প্রতিবেদন
আনন্দ-নুরুল থেকে মইদুল - আর কত প্রাণ?
Nurul-Maidul

সকালের আলো গায়ে মেখে সে বেরিয়ে পড়েছিল। রোজের থেকে সে দিনটা ছিল একটু অন্যরকম। সঙ্গে ছিল তার সাথীরা, আন্দোলনের সহযোদ্ধারা। উঠোনে খড়গাদার পাশে দাঁড়িয়ে রইলো তার আরেক বন্ধু — তার রুজি-রুটির সঙ্গী প্রিয় অটোটি — সেদিন ছিল তার বিশ্রাম।

বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় সে ঘুণাক্ষরেও জানতো না-বাংলার ছাত্র যুব আন্দোলনের ইতিহাসে শহীদের তালিকায় তার নামটাও যুক্ত হতে চলেছে। জানতো না মা তহমিনা বিবি, স্ত্রী আলেয়া বিবি, দুই কন্যা আর কন্যাসমা পিতৃহারা ভাগ্নীকে নিয়ে ছ’জনের (এখন পাঁচ জন) সংসারে ঘনিয়ে আসতে চলেছে নীরন্ধ্র এক আঁধার। জানতো না পশ্চিমবঙ্গের ভোটের আবহে সে এতটা প্রাসঙ্গিক ও মূল্যবান হয়ে উঠবে!

না, এসব কিছু জানা সম্ভব ছিল না বাঁকুড়ার কোতুলপুরের চোরকোলা গ্রামের স্বল্প শিক্ষিত পেশায় অটোচালক বছর ৩১-এর যুবকটির পক্ষে।

হয়তো সে বুঝতে পারেনি, রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান যিনি ‘ছাত্র যৌবন’-এর প্রশংসায় মুখর, তাদের জন্যে অনেক গান-কবিতাও লিখেছেন, যিনি গত বছর এনআরসি-বিরোধী বড় বড় মিছিলের পুরোভাগে থেকে অভয়দাত্রীর ভূমিকা নিয়েছিলেন, যিনি কিছুদিন ধরে মানুষের ‘দুয়ারে সরকার’ পাঠিয়ে ডেকে ডেকে স্বাস্থ্যসাথী কার্ড দিচ্ছেন, যিনি আজকাল অনেক সভায় বলেন, ‘আমি কারও মা, কারও বোন, কারও মেয়ে’ — সেই ‘মাতৃস্বরূপা’র পুলিশ ছাত্র যুবকদের শিক্ষা ও কাজের দাবির মিছিলে এমন নির্মম লাঠি চালাতে পারে!

হয়তো ভাবতে পারেনি, যে পুলিশ আম্ফান সামলাতে, কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণ করতে এত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে, প্রাণ পর্যন্ত দিয়েছে, সেই পুলিশই ছাত্রদের প্রতি এমন হিংস্র মারমুখী হয়ে উঠবে! হ্যাঁ, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে, সর্বাঙ্গে এলোপাথাড়ি লাঠির আঘাত তাকে বুঝিয়ে দিল। এমন আঘাত যে তখনই বুঝেছিল, সে আর বাঁচবে না! যন্ত্রণায় সেই সাজোয়ান শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছিল। ১১ ফেব্রুয়ারী লাইভ টেলিকাস্টে রাজ্যের মানুষ তা দেখে শিউরে উঠেছে।

নেত্রী অনেক সময়ই বলেন, ‘দুষ্টু মিষ্টি’ ছেলেরা অনেক সময় ‘দুষ্টুমি’ করে, সেটা তাদের বয়সের ধর্ম। কিন্তু সেদিন তো কেউ কোনো বিশৃঙ্খলা করেনি! তারা শুধু মুখ্যমন্ত্রীর কাছে তাদের দাবি জানানোর অনমনীয় জেদে ব্যারিকেড ভেঙেছিল। তবুও কেন তাদের আটকাতে জলকামান, টিয়ার গ্যাস চলল? বেধড়ক লাঠিচার্জ হল?

মুখ্যমন্ত্রী নিয়ম মাফিক দুঃখ প্রকাশ করলেন, তার পরিবারের পাশে থাকার, চাকরি দেওয়ার আশ্বাস দিলেন, কিন্তু তার সাথে এটাও বললেন, হয়তো মৃত্যুর কারণ তার কোনো পুরোনো রোগ। কিন্তু ভুলেও একবারও বললেন না পুলিশ বাড়াবাড়ি করে অন্যায় করেছে বা পুলিশ অপরাধী সাব্যস্ত হলে কঠোর শাস্তি পাবে।

 

Justice for Maidul

 

হ্যাঁ, লাঠিও হিংস্র ঘাতক হতে পারে। ১৯৫৯-এর খাদ্য আন্দোলনে উত্তাল কলকাতায় ৮০টি প্রাণ খাদ্য চাইতে এসে লুটিয়ে পড়েছিল এই লাঠির আঘাতেই। তাদের দাবি অসঙ্গত — এমনটা স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীও বলতে পারবেন না। রাজ্যে চা-চট-বস্ত্র-ইঞ্জিনিয়ারিং — সব শিল্পই ধুঁকছে। সরকারি ক্ষেত্রেও নিয়োগ প্রায় বন্ধ। এ রাজ্যে শিক্ষকদের বিভিন্ন অংশকে কোনো না কোনো দাবিতে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস রোদজল-ঝড়ে খোলা আকাশের নীচে রাত কাটাতে হয়েছে অনশনে, অবরোধে, ধর্ণায়। এখনও কাটাতে হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য তাদের আদিগঙ্গার কোমর সমান পচা জলে পর্যন্ত নামতে হল জীবনের ঝুঁকি নিয়ে।

আসলে মেলা খেলা উৎসবে দেদার অর্থ ছড়ানো শাসকের কাছে, নাগরিক-ছাত্র-যুব-মহিলাদের সংবিধানসম্মত ‘দাবি’ ও ‘অধিকার’-এর প্রশ্ন তুললেই তাদের গাত্রদাহ হয়, ভ্রূকুটি কঠিন হয়, চোয়াল শক্ত হয়। হাতের অস্ত্র আক্রমণোদ্যত হয়। সহৃদয় অভিভাবকের খোলশটুকু খসে পড়ে। শাসকেরা ভুলে যান, এই গণতন্ত্রকে ভর করে, সংবিধান ছুঁয়ে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার শপথ নিয়েই তারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন! আর সেই ক্ষমতা থেকে চলে যেতেও হয় এই গণতন্ত্রের ঘাড়ধাক্কায়! অতীতের কাছ থেকে এই গণতন্ত্রের পাঠ নিতে কেন এত অনীহা শাসকের!

‘নবান্ন অভিযানের’ শহীদ কমরেড মইদুল ইসলাম মিদ্যা জীবন দিয়ে শাসককে স্মরণ করিয়ে দিলেন — দয়া দাক্ষিণ্যের ভিক্ষা-অনুদান নয়, ছাত্র-যুবরা চায় যোগ্য হাতে যোগ্য কাজ আর সেই দাবি অর্জনের জন্য তারা অনেক দূর যেতে প্রস্তুত! দিল্লী সীমানায় আন্দোলনে থাকা লাখো কৃষকের বজ্রকঠিন সংকল্প তাদের অনুপ্রেরণা!

আর হ্যাঁ, আমরা এক নিঃশ্বাসেই উচ্চারণ করব আনন্দ-নুরুল-মইদুলের নাম! আগেও করেছি, ভবিষ্যতেও করব! ওরা বাংলার বড় আদরের, বড় গর্বের দুলাল। লাখো মানুষের অশ্রু আর ক্রোধে ওরা থাকবে বাংলার আকাশ বাতাস জুড়ে।

- জয়ন্তী দাশগুপ্ত  

খণ্ড-28
সংখ্যা-6