প্রতিবেদন
ডিজিটাল ফরেন্সিক তদন্তে ফাঁসবিজেপির কুটিল দলিত-বিরোধী ষড়যন্ত্র
digital

মহারাষ্ট্রের ভীমা কোড়েগাঁওতে ২০১৮ সালে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি দলিতদের জমায়েতে হামলা করে দাঙ্গা পরিস্থিতি তৈরী করে। একজনের মৃত্যু হয় সেই ঘটনায়। সবাইকে অবাক করে ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশান এজেন্সি সেই সময় ভীমা কোরেগাঁও ঘটনাকে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের একটি অংশ বলে দাবি করে। এরকম প্রচার করা হয় যে মাওবাদীরা এই ষড়যন্ত্রে জড়িত। প্রায় সাথেই সাথেই বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের কর্মীকে গ্রেপ্তার করা শুরু হয়। তাদের মধ্যে রয়েছেন রোনা উইলসন, শুধা ভারাদ্বয়াজ, ভারভারা রাও, স্ট্যান স্বামী এবং আরো অনেকে। এরা প্রায় প্রত্যেকেই মোদী সরকারের প্রকাশ্য সমালোচক ছিল। কোন হিন্দুত্ববাদী কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয় না। এনআইএ দাবি করে যে এঁদের কাছ থেকে বাজেয়প্ত করা ল্যাপটপগুলি থেকে এমন অনেক চিঠি কাগজ পাওয়া গেছে যা এই ষড়যন্ত্রকে প্রমাণিত করে। অভিযুক্তরা বারবার বলেন যে উক্ত চিঠিগুলি কোথা থেকে তাঁদের ল্যাপটপে এল তা তাঁরা জানেন না।

সম্প্রতি আর্সেনাল কন্সাল্টিং নামে এক বেসরকারী ডিজিটাল ফরেন্সিক সংস্থা উক্ত ল্যাপটপগুলির ওপর একটি তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। তারা রোনা উইলসানের ল্যাপটপের বৈদ্যুতিক কপি বিশ্লেষণ করেছে রোনার উকিলের অনুরোধে। এনআইএ-র দাবি মতো রোনার ল্যাপটপেই সব থেকে জোরালো প্রমাণ স্বরূপ চিঠিটি পাওয়া গিয়েছে। সেই চিঠিতে রোনা একজন মাওবাদী কমান্ডারের কাছে অস্ত্র চাইছে মোদীকে খুন করার জন্যে। কিন্তু ফরেন্সিক তদন্ত রিপোর্ট দিখিয়ে দিয়েছে যে এনএইএ যেইসব প্রমাণের কথা বলছে সেই সব প্রমাণ রোনার ল্যাপটপে বাইরে থেকে ঢোকানো হয়েছে। তাদের বক্তব্য প্রায় ২০১৬ থেকে এই চিঠিগুলো ল্যাপটপে ঢোকানো শুরু হয়। ২০১৮ অবধি এই চিঠি গুলো ধীরে ধীরে রোনার ল্যাপটপে একটি হিডেন ফোল্ডারে রাখা হয়। রোনার ল্যাপটপে এই জিনিসটি করা হয় ‘নেট ওয়্যার’ নামে একটি ম্যালওয়্যার সফটওয়্যারের মাধ্যমে। ২০১৬-তে রোনারই এক পরিচিত তাকে একটি ইমেল পাঠায়। সেই ইমেলে একটি লিঙ্ক ক্লিক করতে বলে তাকে কিছু সিভিল গ্রুপের স্টেটমেন্ট ডাউনলোড করার জন্যে। ক্লিক করতেই নেট ওয়্যার নামে এই সফট ওয়্যার তার ল্যাপটপে ঢুকে যায়। নেট ওয়্যার ব্যবহার করে হ্যাকার ল্যাপটপটিকে ইন্টারনেটের মধ্যে দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং কীবোর্ডে যা টাইপ করে হচ্ছে রেকর্ড করতে পারে। এর মাধ্যমে যেকোন ফাইল ল্যাপটপে ঢোকানো যায় এবং বার করা যায় এবং সমস্ত পাসওয়ার্ড ও পেয়ে যায় সে। আর্সেনাল বলেছে যে এত লম্বা সময় ধরে হ্যাকিং এর ঘটনাও তারা খুব একটা দেখেনি। তারা এই ল্যাপটপটা প্রায় ৩০০ ঘন্টা ব্যয় করে বিশ্লেষণ করেছে। এই সংস্থা বোসটন বম্বিংএর ডিজিটাল ফরেন্সিক বিশ্লেষণ করেছিল। এটাও দেখা যাচ্ছে যে যেই ইন্টারনেট প্রোভাইডার এড্রেস এবং সাইট থেকে রোনার ল্যাপটপে এই আক্রমণটা হয়েছে অন্য অভিযুক্তদেরও সেই একই জায়গা থেকে আক্রমণ করা হয়েছে।

রোনার আইনজীবী জানিয়েছেন, এই রিপোর্টের পর বোঝা যাচ্ছে যে তার ক্লায়েন্টের বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যে। সে বম্বে হাইকোর্টে এই রিপোর্ট জমা দিয়ে পিটিশান করেছে তার ক্লায়েন্টকে এখুনি অভিযোগ থেকে মুক্ত করতে। এনএইএ জানিয়েছে যে তাদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী রোনার ল্যাপটপ ম্যালওয়্যার দ্বারা আক্রান্ত হয়নি। এর আগে টার্কিতে এক সাংবাদিকেকে সন্ত্রাসবাদী মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছিল। আর্সেনাল দেখায় যে প্রমাণগুলি তার কম্পিউটারে হ্যাক করে ঢোকানো হয়েছে। তাকে টার্কির কোর্ট মুক্তি দেয়।

এই কেস নিয়ে ‘সংযুক্ত জাতিরাষ্ট্র’ নিজেদের গভীর চিন্তা ব্যক্ত করেছে আগেই এবং সরকারকে অভিযুক্তদের মুক্তি দিতে বলেছিল। ২০১৯ সালে অভিযুক্তদের যারা সাহায্য করছিল তাদের তিন জনের মোবাইল ল্যাপটপ পেগাসাস স্পাইওয়্যার দ্বারা আক্রান্ত হয়। এই সফটওয়্যারটির জনক কোম্পানি এই ধরণের সফটওয়্যার কেবলমাত্র কোনও দেশের জাতীয় সরকারকেই বিক্রি করে থাকে। মোদী সরকার এই পেগাসাস কান্ডকে সরাসরি অস্বীকার করেনি, উত্তরে কেবল বলেছিল যে, অনুমতি ছাড়া কোনও কাজ তার সরকারের কোনো কর্মচারি করেনি।

এই পুরো ঘটনাক্রম থেকে বোঝা যাচ্ছে এক দীর্ঘমেয়াদী ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন এই সামাজিক কর্মীরা। এরা প্রায় অনেকেই সমাজের অত্যন্ত পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য কাজ করতেন এবং কঠিন পরিস্থিতিতে জীবন কাটিয়েছেন। এদের বিরুদ্ধে এরকম ষড়যন্ত্র ভারতীয় গণতন্ত্রেরর জন্য ঘনিয়ে আসা ভয়ানক বিপদ ও দলিত সমাজের প্রতি বিজেপির কুটিল হিংসাকে প্রকটভাবে দেখিয়ে দেয়।

- প্রত্যূষ নন্দি

খণ্ড-28
সংখ্যা-5