প্রতিবেদন
বিকিকিনির হাট বসেছে দিল্লীতে
Sale Sale

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক বেচে দিচ্ছে সরকার। সাম্প্রতিক বাজেটে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন বেসরকারীকরণের একটি ব্যাপক পরিকল্পনা উন্মুক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন চারটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সরকারের সামান্য, যতটুকু না হলেই নয়, উপস্থিতি থাকবে। এই চারটি ক্ষেত্র হল -- নিরাপত্তা ও আণবিক শক্তি; যানবাহন ও টেলিকম; বিভিন্ন জ্বালানি যেমন তেল, কয়লা, ইত্যাদি; বিমা, ব্যাঙ্কিং এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক পরিষেবা। এর বাইরে সমস্ত সরকারি সংস্থা বেসরকারী করে দেওয়া হবে, আর যদি সেগুলির কোনো ক্রেতা না পাওয়া যায় তো বন্ধ করে দেওয়া হবে। এর অর্থ ২৬৪টি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার ওপর খাঁড়া ঝুলছে, লাখো কর্মচারির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। আরও অনেক কিছু তারা ধনকুবেরদের হাতে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে -- যে সব রাস্তা, হাইওয়েতে টোল তোলা হয়, মালবাহী রেলের করিডর, প্রাকৃতিক গ্যাসের পাইপলাইন, বিমানবন্দর, আড়ত বা গুদাম, স্টেডিয়াম, সরকারী জমি -- সব!

আমরা এই লেখাটিকে ব্যাংক বিক্রির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখব। অর্থমন্ত্রী বলেছেন দু’টি সরকারী ব্যাংক বেসরকারী করা হবে। কোন দু’টি? বাজারে এই নিয়ে নানা উড়ো খবর। কেউ বলছেন যে ব্যাংকগুলির সংযুক্তিকরণ (মার্জার) হয়নি সেগুলিকেই ঝাড়পোঁচ করে বেচে দেওয়া হবে। কেউ বলছেন না সদ্য মার্জার হওয়া পাঁচটি ব্যাংকের থেকে যে দু’টির অনুৎপাদক সম্পদ (এনপিএ) কম, যাদের আভ্যন্তরীণ কর্মসংস্কৃতি, পরিষেবা তুলনামূলকভাবে ভালো এবং যে দু’টি অধিক লাভজনক সেগুলিই বেচা হবে। ছ’টি ব্যাংকের এখনো সংযুক্তিকরণ হয়নি -- সেন্ট্রাল ব্যাংক, ইন্ডিয়ান ওভারসিজ ব্যাংক, ইউকো ব্যাংক, ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া, ব্যাংক অফ মহারাষ্ট্র এবং পাঞ্জাব এন্ড সিন্ধ ব্যাংক। এরমধ্যে প্রথম তিনটিতে PCA (প্রমট কারেক্টিভ অ্যাকশন) চলছে, অর্থাৎ এই ব্যাংকগুলি এতোই রুগ্ন যে রিজার্ভ ব্যাংক তাদের ঋণ দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। বলাই বাহুল্য কোনও শিল্পপতি রুগ্ন সংস্থার দায় নিতে আগ্রহী হবেন না, ঝুঁকি আছে এমন কোনও কিছুর দায়িত্ব নিতে তাঁরা চিরকালই অপারগ। রক্ষণশীল মতামত হচ্ছে ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া’র মতো বড় ব্যাংকের পরিবর্তে ছোট দু’টি সংস্থা পাঞ্জাব এন্ড সিন্ধ এবং ব্যাংক অফ মহারাষ্ট্র দিয়ে বেসরকারীকরণের পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করা যেতে পারে। সম্প্রতি এই দু’টি ব্যাংকে পুঁজি ঢেলে কেন্দ্রীয় সরকার এগুলির অনুৎপাদক সম্পদ সাফ করে দিয়েছে যাতে এগুলি ক্রেতাদের কাছে আকর্ষনীয় হয়ে ওঠে। এই লক্ষ্যে বিওএম ও পিএসবি যথাক্রমে ৭,৮০০ এবং ৫,৫০০ কোটি টাকা সরকারের থেকে পেয়েছে।

দ্বিতীয় সম্ভাবনা হল যে পাঁচটি শক্তিশালী ব্যাংক সংযুক্তিকরণের পর তৈরি হয়েছে, তার মধ্যে প্রধান দু’টি, ব্যাংক অফ বরোদা এবং পাঞ্জাব ন্যাশানাল ব্যাংককে দিয়ে বেসরকারীকরণ পর্ব শুরু করা। পিএনবি’র প্রায় ১৫,০০০ কোটি টাকার ঘোটালা সম্পর্কে আমরা অবহিত এবং সেই টাকা পুনরুদ্ধারের আর যে বিন্দুমাত্র সম্ভাবনাও নেই তাও আমরা জানি। তা সরকার নিজেই ঐ ব্যাংকে ১৬,০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে সেটিকে লাভজনক করেছে। একইভাবে বিওবি’তে ৭,০০০ কোটি টাকা দিয়ে সেটির অনুৎপাদক সম্পদ অনেকটা সাফ করা হয়েছে (পুঁজি বিনিয়োগের সূত্রঃ wishfin.com)। এছাড়া বাজেটে একটি ‘ঋণ পূনর্গঠন সংস্থা’ তৈরি করার প্রস্তাব আছে যাতে অনুৎপাদক সম্পদ এই সংস্থায় সরিয়ে দেওয়ার সুযোগ থাকবে এবং ব্যালান্সশীট পরিষ্কার রাখা যাবে। অনুৎপাদক সম্পদ সাফ রাখার ব্যাপারে সরকার মুক্তহস্ত, কারণ তার অন্তরঙ্গ ভুইফোঁড় ব্যক্তিরাই, যেমন নীরব মোদী, এনপিএ সৃষ্টি করার প্রধান কারিগর। এরজন্য তারা ব্যাংকে পুঁজি ঢালবে, অন্যত্র সরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করবে আরও গুরুত্বপূর্ণ এনপিএ মুছে ফেলবে (Write-off)। অনাদায়ী ঋণ কী হারে মকুব হচ্ছে জানলে তাজ্জব বনে যেতে হয়। ২০১৯-২০’র প্রথম ত্রৈমাসিকে ১০টি ব্যাংকের ১৯,০০০ কোটি টাকা মকুব করা হয়েছে। মোদী জমানায় অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। ২০১৫’র ৩১ মার্চে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে মোট অনাদায়ী ঋণ ছিল ২.৭৯ লক্ষ কোটি টাকা যা ২০১৯-এ হয়ে দাঁড়ায় ১০.৩৬ কোটি টাকা। বলাই বাহুল্য একই সাথে অনাদায়ী ঋণ মকুব, যার প্রায় পুরোটাই কর্পোরেট ঋণ তাও তাল মিলিয়ে বেড়েছে -- ২০১৫ সালে সেটা ছিল ৪৬,১৭৯ কোটি টাকা, ২০১৯-এ সেটা উল্লম্ফন ঘটে হয়েছে ২৫৪,০০০ কোটি টাকা (সূত্রঃ আইসিআরএ-ইনভেস্টমেন্ট ইনফরমেশন এন্ড ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি)।

পিএনবি ও বিওবি বিক্রিতে সরকার বেশি উৎসাহিত হবে কারণ এতে দাম বেশি পাওয়া যাবে। ক্রেতারাও বড় ব্যাংক কিনতে বেশি আগ্রহী হবে কারণ দেশজুড়ে এদের শাখার সংখ্যা, গ্রাহক, মোট আমানত ছোট ব্যাংকের থেকে অনেক বেশি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কিনবেটা কে? এখানে ক্রনোলজি বোঝার দরকার আছে। প্রথমে সরকার বলল মার্জার প্রয়োজন কারণ এতোগুলো ছোট ব্যাংকের পরিবর্তে আমাদের বড় এবং টেকসই ব্যাংক দরকার যা আন্তর্জাতিক স্তরে প্রতিযোগিতা করতে পারবে। খুব ভালো ১৩টি ব্যাংক সংযুক্ত হয়ে ৫টি হয়ে গেল। এবার রিজার্ভ ব্যাংক হালকা করে কর্পোরেট ব্যাংকের প্রস্তাব বাজারে ভাসিয়ে দিল। রঘুরাম রাজন যিনি গভর্নর থাকার সময়ে এই প্রস্তাব নাকচ করেছিলেন, তিনি এবং সমমনস্ক অন্যরা সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করলেন। শীর্ষ ব্যাংক ব্যাপারটা চেপে গেল। এবার বাজেটে বেসরকারীকরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। এখন যুক্তি দেখানো হচ্ছে শুধু বড় ব্যাংক হলেই হবে না, সংস্থা পরিচালনায় পেশাদারিত্ব দরকার নাহলে আন্তর্জাতিক স্তরে পাল্লা দেওয়া যাবে না। তাহলে বেসরকারী হলেই কি পেশাদারিত্ব এসে যাবে? কর্পোরেট ব্যাংকের ওপর ইদানিং এই পত্রিকায় একটি লেখায় দেখানো হয়েছে কতগুলি প্রাইভেট ব্যাংক হয় উঠে গেছে কিংবা কোনও সরকারী ব্যাংককে বাধ্য করা হয়েছে সেগুলিকে উদ্ধার করতে। রিজার্ভ ব্যাংক বলছে ২০২০-তে বেসরকারী ব্যাংকের এনপিএ বৃদ্ধি পেয়েছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিগত অর্থনৈতিক বছরে প্রাইভেট ব্যাংকে ৫৩,৯৪৯ কোটি টাকার ঋণ রাইট অফ করা হয়েছে (সূত্রঃ আরবিআই-বিজনেস ইনসাইডার ইন্ডিয়া)। বেসরকারী ব্যাংক দক্ষ, এনপিএ হয় না এসব স্রেফ সরকারি প্রচার। সুতারাং এটা পরিষ্কার বেসরকারী ব্যাংকগুলি নিজেরাই টলোমলো, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা কেনার অবস্থায় তারা নেই।

তাহলে কে কিনবে এই দুটি ব্যাংক? ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সম্ভাব্য ক্রেতা হিসাবে সেই কর্পোরেট সংস্থাগুলির নামই উঠে আসবে। আবারও বলতে হয় কোনো কর্পোরেট সংস্থা ব্যাংক চালানোর অর্থ দাতা ও গ্রহীতা এক হয়ে যাবে, বাণিজ্যিক পুঁজি ও ব্যাংক পুঁজি হবে একাকার। ‘কানেকটেড’ লেন্ডিং, অর্থাৎ যে ঋণ দিচ্ছে এবং যে ঋণ নিচ্ছে দুজনে সম্পর্কের অথবা ব্যবসার সূত্রে পরস্পরের অন্তরঙ্গ বা ঘনিষ্ঠ। ‘কানেকটেড’ লেন্ডিং বাস্তবে ‘ক্রোনি’ লেন্ডিং। ঋণগ্রহীতার ব্যবসার ঠিক মতো যাচাই হয় না, তাঁর লেনদেনের মূল্যায়ন করা হয়না, শুধুমাত্র মালিক/পরিচালকের সাথে সম্বন্ধ বা যোগসাজশের কারণে তাকে সাধারণ মানুষের গচ্ছিত অর্থ পাইয়ে দেওয়া হয়। বিজেপি সরকারের গোঁড়া সমর্থক, দুঁদে অর্থনীতিবিদরাও বলছেন কর্পোরেট যদি ক্রেতা হয় তাহলে ব্যাংক শিল্পে বিপর্যয় অবধারিত। তাহলে আর কে ক্রেতা হতে পারে? বিদেশী ব্যাংক? ছোট করে এই পরীক্ষাও শুরু হয়ে গেছে, লক্ষ্মী বিলাস ব্যাংককে উদ্ধার করতে সিঙ্গাপুরের ডিবিএস ব্যাংক এগিয়ে এসেছে। আত্মনির্ভরের নাম করে নিখাদ দেশীয় শিল্পে বিদেশী হানার সূত্রপাত। মিনমিন করে কিছু প্রতিবাদ হয়েছে, আরও অনেক কিছুর মতো সরকার এটাকেও তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছে।

সাধারণ মানুষের কি কিছু যায় আসে যদি ব্যাংক বেসরকারী হয়ে যায়? সরকার দীর্ঘদিন ধরে সুকৌশলে মানুষকে এটা বুঝিয়েছে যে ব্যাংক কর্মচারিরা সুবিধাভোগী, বেশি মাইনে পায়, ফাঁকিবাজ ইত্যাদি ইত্যাদি। ব্যাংক ধর্মঘট হলে অনেকেই বিরক্ত হন। বৃহৎ সংবাদপত্র উস্কে দেয় -- সর্বনাশা ধর্মঘট। এতে কর্মচারিদেরও দায় আছে। মানুষের গণতান্ত্রিক দাবিদাওয়ার পক্ষে তাঁদের খুব কমই সরব হতে দেখা গেছে। এই সম্পর্ক মেরামত করা অতীব প্রয়োজন। বিভিন্ন কারণে গ্রাহকরা নাজেহাল -- আমানতের ওপর সুদ কমছে, উল্টোপাল্টা চার্জ কাটা হচ্ছে, নেটওয়ার্ক সমস্যার জন্য পরিষেবা ব্যাহত হচ্ছে। গত বাজেটে ব্যাংকে জমা টাকার ওপর বিমা এক থেকে বাড়িয়ে পাঁচ লক্ষ করা হয়েছিল। এবারের বাজেটে বলা হল যে সেই টাকা পেতে বিলম্ব যাতে না হয় সেটা নিশ্চিত করা হচ্ছে। হঠাৎ কেন এই কথা উঠে এলো? তবে কি অতীতের মতো ব্যাংক ফেইল হওয়ার সম্ভাবনা আছে? গ্রাহকদের বোঝাতে হবে শিয়রে সমন! ব্যাংক ধর্মঘটে গ্রাহকদের শামিল করতে হবে, লাগাতার প্রচারের জন্য কর্মচারি-গ্রাহক যৌথ কমিটি করতে হবে। ব্যাংকের আন্দোলন যদি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয় তাহলেই একমাত্র এই সরকারকে সবক শেখানো যেতে পারে, বেসরকারীকরণের ভূত তাদের ঘাড় থেকে নামতে পারে।

- সোমনাথ গুহ  

খণ্ড-28
সংখ্যা-6