অর্ণবগেট এবং গোয়েবলসীয় গোদী মিডিয়ার প্রচারের বিরুদ্ধে ভারতের লড়াই
aarr

অর্ণব গোস্বামী — ভারতের কুখ্যাত ‘গোদী মিডিয়া’র সেই ভয়ঙ্কর কুচুটে মুখপাত্রটি — অবশেষে নিজের ঔষধে নিজেই ধরাশায়ী! ‘গোদী মিডিয়া’ — সংবাদ মাধ্যমের একটি ধারা যা শুধু গণতন্ত্রের স্বার্থের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের/সরকারের হয়ে কাজই করে না, ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলোর সঙ্গে অশুভ গোপন আঁতাতের মাধ্যমে চব্বিশ ঘণ্টা ঘৃণা ও মিথ্যা ছড়ানো, সত্যকে বিকৃত করা এবং যে কোনও বিরোধিতাকে কুৎসিতভাবে চিত্রিত করার উদ্দেশ্যে প্রচার যুদ্ধে হিটলারের ঝটিকাবাহিনীর শাণিত ক্ষিপ্রতায়, চাতুর্যে কাজ করে যায়। অনেকদিন ধরে এই ব্যক্তিটি মেল ও কথোপকথনের (চ্যাট) বাছাই করা তথ্য ফাঁসকে কাজে লাগিয়ে মোদী-শাহ রাজ এবং সঙ্ঘ বাহিনীর হয়ে ‘মিডিয়া ট্রায়াল’ চালিয়ে যাচ্ছে। হোয়াটস্অ্যাপ কথোপকথনের সময় সে নিজেও বুঝতে পারেনি যে ওটা তাকেই একদিন ঐ পর্যায়ে টেনে নামাবে এবং স্বঘোষিত ‘নির্ভীক সৎ সাংবাদিকের’ ছদ্মবেশের আড়ালে তার মজ্জায় মজ্জায় নির্লজ্জ বিবেকহীন ক্ষমতা-দালালের আসল চেহারাটা উন্মোচিত করে দেবে।

আইন অবশ্য তাকে ধরে ফেলার চেষ্টাটা শুরু করেছে ইদানিং। মহারাষ্ট্র পুলিশ ২০২০’র নভেম্বরে তাকে ২০১৮’র এক আত্মহত্যায় প্ররোচনা মামলায় মূল অভিযুক্ত হিসেবে গ্রেপ্তার করে। ইন্টিরিয়র ডিজাইনার অন্বয় নায়ক এবং তার মা ২০১৮তে আত্মঘাতী হন। তার আগে অর্ণব গোস্বামী ও রিপাবলিক টিভি-র বিরুদ্ধে, তাদের প্রাপ্য বকেয়া ৫•৪০ কোটি টাকা না মিটিয়ে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দেওয়ার অভিযোগ জানিয়ে গেছেন। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট, সাম্প্রতিক কালে সাজানো মিথ্যা অভিযোগ এবং দানবীয় আইনের শিকার সমস্ত সাংবাদিক, লেখক, আইনজীবী এবং মানবাধিকার কর্মীদের জামিনের আবেদন খারিজ করে দিচ্ছে, কিন্তু বিপরীতে অর্ণব গোস্বামীকে তারা দারুণ তৎপরতায় জামিন মঞ্জুর করেছে।

রিপাবলিক টিভি যখন ভারতে তাদের রুটিনমাফিক বিদ্বেষ ও মিথ্যা ফেরি করেও পার পেয়ে গেছে, তাদের হিন্দি চ্যানেল ‘রিপাবলিক ভারত’কে ব্রিটিশ টিভি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ অফকম “পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে বিদ্বেষপূর্ণ ভাষণ, এবং পাকিস্তানি জনসাধারণের প্রতি মর্যাদাহানিকর ও অভদ্র আচরণের” জন্য জরিমানা করেছে। কিন্তু এখানে ভারতে, আমরা এখন জানি অর্ণবের রিপাবলিক টিভি কীভাবে  ভারতের টিভি রেটিং এজেন্সি ব্রডকাস্ট অডিয়েন্স রিসার্চ কাউন্সিল (বিএআরসি)-এর সঙ্গে সুপরিকল্পিত ধারাবাহিক গোপন আঁতাতের সুবিধা ভোগ করে চলেছে! বিএআরসি’র প্রাক্তন সিইও পার্থ দাশগুপ্ত, অধুনা সামনে আসা টিআরপি (টেলিভিশন রেটিং পয়েন্টস) কেলেঙ্কারির সূত্রে বর্তমানে জেলবন্দি। আর মুম্বাই পুলিশ, ২০১৭ থেকে ২০১৯-এর মধ্যে অর্ণব গোস্বামী ও পার্থ দাশগুপ্তার মধ্যে হোয়াটস্অ্যাপ কথোপকথনের ৫০০ পাতার যে সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট পেশ করেছে, তার দরুন আমাদের কাছে এখন রয়েছে রিপাবলিক টিভি-র কাজকর্ম সম্পর্কে বিস্ফোরক সব তথ্য।

অর্ণবের এইসব খোশগল্প শুধু যে রিপাবলিক টিভি এবং বিএআরসি’র মধ্যে গোপন আঁতাত তথা রিপাবলিক টিভি-র বাণিজ্যিক সুবিধার্থে ভারতের টিআরপি তথ্যভাণ্ডারে অন্যায় হস্তক্ষেপের বিষয়টি তুলে ধরেছে তাই-ই নয়, মূল পাণ্ডা হিসেবে অর্ণবের যে ব্যবস্থাপনায় মোদী-শাহ কোম্পানি লাগাতার অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে তার অবয়বগত একটা নিখুঁত বিশ্লেষণও ধরা পড়েছে।

অর্থনীতিগত দিক থেকে দেখলে, এই টিআরপি কেলেঙ্কারিকে মনে হবে, “ভেতরের লোকের দেওয়া তথ্য” সুপরিকল্পিতভাবে সুদক্ষ চাতুর্যে কাজে লাগানোর ভিত্তিতে যেসব কেলেঙ্কারি হয়েছে — যেমন ভারতের কুখ্যাত শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারি বা ব্যাঙ্ক জালিয়াতি — তার থেকে বেশি কিছু নয়। কিন্তু এটাই সম্পূর্ণ ভিন্ন এক মাত্রা পেয়ে যায় যখন আমরা বুঝতে পারি যে এই “ভেতরের তথ্য”-র সঙ্গে সরকারের সর্বোচ্চ স্তরের সামরিক ও রাজনৈতিক পরিকল্পনা জড়িয়ে আছে, যখন অর্ণব গোস্বামীকে পুলওয়ামার মর্মন্তুদ ঘটনাকে “আমাদের দারুণ জেতা যুদ্ধ” বলে উল্লেখ করতে শুনি বা যখন আমরা বুঝে ফেলি যে অর্ণব গোস্বামীর কাছে বালাকোট বিমান আক্রমণ বা ৩৭০ ধারা বিলোপের মতো গোপন সরকারী তথ্য সম্পর্কেও আগাম খবর থাকে! এটা ভেবে আরও দুশ্চিন্তা হয় যে এনআইএ (ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেটিং এজেন্সি) কৃষক আন্দোলনের নেতাদের নিশানা করতে ব্যস্ত, অথচ অর্ণবের আলাপচারিতায় জাতীয় নিরাপত্তা উল্লঙ্ঘনের যেসব স্পষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ রয়েছে সেগুলো সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হচ্ছে!

আমেরিকায় ট্রাম্প-অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ায় গোটা দুনিয়া  সবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। আমেরিকার সংবাদমাধ্যম ট্রাম্পের শয়তানি জমানার দ্বিতীয়বার ফিরে আসার ভয়ঙ্কর বিপদ থেকে আমেরিকার মুক্তির ব্যাপারে একটা মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। অর্ণবের আড্ডায়(আলাপে) ধরা পড়েছে – কীভাবে ভারতে তার উল্টোটাই ঘটছে, কীভাবে জনমত তৈরি ও সুকৌশলে পাল্টে দেওয়ার উদ্দেশ্যে গোয়েবলসীয় গোদী মিডিয়া এবং হিটলারি মোদী রাজ একজোট হয়ে পুলওয়ামা ও বালাকোটের মতো ঘটনাগুলোকে চরম বিবেকহীনতায় কাজে লাগাচ্ছে। মোদী নির্লজ্জভাবে পুলওয়ামার শহীদদের নাম করে যখন ভোট চাইছিল, ঠিক তখনই অর্ণব ওর চ্যানেলের দর্শক বাড়ানো এবং সঙ্ঘী প্রচারযন্ত্র হিসেবে চ্যানেলটাকে আরও জোরালো করে তোলার জন্য নির্মম বিবেকহীনতায় তাদের মৃত্যুকে কাজে লাগাচ্ছিল। ভারতে গণতন্ত্রের লড়াইকে, সংবাদমাধ্যমের প্রভাবশালী অংশ, বিশেষ করে দূরদর্শন এবং ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দুষ্কর্মের এই অশুভ আঁতাতের মোকাবিলা করেই এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

অর্ণবের কথোপকথন ইউপিএ জমানার কুখ্যাত রাদিয়া টেপের থেকেও বেশি বিস্ফোরক এবং ক্ষতিকর। রাদিয়া টেপ ছিল সাংবাদিককুল এবং কর্পোরেট লবির লোকজন যারা মন্ত্রী পর্যায়ের নিয়োগ ও নীতিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছিল তাদের সম্পর্কে। আর অর্ণবের আলাপচারিতা হল সংবাদমাধ্যমকে কর্পোরেট আগ্রাসন এবং ফ্যাসিবাদী প্রচার যুদ্ধের একটি হাতিয়ারে রূপান্তরিত করা সম্পর্কে। মোদী সরকারের ধ্বংসাত্মক কৃষি আইনের বিরুদ্ধে চলমান কৃষক আন্দোলন এই গোদী মিডিয়াকে আদানি-আম্বানি কোম্পানি রাজের এবং স্বৈরাচারী মোদী সরকারের সঙ্গে সঙ্গে আরেক মূল প্রতিবন্ধক হিসাবে চিহ্ণিত করেছে। এই টিআরপি কেলেঙ্কারির নতীজা আইনি পথে শেষ পর্যন্ত যাই হোক না কেন, অর্ণব-চ্যাটকে কর্পোরেট শক্তি, স্বৈরতন্ত্রী সরকার এবং আক্রমণাত্মক পার্টিজান মিডিয়া প্রতিষ্ঠানের মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্য, ন্যায় ও গণতন্ত্রের সংগ্রাম এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কার্যকরী হাতিয়ার হিসাবে অবশ্যই ব্যবহার করতে হবে।

(এমএল আপডেট, সম্পাদকীয়, ১৯-২৫ জানুয়ারী, ২০২১)    

খণ্ড-28
সংখ্যা-3