এ বাংলায় প্রশ্নাতীতভাবে বামেদের মূল প্রতিপক্ষ বিজেপি
dddar

দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের সাক্ষাৎকার
(https://thequiry.com/ প্রকাশিত আনকাট সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন শুভজিৎ চক্রবর্তী)

প্রশ্নঃ সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক পদে রয়েছেন আপনি। যে দল সর্বদা জনজাতি, উপজাতি, আদিবাসী তথা পিছিয়ে পড়া মানুষের পাশে থেকেছে। ইদানিং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পশ্চিমবঙ্গ সফরে দেখা যাচ্ছে কখনও তিনি আদিবাসী, কখনও নমঃশূদ্র আবার কখনও বাউল পরিবারে মধ্যাহ্ন ভোজ সারছেন। অথচ তারপরেই সেই পরিবারের সদস্যরা আক্ষেপ করছেন তাঁদের কথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শুনলেন না। এই বিষয়টাকে আপনি কিভাবে দেখছেন?

উত্তরঃ বিজেপি’র জনজাতিপ্রেম পুরোপুরি প্রচারকেন্দ্রিক ও ভোটসর্বস্ব। বিজেপি সরকারের অর্থনীতি দেশের সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদ আদানি আম্বানিদের হাতে তুলে দিচ্ছে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি দেশের আদিবাসী জনগণের। অর্থনৈতিক আগ্রাসনের পাশাপাশি ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রশ্নেও বিজেপি অত্যন্ত আগ্রাসী। দলিত ও আদিবাসী জনগণ এবং তথাকথিত প্রান্তবাসী মানুষ ও তাদের সংস্কৃতি সমান সম্মানের অধিকারী। ক্ষমতাশালীদের লোকদেখানো বদান্যতা নয়, সাংবিধানিক অধিকার ও পারস্পরিক স্বীকৃতি ও সম্মানটাই আসল কথা।

প্রশ্নঃ এই প্রসঙ্গে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই। আপনার মনে হয় মানুষকে জাত-পাতে, সম্প্রদায়ে বিভক্ত করে ফায়দা তুলতে চায় রাজনৈতিক দলগুলি?

উত্তরঃ আমি বলব শাসন ক্ষমতায় থাকা অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই মানুষকে বিভক্ত রাখতে চায়। মানুষ যখন ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজেদের দাবি তুলে ধরে তখন সরকারেরা আর পালাবার পথ পায় না। এই সময়ের কৃষক আন্দোলন তা খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিচ্ছে।

প্রশ্নঃ ভুমি সংস্কার নিয়ে আপনার মতামত শুনেছি। সিঙ্গুরের মাটি থেকে টাটা চলে যাওয়া। বুদ্ধবাবুর স্বপ্নভঙ্গ। বাংলায় সরকার বদল। এরপর বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী এই জমিতে সর্ষে ছড়ালেন। এখন আবার বলছেন সিঙ্গুরে ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক হবে। প্রায় ১০ বছর হয়ে গেল সিঙ্গুরের মানুষ কিছুই তো পেল না। না হল চাষ, না হল শিল্প। এরপর ওই জমিতে ইন্ডাস্ট্রি তৈরি হতে ৩ থেকে ৪ বছর সময় লেগে যাব। গোটা বিষয়টায় আপনার মতামত কি?

উত্তরঃ সিঙ্গুরের মানুষের সঙ্গে আলাপ আলোচনা না করে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে শিল্পের নামে জোর করে জমি নিয়ে নেওয়াটা একটা বিরাট বড় ভুল ছিল। সেই জমিকে কৃষিযোগ্য করে ফেরত দেওয়ার কথা ছিল। তা হয়নি। বিশ্বাসঘাতকতা অব্যাহত। এখন সে জমিতে কী হতে পারে এ ব্যাপারেও শুধু বিশেষজ্ঞদের রায় নয় ওখানকার মানুষের ইচ্ছেকে মূল্য দিতে হবে। আমার তো মনে হয় কৃষি বা শিল্প যাই হোক তাতে যদি সমবায় ভিত্তিতে সাধারণ স্থানীয় মানুষের অধিকার সুনিশ্চিত করা যায় সেটাই হবে সবচেয়ে কাজের কথা।

প্রশ্নঃ টানা ৩০ দিনের মাথায় পড়ল কৃষকদের আন্দোলন। সেই আন্দোলনকে একাধিক তকমা দিয়ে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা চলছে। অথচ যত সময় যাচ্ছে আন্দোলন আকারে বাড়ছে। ৩৩ জন আন্দোলনরত কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। আপনি এবং আপনার দল কি দাবি করছেন?

উত্তরঃ কৃষকদের দাবিই আমাদের দাবি। কৃষকের নাম করে কোম্পানি রাজের স্বার্থে আইন তৈরি করা এবং কৃষিকে কোম্পানি মালিকের হাতে তুলে দেওয়া কৃষকের উপর বিরাট বড় আঘাত ও অপমান। এই আইন প্রত্যাহার করতে হবে। এর পাশাপাশি কৃষকদের অগ্রণী অংশ গণতন্ত্রের অন্য অনেক দাবিতেও সোচ্চার। যেমন রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির দাবি। সংবাদ মাধ্যমের উপর কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণ ও রাষ্ট্রের দখলের ফলে মিডিয়ার যে অগণতান্ত্রিক চরিত্র তৈরি হয়েছে তার অবসান ঘটানো। শুধু কৃষি নয়, গোটা অর্থব্যবস্হাকেই কর্পোরেট দখল মুক্ত করা। আমরা এই সমস্ত প্রশ্নেই কৃষকের সঙ্গে রয়েছি।

প্রশ্নঃ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বললেন ‘প্রধানমন্ত্রী কিসান সম্মান নিধি’ প্রকল্প থেকে বাংলার কৃষকরা বঞ্চিত হচ্ছে। রাজ্য বিজেপি’র নেতৃত্ব বলছেন কেন্দ্রের নাম বদল করে প্রকল্প চালাচ্ছে মুখ্যমন্ত্রী। সেখানেও ‘কাটমানি’র অভিযোগ তুলছেন। একটা বিরাট অংশের কৃষকরা বঞ্চিত হচ্ছেন সরকারী প্রকল্প থেকে। কি বলবেন এবিষয়ে?

উত্তরঃ কৃষকেরা এই মুহূর্তে দুটি দাবি সবচেয়ে বেশি জোরের সঙ্গে তুলে ধরেছেন। ঋণমুক্তি ও ফসলের ন্যায্য দাম। কৃষি উন্নয়নের জন্য উপযুক্ত কাঠামো গড়ে তোলাটাও সরকারের প্রাথমিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। সরকার এই কাজগুলো করলে ভোটের আগে সম্মানের নামে ঢাকঢোল বাজিয়ে কৃষকের হাতে কিছু সামান্য অর্থ তুলে দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। কৃষকরা ভিক্ষা বা ঘুষ চাইছেন না, তাঁদের দাবি ন্যায্য অধিকার।

প্রশ্নঃ বিহারের নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে আপনি বলেছিলেন নির্বাচনের ধাঁচ বদলাচ্ছে। এখন মানুষ বেকারত্বের বিরুদ্ধে শ্লোগান দিচ্ছে। প্রতিশ্রুতির তালিকায় চাকরি প্রথম স্থানে প্রাধান্য পাচ্ছে। মানুষ সেটাকে মেনেও নিচ্ছে। শুধুমাত্র বাংলা নয়, সারা দেশে বেকারত্ব একটি বিরাট সমস্যা। তাহলে বাংলার নির্বাচনে বামেরা এই বিষয়টিকে নির্বাচনী ইস্তেহারে প্রাধান্য দেবে?

উত্তরঃ বেকারত্ব বাংলার যুবসমাজের জন্যও বিরাট বড় প্রশ্ন। শিক্ষা ও জনস্বাস্থ্যের প্রশ্নও কম বড় নয়। আমার তো মনে হয় বাংলার বামপন্থীরা অবশ্যই এবারের নির্বাচনে এসব প্রশ্নে বিশেষ জোর দেবে।

প্রশ্নঃ নির্বাচনে বামেদের ব্যাপক জয়ের পরেও বিহারে অল্পের জন্য আপনারা সরকার গঠন করতে পারলেন না। এর কারণ কি ছিল?

উত্তরঃ বামেদের জয়টা সত্যিই যদি অতটা ব্যাপক হতো তাহলে সরকার গঠন হয়ে যেত। আসলে আমরা যদি আরও কিছু আসনে লড়তাম তাহলে হয়তো ছবিটা অন্যরকম হতো। কংগ্রেসের দুর্বলতা এবং আরজেডির রাজনৈতিক-সামাজিক সীমাবদ্ধতা অবশ্যই সামগ্রিক ফলাফলকে প্রভাবিত করেছে। কিন্তু আমার মনে হয় সবার আগে আমাদের বামপন্থীদের আরও বেশি সংগঠন, আন্দোলন ও আদর্শগত প্রভাব বিস্তারে মনোযোগী হতে হবে।

প্রশ্নঃ এর কারণ কি কংগ্রেস ছিল? যদিও বিহার এবং বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাস এক নয়। তবুও এই মুহূর্তে সারা দেশে কংগ্রেসের যা অবস্থা, তাতে আপনারা জোট করে ভুল করবেন না তো?

উত্তরঃ জোট দিয়ে দুর্বলতা ঢাকা যায় না। বাংলায় বামপন্থীদের কাছে নিজস্ব শক্তিবৃদ্ধি ও হৃত রাজনৈতিক জমি পুনরুদ্ধার এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।

প্রশ্নঃ গত কয়েক বছরে তৃণমূল এবং বিজেপিকে একই শ্লোগান দিতে শুনেছি ‘৩৪ বছরের বাম অপশাসন’। আপনার মনে হয় গত দশ বছরে তৃণমূলের শাসনকালে মানুষ তা ভুলতে পেরেছে। এবারের নির্বাচনে বামেরা হারানো জমি ফিরে পাবে?

উত্তরঃ অবশ্যই তৃণমূলের অপশাসনের প্রশ্ন সামনে আসায় অন্য অনেক প্রশ্ন প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে। কিন্তু এই লাভটা বিজেপি সবচেয়ে বেশি ঘরে তুলছে। বিজেপি’কে আড়ালে থাকতে দেওয়াটা বিরাট ভুল। তৃণমূলের অপশাসনের অভিজ্ঞতা লোকের হয়ে গেছে, বিজেপি সম্পর্কে যদি ঠেকে শেখার আগেই ত্রিপুরা, আসাম, বিহার, উত্তরপ্রদেশ বা গোটা দেশে বিজেপি শাসনকে দেখে বাংলার মানুষ শিখতে পারে সেটাই হবে বাংলার বামপন্থীদের আসল সাফল্য। নাহলে তৃণমূলের অপশাসন বা ভাঙনে বামপন্থীদের উৎসাহিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।

প্রশ্নঃ এখন রাজ্যজুড়ে দলবদলের হিড়িক পড়েছে। যারা আগে এক থালায় ভাত খেতেন, তাঁরাই এখন থালা ভেঙে অন্যের সঙ্গে পাত পেড়ে খাচ্ছেন। দলবদলের মানে তো মানুষের সঙ্গে বঞ্চনা করা। এবিষয়ে আপনার কি মতামত?

উত্তরঃ বিশেষ করে কোনো একটি দলের হয়ে ভোটে জেতার পর দলবদল করাটা আমি অনৈতিক মনে করি। সেক্ষেত্রে আগে পদত্যাগ করে জনগণের কাছে ফিরে যাওয়া উচিত। তবে বিজেপি জবরদখলকারীদের পার্টি। ইতিহাস, ভূগোল, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি সর্বত্রই লুটপাট করে রাজত্ব করাটাই ওদের রীতি। অন্য দল ভেঙে, ইতিহাসের বিভিন্ন প্রতীকদের বিকৃত করে নিজেদের দল বাড়ানো ও প্রচার চালানোটাই ওদের কাজ।

প্রশ্নঃ আপনার মতে বাংলায় বামেদের মূল প্রতিপক্ষ কে? তৃণমূল, নাকি বিজেপি?

উত্তরঃ অবশ্যই বিজেপি। প্রশ্নাতীতভাবে। আজকের বিজেপি মানে এক অভূতপূর্ব সামাজিক, আর্থিক ও রাজনৈতিক বিপর্যয়। তার সাথে আজ ভারতবর্ষের অন্য কোনো দলের তুলনা চলে না। ভারতবর্ষে শাসক শ্রেণীর অনেক দল আছে। দক্ষিণপন্থী বা পুঁজিবাদ সমর্থক দলের সংখ্যা অনেক। কিন্তু বিজেপি অন্য পাঁচটি দলের মতো নয়, বিজেপি মানে বস্তুত একদলীয় শাসন, গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ কন্ঠরোধ।

খণ্ড-28
সংখ্যা-1