সম্পাদকীয়
সব মনে রাখতে হবে
Editorial's Heading

সদ্য সদ্য পরপর দুদিন দুটি উল্লেখযাগ্য জামিন পাওয়ার খবর নজর কেড়েছে। প্রথমজন বিশিষ্ট বিপ্লবী কবি, সাংস্কৃতিক ও মানবাধিকার আন্দোলনের পুরোধা ভারভারা রাও, দ্বিতীয় জন উদীয়মান পরিবেশ কর্মী দিশা রবি। রাও অশক্ত হয়ে পড়া প্রবীণ, রবি একেবারে তরতাজা নবীনা।

বৃদ্ধ ভারভারা রাওকে কারাগারে বন্দী করে রাখা হয়েছিল গত দু’বছর। তথাকথিত ভীমা-কোরেগাঁও মামলায়। রাষ্ট্রের ক্ষমতাধরদের আচরণ এতই নিপীড়নমূলক যে, অসুস্থ রাওকে বিগত দু’বছরে মোট প্রায় পাঁচ মাস হাসপাতালে কাটাতে হয়। জীবনভর এই মানুষটি আন্দোলনে জড়িত থাকার কারণে বহুবার কারান্তরিত হয়েছেন। বলাবাহুল্য, প্রতিটি ক্ষেত্রেই মিথ্যা অভিযোগে। ভীমা কোরেগাঁও কেসটিও কেন্দ্রে মোদীরাজ কায়েম হওয়ার পর একটি সাজানো মামলা। মানবাধিকার আন্দোলনকে দমনের এক নজির তৈরির জন্যই এনআইএ-কে দিয়ে ‘ষড়যন্ত্র মামলা’টি দায়ের করা হয়েছে ষড়যন্ত্রমূলক ভাবে। এতে ফাঁসানো হয়েছে আরও বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট সমাজকর্মীকে, যারা আজও ভোগ করছেন দুঃসহ কারাজীবন। ভারভারা রাও জামিন পেলেন, কিন্তু কঠোর শর্তে, মাত্র ছয় মাসের জন্য, তিনি ফিরতে পারবেন না হায়দ্রাবাদে নিজগৃহে, তাঁকে থাকতে হবে মুম্বইয়ে পুলিশের নাকের ডগায়। পরের পর কারাজীবনের যাতনায় ভেঙেছে স্বাস্থ্য, তবু রাষ্ট্রের ঠিকেদাররা শোনে কার কথা! নিঃশর্তে মুক্তির জন্য থাকতে হবে নিরন্তর লড়াইয়ের পথে, যেতে হবে বহু দূর।

পুলিশী ভাষায় দিশা রবির ‘অপরাধ’ হল দিল্লীর কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে বিদেশী টুইট শেয়ার করা। মোদী সরকারের প্রতি সরব সমালোচনা শেয়ার করা। ব্যস্! রুষ্ঠ হলেন রাষ্ট্রের শাসকপক্ষ। দাগিয়ে দিলেন ‘দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রে’ লিপ্ত হওয়ার তকমা। শিকারী পুলিশ দিশাকে তুলে নিয়ে আসে বেঙ্গালুরু থেকে, চালান করে দিল্লীর হেফাজতে, আদালতে। দিশার এই প্রথম হেফাজত অভিজ্ঞতা। উপরোক্ত অভিযোগের অজুহাতে পুলিশ আরও দুজনকে হেফাজতে নিয়েছে, দাঁড় করিয়েছে মামলায়। নিম্ন আদালত কিন্তু পুলিশী কারণ দর্শানোকে বিশেষ গ্রাহ্য করেনি, বরং মন্তব্য করেছে, সরকারের সমালোচনা বা বিরুদ্ধতা মানেই ‘ষড়যন্ত্র’-‘বিচ্ছিন্নতাবাদ’ নয়, তার জন্য হাজতবাস করানো যায় না। অর্থাৎ, গ্রেপ্তার করে পক্ষান্তরে অন্যায়-অবিচার করেছে পুলিশ, মোদী সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ন্যূনতম শর্ত হল, থাকতে হবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, মান্যতা দিতে হবে শাসকের—শাসন ব্যবস্থার সমালোচনা, বিরোধিতা ও পরিবর্তন করার অধিকারকে। নাহলে সেই পরিবেশটা গণতন্ত্রের থাকে না, তার বদলে তাকে গণ্য করা যেতে পারে রাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র বা ফ্যাসিবাদ।

মোদীজীরা বিচারব্যবস্থাকে প্রভাবিত করতে ব্যবহার করছেন নিজেদের তৈরি কিছু ‘যুক্তি-তর্ক’। বলছেন, ব্যক্তির স্বাধীনতাকে বিচার করতে হবে ‘আইনের শাসনকে সুরক্ষিত করা’ ও ‘জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া’র অধীনে। আরও বলছেন, ‘আইনসভা, প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থার কেন্দ্রীয় ভাবনায় থাকতে হবে ‘আইনের শাসন’ তথা ‘সুশাসন’। বড়গলায় আরও দাবি করছেন, এসব হল ‘উদ্ভাবনী রূপায়ণের’ বিষয়। এইসব কথার ফুলঝুরি ছড়িয়ে মোদী জমানা হয়ে দাঁড়িয়েছে কালা কানুন আর পুলিশী উৎপীড়ন চালানো নজিরবিহীন এক কুশাসন। ইউএপিএ ইত্যাদি অগণতান্ত্রিক আইনকানুন প্রয়োগ করার সাথে সাথে রাজ্যে রাজ্যে শাসনক্ষমতার জোরে লাগু করছে আরও জঘন্য সব কানুন, যেমন ব্যক্তির নিজের পছন্দের অধিকার বিরোধী ‘লাভ জেহাদ’ আইন। ঝাঁপিতে রেখেছে নাগরিকত্ব কোতল করার সংশোধনী আইন সিএএ। বিজেপি এভাবে স্বমূর্তি ধারণ করছে ফ্যাসিবাদেরই।

ন্যাশানাল ক্রাইম রেকর্ডস্ ব্যুরোর তথ্যে জানা যাচ্ছে ভয়ঙ্কর সত্য। ২০১৬-১৯ পর্বে ইউপিএ আইনে গ্রেপ্তারের সংখ্যা ছিল ৫৯২২, তার মধ্যে সাজাপ্রাপ্ত সংখ্যা ১৩২; কেবলমাত্র ২০১৯ সালে সিডিশান আইনে গ্রেপ্তারের সংখ্যা ছিল ৯৬, সাজা হয় ২ জনের, ছাড়া পান ২৯ জন। ধৃতদের লিঙ্গ, জাতি, বর্ণ, ধর্ম ও শ্রেণী পরিচিতি এনসিআরবি-র উপরোক্ত রিপোর্টে এখনও নেই। যাই হোক, ঐ রিপোর্ট থেকেই পরিষ্কার মোদীতন্ত্রে চলছে কেমন সাংবিধানিক গণতন্ত্র! ‘দেশ রক্ষা’র ধূয়ো তুলে চলছে কেমন ‘আইনের শাসনের’ যথেচ্ছ কেন্দ্রীকরণ! রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস এখন প্রতিটি রাতদিনের ঘটনা। তার জেরে বিধ্বস্ত হচ্ছে মানুষের দাবিসনদ, জনগণের রাজনৈতিক গণতন্ত্র।

ভারত শাসনের এই ‘মহিমা’র প্রেক্ষাপট যাদের, সেই বিজেপি ঝাঁপাচ্ছে বাংলায়। আসন্ন নির্বাচনকে পাখির চোখ করে। ফেরি করছে ক্ষমতায় আনলে সব দাবি পুষিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি। আবেদন করছে ক্ষমতায় আসার সুযোগ দেওয়ার জন্য। বলছে প্রতিষ্ঠা করবে ‘আইনের শাসন’! গড়বে নাকি ‘দুর্নীতিমুক্ত সোনার বাংলা’! ফেরাবে ‘সন্ত্রাসমুক্ত গণতন্ত্র! এটাই ফ্যাসিবাদের স্বরূপ। মগজে হানা দেয়, হাতছানি দেয়। ছলচাতুরিতে ওস্তাদি দেখায়। কিন্তু ভুললে চলবে না গুজরাট থেকে উত্তরপ্রদেশে, আসাম থেকে ত্রিপুরায় মানুষের কি হাল করছে বিজেপি! সব মনে রাখতে হবে।

খণ্ড-28
সংখ্যা-7