প্রস্তাব
নাগরিক কনভেনশনে গৃহীত প্রস্তাব সমূহ
Demand

কনভেনশনের মূল প্রস্তাব পাঠ করেন শামিম আহমেদ। ধ্বনিভোটে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত এই প্রস্তাবে বলা হয় –

১) বিজেপি সরকারের তৈরি সাম্প্রতিক তিনটি কৃষি আইনকে এই কনভেনশন কৃষিজীবী মানুষ ও জনগণের ওপর হামলা বলে মনে করছে। এই আইনগুলি কৃষিজাত উৎপাদনের দাম ঠিক করা থেকে শুরু করে তা যথেচ্ছ জমিয়ে রাখার অধিকার – সবকিছুকেই সরকারের দায় দায়িত্ব থেকে সরিয়ে আনছে এবং তাকে কোম্পানির অধিকারে পরিণত করছে। এর মধ্যে দিয়ে কৃষক হয়ে যাবে কোম্পানির ভাড়াটে এবং রেশন ব্যবস্থা লাটে উঠবে। সর্বনাশা এই কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে যে কৃষক আন্দোলন চলছে, এই কনভেনশন তার প্রতি সংহতি জানিয়ে মনে করছে বাজেট অধিবেশনের মধ্যেই সংসদে এই কৃষি আইনগুলি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রত্যাহার করে নেওয়া দরকার। সেইসঙ্গে এই কনভেনশন বিদ্যুৎ বিল ২০২০ প্রত্যাহারের পক্ষে মত প্রকাশ করছে।

২) এই কনভেনশন শ্রমিকের অধিকার কেড়ে নেওয়া নয়া শ্রম আইনগুলি বাতিল করার পক্ষে মত প্রকাশ করছে। যে কোনও কাজে ন্যূনতম দৈনিক ৭০০ টাকা (মাসে ২১০০০ টাকা) মজুরি হওয়া প্রয়োজন বলে এই কনভেনশন মনে করছে।

৩) দেশজুড়ে কৃষক, শ্রমিক, বিরোধী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, গণ আন্দোলনের শক্তি, সাংবাদিক সহ যে কোনও বিরোধী মতের ওপর যেভাবে আক্রমণ নামছে – এই কনভেনশন তার তীব্র নিন্দা করছে। এই কনভেনশন ভীমা কোরেগাঁও ঘটনা, এনআরসি, এনপিআর, সিএএ বিরোধী আন্দোলন, নয়া শিক্ষা নীতি ২০২০ বিরোধী আন্দোলন সহ বিভিন্ন ঘটনায় বন্দী সহ সমস্ত রাজনৈতিক বন্দীর মুক্তির পক্ষে মত প্রকাশ করছে।

৪) এই কনভেনশন বিভাজন ও ধর্ম জিগিরের বিরুদ্ধে নির্বাচনী লড়াইতে জনগণের রুটি রুজি গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবিগুলিকে সামনে আনার প্রয়োজন অনুভব করছে। সাংবিধানিক অধিকার, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং গণতন্ত্র রক্ষার লড়াইতে নাগরিক সমাজকে সক্রিয় হওয়ার আবেদন জানাচ্ছে।

৫) কনভেনশন সিএএ-এনআরসি-এনপিআর বাতিলের পক্ষে মত প্রকাশ করছে। দাবি জানাচ্ছে কোনও দেশবাসীর নাগরিকত্ব বা নাগরিক অধিকার নিয়ে প্রশাসনিক হয়রানি চলবে না। সমান নাগরিকত্বের ধারণাকে বদলানোর চেষ্টাকে সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরোধ করার জন্য কনভেনশন সমস্ত নাগরিকের কাছে আহ্বান রাখছে।

৬) বাজেটে সরকারী কোম্পানি বেচে বেসরকারী হাতে তুলে দেওয়ার মাধ্যমে দেশবিক্রির যে নকশা সামনে এসেছে, এই কনভেনশন তার বিরুদ্ধে জনগণকে সোচ্চার হবার আবেদন জানাচ্ছে। ডিজেল, পেট্রোল, রান্নার গ্যাসের লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি এবং কেরোসিন তেলের রেশনিং ব্যবস্থাকে তুলে দেবার প্রতিবাদ করছে এই কনভেনশন।

৭) কেন্দ্রের নয়া শিক্ষানীতি শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ, বেসরকারীকরণ ও পণ্যায়নের দিকে একটা বড় ধাপ। এই কনভেনশন জাতীয় শিক্ষানীতি-২০২০ বাতিলের পক্ষে মত প্রকাশ করছে।

৮) পরিবেশের সঙ্কট সভ্যতার সঙ্কট এই কথা মাথায় রেখে EIA ড্রাফট নোটিফিকেশন 2020 বাতিল করার পক্ষে এই কনভেনশন মত প্রকাশ করছে।

৯) গণতান্ত্রিক পরিসরকে সংকুচিত করার ও বিরোধী কন্ঠস্বরকে দাবিয়ে রাখার বিপজ্জনক প্রবণতার বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গের সচেতন গণতন্ত্রপ্রেমী নাগরিককে ধারাবাহিকভাবে লড়তে হচ্ছে। আসন্ন নির্বাচনে কেন্দ্রের শাসক দলের রাজ্যে ক্ষমতা দখলের মরিয়া প্রচেষ্টা রাজ্যের সামাজিক-রাজনৈতিক বাতাবরণকে আরও বিপন্ন করে তুলছে। এই অবস্থায় আগামী নির্বাচনে ও বৃহত্তর সামাজিক-রাজনৈতিক পরিসরে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে ও অধিকার অর্জনের আন্দোলনকে জোরালো করে তুলতে এই কনভেনশন ব্যাপক গণ সংযোগ ও গণ অংশগ্রহণের আবেদন জানাচ্ছে।

১০) ২১ ফেব্রুয়ারী শুধুমাত্র ভাষার অধিকার রক্ষার দিক থেকেই নয়, গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে ধ্বস্ত করার স্বৈরতান্ত্রিক চেষ্টার বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ লড়াইয়েরও এক উজ্জ্বল অধ্যায়। পশ্চিমবঙ্গের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বহুস্বরিক গণতান্ত্রিক বাতাবরণকে যেভাবে নষ্ট করার চেষ্টা চলছে তার বিরুদ্ধে আগামী ২১ ফেব্রুয়ারী কলকাতার বুকে এক শক্তিশালী প্রতিবাদ সভায় সামিল হবার জন্য সমস্ত গণ আন্দোলনের শক্তি ও বিবেকী জনগণের কাছে এই কনভেনশন আবেদন জানাচ্ছে।

দাবিসনদকে সমর্থন করে আজকের রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে আসন্ন নির্বাচনে মানুষের দাবিকে সামনে তুলে আনার প্রয়োজনীয়তাকে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেন দীপঙ্কর ভট্টাচার্য। প্রস্তাবের পক্ষে পরপর আলোচনা করেন সামিরুল ইসলাম, মেরুনা মূর্মূ, অলিক চক্রবর্তী, নব দত্ত, হাফিজ আলম সইরানি, পল্লব কীর্তনিয়া, কপিল কৃষ্ণ ঠাকুর, অভিজিত বসু, স্বপন গাঙ্গুলি, ডাঃ পুন্যব্রত গুণ, মৌসুমি ভৌমিক, অনুরাধা দেব, সুজাত ভদ্র, শরদিন্দু উদ্দীপন ও অশোক বিশ্বনাথন। মৌসুমি অভিজিৎ ও পল্লব তাঁদের গানে সভাকে গভীরভাবে আলোড়িত করেন। কনভেনশনের সংহতিতে বার্তা পাঠান বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। কনভেনশন থেকে আগামী একুশে ফেব্রুয়ারী ভাষা দিবসের দিনে কলকাতায় এক গণ সমাবেশের আহ্বান করা হয়েছে। জনগণের মধ্যে থেকে উঠে আসা দাবিসনদ নিয়ে জনতার মাঝে ব্যাপক প্রচার চালিয়ে একুশের সমাবেশ সংগঠিত হবে।

যে সমস্ত বিষয়ের ওপর দাবিসনদ তার আলোচনাকে কেন্দ্রীভূত করে, তা এরকম -
১। সবার জন্য স্বাস্থ্য পরিষেবা ও খাদ্য নিরাপত্তা
২। সকলের জন্য শিক্ষা
৩। সব হাতে কাজ
৪। শ্রমিকের অধিকার
৫। কৃষিব্যবস্থা ও গ্রামের রক্ষা
৬। বন ও বনবসতির বাসিন্দাদের সুরক্ষা
৭। সমান নাগরিকত্বের নিশ্চয়তা
৮। মানবাধিকারের সুরক্ষা
৯। জনসাধারণের ক্ষমতায়ন ও বিভিন্ন স্তরের স্বায়ত্ত শাসন
১০। সামাজিক ন্যায়, সংহতি ও সমানাধিকার
১১। পরিবেশ ও জীবনের সুরক্ষা
১২। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ও বহুভাষিক কৃষ্টিসৃষ্টি

খণ্ড-28
সংখ্যা-5