প্রতিবেদন
আইটি সেলের ভগ্নদশা?
BJP IT cell

বিজেপি কি সোশ্যাল মিডিয়ার জগতে কোণঠাসা হয়ে পড়ছে? এতদিন আমরা জানতাম, প্রবল-প্রখর এক আইটি সেলের অস্তিত্বের কথা, যার এক পোস্ট বা ট্যুইটে সারা দেশের জনতা নাকি উদ্বেলিত হয়ে উঠতেন। সত্য-মিথ্যা মিশ্রিত সে বাচনে নাকি দেশ জুড়ে এমন এক ঐকমত্য নির্মাণ হয়েছিল, যার তুমুল প্রতাপের কাছে আর সব তর্ক, ভাবনা বানের জলে ভেসে গিয়েছিল। যে বা যারা ওইসব বয়ানের বিরুদ্ধে কিছু বলতেন বা লিখতেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁদের জবাই করা হত। শুধু তাই নয়, আইটি আইনের নানান ধারায় তাঁদের জেলে পোরাও ছিল এক সহজ-সরল নিদান। সে সব সুখের দিন কি অবশেষে সমাগত প্রায়?

নয়তো, পপস্টার রিহানের এক প্রশ্নসূচক বা গ্রেটা থুনবার্গের কিছু অতি-নিরীহ ট্যুইটে ভারত সরকারের পররাষ্ট্র দফতর অমন রে রে করে মাঠে নেমে পড়বে কেন? শুধু তাই নয়, স্বয়ং বিদেশ মন্ত্রী মহাশয় পর্যন্ত এ বিষয়ে মুখ খুলে একচোট বীরত্ব দেখিয়েছেন। এরপর আইটি আইনের নানান ধারা দেখিয়ে সরকার ঘাড় ধরে ট্যুইটারের ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে কিছু কসরত শেখাবারও চেষ্টা করেছে। প্রথম রাউন্ডে তারা ট্যুইটার কর্তৃপক্ষকে প্রায় ২৫০ অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেবার নির্দেশ পাঠায়, যদিচ সে নির্দেশ পেয়ে সেইসব অ্যাকাউন্ট বন্ধও করে দেয় ট্যুইটার, কিন্তু ঘন্টা ছয়েক পরে তা আবার প্রত্যাহার করে। ট্যুইটারের সিইও জ্যাক ডর্সি জানান, ট্যুইটার মতপ্রকাশের অধিকারকে স্বীকার করে। এইসব বাক্য বিনিময়ে দিল্লীর অধিপতিরা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং হুমকি দেন যে ট্যুইটার কর্তৃপক্ষ যদি তাঁদের নির্দেশানুযায়ী হাজারের ওপর ট্যুইটার অ্যাকাউন্টের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয় তাহলে আইটি আইন মোতাবেক সরকার ট্যুইটারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। সেই ব্যবস্থায় ট্যুইটারের ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাত বছর অবধি জেল হতে পারে। ট্যুইটারের পক্ষ থেকে আইটি মন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু মন্ত্রী সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে তাদের তাঁর দফতরের আমলাদের সঙ্গে কথা বলার নির্দেশ দেন। একটি নড়বড়ে আলোচনা হয় এবং সরকারের নির্দেশে ট্যুইটার অ্যাকাউন্টের ৯৭ শতাংশ সরকার কর্তৃক চিহ্নিত ট্যুইটার ভারতীয় ট্যুইটার কর্তৃপক্ষ নিষ্ক্রিয় করে দেয়।

কিন্তু কী এমন ঘটল যে এতদিনের সাধের সৌধ সোশ্যাল মিডিয়া সম্পর্কে বিজেপি-আরএসএস এতটা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল? বলাই বাহুল্য, আসলে সোশ্যাল মিডিয়ায় আইটি সেলের আধিপত্য আজ ক্রমশই সংকুচিত হয়ে আসছে। এক সময়ে যেখানে এই কুখ্যাত সেল সংগঠিতভাবে একক আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারত, যে কোনও ঘটনায় তাদের নিজেদের বয়ান পেশ করে সেগুলিকে জনপ্রিয় করে নিজেদের অনুকূলে চলমান ঘটনাবলীকে মোড় ঘোরাতে পারত, আজ তাদের সে দাপট ম্রিয়মান। মানুষের এক বড় অংশ তাদের জুমলাবাজি ধরে ফেলেছে এবং সক্রিয় ভাবে তাদের বিরুদ্ধে স্বর তুলে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। এই স্বর এখন সোশ্যাল মিডিয়ার অন্দরেও ঝড় তুলেছে। পাশাপাশি, দিল্লীর সীমান্তে কৃষক জমায়েত ও গত ৭০ দিনেরও বেশি সময় ধরে তাদের বলিষ্ঠ আন্দোলন ও বিজেপি সম্পর্কে মোহভঙ্গ চারিদিকে এক নতুন সোরগোল তৈরি করেছে। উত্তর ভারত জুড়ে লাখে লাখে কৃষকের মহাপঞ্চায়েত সমস্ত বিভাজনের বাতাবরণকে নস্যাৎ করে মানুষের এক নতুন ঐক্যযাত্রার সূচনা করেছে। সেই দৃপ্ত অভিযান সোশ্যাল মিডিয়ার অন্দরেও আলোড়ন তুলেছে ও বড় জায়গা জুড়ে বিস্তৃতি পেয়েছে। খুব স্বাভাবিক, এই লহরের সামনে উগ্র ধর্মীয় রক্ষণশীল শক্তি আরও বিচ্ছিন্ন হবে ও ফলত ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে। তাই, সোশ্যাল মিডিয়ায় এক সময়ে তাদের রাজ আজ বিবর্ণ ও বিধ্বস্ত।

আপনাদের সকলের মনে আছে, ফেসবুককে হাতিয়ার করে ও তাদের প্রায় প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় কীভাবে ২০১৪ সাল থেকে মোদী ও তাঁর দলবল জনমতকে বিভ্রান্ত ও নিয়ন্ত্রণ করেছে। তা নিয়ে কম হৈচৈ হয়নি। ভারতীয় ফেসবুকের অন্যতম কর্তাব্যক্তি আঁখি দাসের বয়ানে তা স্পষ্টও হয়েছে। তখন এইসব সোশ্যাল মিডিয়ার হাতিয়ারগুলি ছিল তাদের বন্ধু ও সহযোগী। কিন্তু আজ পরিস্থিতি বদলে গেছে।

সাম্প্রতিককালের ট্যুইটার ট্রেন্ডগুলি দেখলে বোঝা যাবে যে মোদী ও বিজেপি সরকারের নীতির বিরুদ্ধে বিভিন্ন হ্যাশট্যাগগুলি একদম ওপরের সারিতে জায়গা পাচ্ছে। এবারের গণ্ডগোলের সূত্রপাত #ModiPlanningGenocideofFarmers হ্যাশট্যাগটি। কৃষক আন্দোলনের নেতা রাকেশ টিকায়েতের সেই মর্মস্পর্শী আবেদনের পর যখন লাখে লাখে কৃষক আবার গাজীপুর, সিঙ্ঘু ও টিকরি সীমান্তে এসে আন্দোলনে নব জোয়ার তৈরি করলেন, ঠিক তার পরপরই এই হ্যাশট্যাগটি ট্যুইটারে কোনও আন্দোলনকারীর পক্ষ থেকে তৈরি করা হয় এবং তা কয়েক ঘন্টার মধ্যেই জনপ্রিয়তার শীর্ষে চলে যায়। এই হ্যাশট্যাগের জনপ্রিয়তা দেখেই বিজেপি নেতাদের মাথা ঘুরে যায় ও তারা পালটা প্রচারে পাঙ্গা নিতে না পেরে ট্যুইটার কর্তৃপক্ষকে ভয় দেখিয়ে একে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়ার উদ্যোগ নেয়। এরপরেই আসে পপস্টার রিহানার খুব সাধারণ প্রশ্নসূচক একটি ট্যুইট যেখানে তিনি সরলভাবে জানতে চান: কৃষকদের এই প্রতিবাদ নিয়ে কি আমরা আলোচনা করতে পারি না? ব্যস, এই সামান্য প্রশ্নবাণেই অগ্নিশর্মা হয়ে গেলেন বিজেপি নেতারা। তারপর এলো গ্রেটা থুনবার্গ ও মীনা হ্যারিসের সমর্থনসূচক বক্তব্য। কাণ্ডজ্ঞান হারালেন বিজেপি নেতারা। বলতে শুরু করলেন যে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিরা নাক গলাচ্ছেন। অথচ, তাদেরই সর্বময় নেতা ও দেশের প্রধানমন্ত্রী আমেরিকায় গিয়ে যখন সমস্ত কূটনৈতিক রীতিনীতি ভেঙে শ্লোগান দিলেন “অব কি বার, ট্রাম্প সরকার”, তখন তা অন্য একটি দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলানোর বিষয় নাকি ছিলনা। কিম আশ্চর্যম!

কিন্তু এইভাবে মিথ্যার ছলনায় কি সত্যকে আড়াল করা যাবে? উত্তাল কৃষক আন্দোলন মানুষের মোহমুক্তি ঘটিয়েছে ও সমস্ত জড়তার অবসান হয়েছে। উপায়ন্তর না পেয়ে বিজেপি’র বাহিনী সোচ্চার ঘোষণা দিয়ে এখন আশ্রয় নিয়েছে ট্যুইটার অনুরূপ ‘কু’ নামক একটি ‘দিশি’ সোশ্যাল মিডিয়ায়। বালিতে মুখ গুঁজলে কি ঝড়ের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়? ট্যুইটার ব্যবহারকারীরা বরং বিজেপি নেতাদের এই প্রয়াসে আমোদ পেয়েছেন ও তাঁরা #RecycleBin হ্যাশট্যাগ করে ট্যুইটারের সমস্ত জঞ্জালকে কু’তে চলে যাওয়ার আবেদন করেছেন। পাশাপাশি, #AmitShahGoBack, #GoBack Modi ইত্যাদি বিবিধ হ্যাশট্যাগ তৈরি হয়ে ট্যুইটারে এক নতুন ঝড়ের সূত্রপাত হয়েছে যা অচিরেই ট্রেন্ডিং’এ একেবারে প্রথম সারিতে উঠে আসছে।

এর পাশাপাশি সংবাদ-ভিত্তিক ইউটিউব ভিডিও এখন খবর সম্প্রচারের মূল গণমাধ্যম হয়ে উঠেছে যা গোদি মিডিয়ার বিকল্প হিসেবে ইতিমধ্যেই জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে গেছে। ‘ন্যাশনাল দস্তক’, ‘দ্য লাইভ টিভি’ ইত্যাদি ইউটিউব ভিত্তিক সংবাদ চ্যানেলের গ্রাহকের সংখ্যা ৪৫ লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে। মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়ার এদের এক্তিয়ার এতদূর যে আপলোডিং’এর ৫ মিনিটের মধ্যেই ভিউয়িং ছাড়িয়ে যাচ্ছে ১০ হাজারের ওপর। সবটা মিলিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় এখন জনমতের ঘুরে যাওয়ার উজ্জ্বল ছবি। বলাই বাহুল্য, আগামী স্বল্প দিনেই আইটি সেলের দাপটের অন্ত বেশ স্পষ্ট। তারা নিজেরাও এখন সে দেওয়াল লিখন পড়তে পারছে।

- অনিন্দ্য ভট্টাচার্য  

খণ্ড-28
সংখ্যা-6