খবরা-খবর
একুশের ডাক : ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বাংলা রুখে দাঁড়াক
convention

“একুশের ডাক, মানুষের দাবি – নাগরিক কনভেনশন” শীর্ষক এক মঞ্চ ৮ ফেব্রুয়ারী মৌলালী যুবকেন্দ্রে এক কনভেনশন আয়োজন করে। উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন অভিনেতা কৌশিক সেন, রাজনৈতিক নেতা দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, সংগীতশিল্পী মৌসুমী ভৌমিক, শিক্ষাবিদ কুমার রানা, দলিত সাহিত্যিক মনোরঞ্জন ব্যাপারী, অধ্যাপক মেরুনা মুর্মু, নাট্যকার-পরিচালক তীর্থঙ্কর চন্দ, সমর বাগচী সহ বিভিন্ন বিশিষ্টজন। কনভেনশন শুরু হয় অগ্নিবীণা সাংস্কৃতিক সংস্থার উদ্বোধনী সঙ্গীতের মাধ্যমে। কৃষক আন্দোলনের শহীদ, লকডাউনে মৃত শ্রমিক ও উত্তরাখণ্ডের সাম্প্রতিক বিপর্যয়ে মৃতদের স্মরণ করে শোক প্রস্তাব পাঠ করেন সনৎ রায় চৌধুরী। কনভেনশনের মূল উদ্দেশ্য সংক্ষেপে তুলে ধরে দাবিসনদ পেশ করেন কুমার রাণা। কনভেনশনের মূল প্রস্তাব পাঠ করেন শামিম আহমেদ।

সিপিআই(এমএল)-এর সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য তাঁর আলোচনায় বলেন, “২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর বিজেপি’র অমিত শাহ্‌ বলেছিলেন আমরা ৫০ বছর ক্ষমতায় থাকব, এই ভাবনা ভারতবর্ষের গণতন্ত্রের জন্য অত্যন্ত বিপদজ্জনক। বর্তমানে সারা দেশে কাজের অভাব, খাদ্যের অভাবের মধ্যে সরকার প্রতিনিয়ত বেসরকারীকরণ করে যাচ্ছে, এর ফলে সারা দেশে পুনরায় কোম্পানি রাজ শুরু হচ্ছে। আম্বানি-আদানিরা হচ্ছে স্বাধীন ভারতের নতুন কোম্পানি।” তিনি বলেন, “সংবিধানে সাধারণ মানুষের ভোট দেয়ার অধিকার রয়েছে, কিন্তু সেই ভোট দানের অধিকারকেও বারবার ক্ষুণ্ণ করে দেওয়া হচ্ছে। সেখানে মানুষের দাবি, মানুষের কথা, মানুষের অধিকার বাদ দিয়ে শুধুমাত্র টাকা ও ক্ষমতার জোর দেখিয়ে সেই ক্ষমতাতেই টিকে থাকার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। আমরা লক্ষ করেছি আমেরিকায় ট্রাম্প হেরে যাওয়ার পরেও ক্রমাগত নানারকমের বিদ্বেষমূলক কাজকর্ম করে ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা করে গেছেন। কিন্তু সেই প্রচেষ্টা সফল হয়নি সেখানকার মানুষ, মিডিয়া’র সম্মিলিত প্রতিবাদের জন্য। আমাদের দেশেও সেইরকমভাবে প্রতিবাদ করে ফ্যাসিস্তদের হটানোর ব্যবস্থা করতে হবে।”

কৃষক আন্দোলন ও বিহারের নির্বাচন প্রসঙ্গে দীপঙ্কর বলেন, “বিহারে আমরা অল্পের জন্য বিজেপিকে আটকাতে ব্যর্থ হয়েছি। কিন্তু বর্তমানে বিহারে একটি দুর্বল সরকার এবং একটি শক্তিশালী বিরোধী দল রয়েছে। বিহারে আমাদের আন্দোলন বা নির্বাচনে সাফল্য একদিনে হয়নি, আমরা ক্রমাগত মার খেয়েছি, আমাদের কমরেডরা শহিদ হয়েছেন, কিন্তু আমরা কখনও-ই লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ে যাইনি, তাই আজ আমাদের এই সামান্য সাফল্য। বিজেপি সরকার নানা জায়গায় সাংসদ-বিধায়ক কিনে বেড়ালেও কৃষকদের এখনও কেনার সাহস দেখাতে পারেননি। সুতরাং বুঝতে হবে কৃষকদের এই আন্দোলন-ই আমাদের এই মুহূর্তে পথ দেখাতে পারে!”

কনভেনশন মঞ্চ থেকে ১০টি দাবি সনদ প্রস্তাব করা হয় এদিন। তার সপক্ষে আলোচনা করেন মেরুনা মুর্মু। তিনি বলেন, “ভোট এলেই একগুচ্ছ ম্যানিফেস্টো প্রকাশ করা হয়, তারপর সেসবের কোনও খবর থাকে না। একজন আদিবাসী হিসেবে এই কথাগুলি বলা খুব প্রয়োজন যে, বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার আমাদের উপর যে আঘাত নামিয়ে আনছে এতে করে আগামী দিনে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিই নষ্ট হয়ে যাবে। উন্নয়নের নামে ক্রমাগত বন ধ্বংস করে সেখানকার মানুষের পাশাপাশি প্রকৃতিরও বিশাল ক্ষতিসাধন চলছে। এই আগ্রাসন বন্ধ হওয়া উচিৎ।”

convention

 

কনভেনশনে গৃহীত ১০টি প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে, বিজেপি সরকারের তৈরি তিনটি কৃষি আইন বাতিল, বিদ্যুৎ বিল ২০২০ প্রত্যাহার, শ্রমিকের অধিকার কেড়ে নেওয়া শ্রম আইন বাতিল, ন্যূনতম মজুরি ৭০০টাকা করা, বিরোধী মতের উপরে আক্রমণ বন্ধ করা, এনআরসি রদ করা, মানুষের নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণে আনা, রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি প্রদান, সরকারী সংস্থা বিক্রি বন্ধ করা, নতুন শিক্ষানীতি আইন ২০২০ বাতিল করা ইত্যাদি। এছাড়া আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে কেন্দ্রের শাসক দল যেভাবে বাংলায় ক্ষমতা দখল করতে চাইছে, সেই প্রয়াসকে বয়কট করে সুস্থ গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য আবেদন জানানো হয় সকলকে।

এদিনের সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চের পক্ষে সামিরুল ইসলাম বলেন, “আরএসএস যেভাবে গ্রামে কাজ করছে, আমাদের আর-ও জোরদারভাবে কাজ করতে হবে। না হলে বাংলার সংস্কৃতি ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যাবে। আমাদের গ্রাম থেকে শহরে প্রতিরোধ গড়ে তুলে ক্রমাগত লড়াই করে যেতে হবে।”

ভাষণ পর্ব শেষে সংগীত পরিবেশন করেন মৌসুমী ভৌমিক, অভিজিৎ বসু ও পল্লব কীর্তনিয়া। কনভেনশনের সাফল্য কামনা করে বার্তা পাঠান সমাজবিজ্ঞানী পার্থ চট্টোপাধ্যায়।

আগামী ২১ ফেব্রুয়ারী ভাষা দিবস উপলক্ষে বাংলা ভাষা রক্ষা, গণতন্ত্র রক্ষা, আসন্ন নির্বাচনে ফ্যাসিবাদী শক্তিকে পরাজিত করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার প্রক্রিয়া গ্রহণসহ বাংলার সংস্কৃতিকে যেভাবে বিষাক্ত করে দেওয়া হচ্ছে তার প্রতিবাদে শহর কলকাতার বুকে এক মিছিলের আহ্বান জানানো হয়েছে মঞ্চের তরফ থেকে।

রাজনৈতিক দলগুলির দৈনন্দিন প্রচারের বাইরে সমাজের অন্যান্য অংশের প্রতিনিধিদের আহূত এই কনভেনশনের বৈশিষ্ট্য ছিল, এঁদের আহ্বায়কবৃন্দের পরিচিতি, যাঁদের অধিকাংশই রাজনীতির মানুষ হিসেবে পরিচিত নন। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি আগ্রাসন প্রতিরোধ করতে সকলে যে যাক মতো করে এককাট্টা হচ্ছেন, এ এক বড় ঘটনা বৈকি! পাওনাও বটে!

- রিপোর্টঃ সৌরব চক্রবর্ত্তী, গুরুচণ্ডালী

খণ্ড-28
সংখ্যা-5