীক্ষার বাইরে রাখার পিছনে রয়েছে অশুভ স্বার্থ। ‘পিএম কিষাণ’ প্রকল্পেও ধরা পড়ছে অসাধু পক্ষপাতিত্ব পৌঁছাচ্ছে কোন পর্যায়ে! অনুদান পাওয়ার কথা নয় অথচ এমন ২০.৪৮ লক্ষ ‘চাষি’র কাছে চলে গেছে ১৩৬৪ কোটি টাকা! প্রকল্প শুরু হতেই এই কান্ড! সুবিধাভোগীদের ৫৫.৫৮ শতাংশ আয়কর দেন! এ চোরাতথ্য সরকার নিজের গরজে প্রকাশ করেনি, পর্দা ফাঁস হয়েছে আরটিআই করতে। এসব তো বিজেপির বিরুদ্ধে মোক্ষম ইস্যু হতেই পারে।

তাছাড়া রয়েছে রাজ্যের কৃষি-কৃষক ও অন্যান্য প্রকল্পের অশেষ দুর্গতির প্রশ্ন, যার পেছনে প্রচন্ড দায়ী মোদীর গ্রাম-ঘাতক নীতি। ঋণ মুক্তি ও ফসলের দেড়গুণ দাম, কৃষি উপকরণের স্বল্প মূল্যে সুলভ সরবরাহ, পর্যাপ্ত ভূপৃষ্ঠ ভিত্তিক সেচ ব্যবস্থা, সরকারী বিনিয়োগ বৃদ্ধি, সরকারী-বেসরকারী পুরানো ঋণ মকুব ও সহজ শর্তে স্বল্প সুদে দীর্ঘমেয়াদী ঋণ যোগান, অরণ্য সম্পদের উপর আদিবাসীদের চিরাচরিত অধিকার, একশ দিনের কাজের সম্প্রসারণ ও মজুরি বৃদ্ধি, সমকাজে নারী-পুরুষের সমমজুরি, আমফান ত্রাণবরাদ্দের প্রশ্নে কেন্দ্রের নিদারুণ বঞ্চনা, পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রতি প্রতারণা, সমান নাগরিকত্বের অধিকারের মর্যাদা, ঘাতক সিএএ-এনআরসি-এনপিআর পলিসি প্রত্যাহার – এইসমস্ত জ্বলন্ত দাবিতে বিজেপি-আরএসএস-কে দূর দূর করে তাড়াতে হবে। ওদের রাম মন্দিরের নামে তহবিল তোলার অভিযান রাজনীতির স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করা ও সাম্প্রদায়িকীকরণেরই বিষয়। এটা বুঝতে হবে, বুঝিয়েও দিতে হবে। গ্রামবাংলা থেকে উঠুক নতুন রণধ্বনি — বিজেপি-আরএসএস হটাও, বাংলা বাঁচাও!!

খণ্ড-28
সংখ্যা-2