আদানির স্বার্থ রক্ষার জন্যই কি পরিবেশ আন্দোলনের কর্মীদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের অভিযোগ আনা হচ্ছে?
Are the activists of the environmental movement being accused

মোদীর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক এবং বিভিন্ন রাজ্যের বিজেপি সরকারগুলোই শুধু যে মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং প্রতিবাদের অধিকারের ওপর আক্রমণ হানছে তাই নয়। যে সমস্ত সাংবাদিক মোদীর দোস্ত আদানির দুর্নীতি জড়ানো ও ফন্দিবাজির বহুবিধ কারবার নিয়ে লেখালেখি করেন, আদানি তাদের বিরুদ্ধে একের পর এক মানহানির মামলা দায়ের করতে থাকেন।

তবে, ২০২১-এর জানুয়ারীর শেষ দিকে আদানি গোষ্ঠী একটা খোলা চিঠি দেয় যাতে তারা একটা ভুল করে বসে, আর সেই ভুলটা হল অরওয়েলিয় ভাষা বৈশিষ্ট্যের উপর ভর করে “মত প্রকাশের স্বাধীনতা” বলতে কি বোঝায় তার ব্যাখ্যা হাজির করা। ঐ চিঠির শিরোনাম ছিল “মিথ্যা প্রচারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার লক্ষ্যে খোলা চিঠি”। চিঠিটা আদানির টুইটার হ্যাণ্ডল থেকে টুইট করা হয়।

চিঠিটা শুরু হচ্ছে এই কথাগুলো দিয়ে — ”প্রিয় সহ নাগরিকবৃন্দ, মত প্রকাশের স্বাধীনতা যে কোন সন্তোষজনকভাবে ক্রিয়াশীল গণতন্ত্রের বুনিয়াদি অধিকার।” এ পর্যন্ত যা বলা হল তাতে আপত্তির কোন কারণ থাকতে পারে না। পরের বাক্যটি সম্ভবত কোনো ব্যাঙ্গ গদ্যকারকে দিয়ে লেখানো হয়েছে, কেননা তার মধ্যে দিয়ে আদানি গোষ্ঠীর নির্মম কর্তৃত্বপরায়ণতার চরম প্রকাশ ঘটতেই দেখা যাচ্ছে। বাক্যটাতে বলা হয়েছে, “ আদানি গোষ্ঠী মত প্রকাশের সেই স্বাধীনতাতেই বিশ্বাস করে যা সত্যকে তুলে ধরে এবং জাতীয় স্বার্থের সিদ্ধি করে।”

পরের অনুচ্ছেদটিতে ব্যাখ্যা করে যা বলা হয়েছে তা হল, বুনিয়াদি অর্থে, “জাতীয় স্বার্থ” আদানি গোষ্ঠীর স্বার্থেরই সমার্থক। মোটামুটি ভাবে, ভারত হল আদানি, আর আদানি হল ভারত। চিঠিতে বলা হচ্ছে, আদানি গোষ্ঠী এমন “গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ পরিচালনা করে যা আমাদের দেশের প্রগতির পক্ষে অপরিহার্য।” চিঠি এরপর জানাচ্ছে, স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক যে সমস্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান “আদানি গোষ্ঠীর প্রতি বিশ্বাস রেখে এই গোষ্ঠীতে বিনিয়োগ করেছে”, তার মধ্যে দিয়ে তারা “ভারতের প্রতি বিশ্বাস প্রদর্শনের” সাক্ষরই রেখেছে।

চিঠির পরবর্তী অংশের উপ-শিরোনাম দেওয়া হয়েছে “মিথ্যাচার বিপুল ক্ষতি করে”, এবং বিশদে বর্ণনা করা হয়েছে মিথ্যা সংবাদ কিভাবে অনিষ্ট করে এবং আদানি গোষ্ঠী কিভাবে “মিথ্যা প্রচার” এবং “অনলাইনে চালানো কল্পিত প্রচারাভিযানের” এক “বলি” হয়েছে। প্রত্যাশিত ভাবেই চিঠিতে এরপর বলা হচ্ছে, আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যারা প্রচার চালাচ্ছে তারা ভারতের শত্রু। চিঠি দাবি করছে, আদানিদের ক্রিয়াকলাপের বিরুদ্ধে অনলাইনে চালানো প্রচারগুলো চালাচ্ছে “কায়েমি স্বার্থের লোকজন যাদের লক্ষ্য হল ভারতের রণনৈতিক স্বার্থে অন্তর্ঘাত চালানো।” এর মধ্যে দিয়ে কি কিছু মনে পড়ে যাচ্ছে? এটা কি দিশা রবি এবং পরিবেশ আন্দোলনের সংগঠন ফ্রাইডেজ ফর ফিউচার-এর কর্মীদের বিরুদ্ধে এফআইআর-কে মনে পড়িয়ে দিচ্ছে?

আদানিদের চিঠিতে এরপর বলা হয়েছে, তারা মিডিয়ার লোকজনদের যথেষ্ট সম্মান করে, তবে, তারা আইনি ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয় যদি “মত প্রকাশের স্বাধীনতার অছিলায় আমরা আমাদের রাজনৈতিক স্বার্থের অনিষ্ট হতে দেখি।”

শুধু সাংবাদিকদের মুখ বন্ধের জন্যই আদানি গোষ্ঠী মানহানির মামলা করে না -- তাদের চিঠি মোদী সরকারের মানসিকতাকেও উন্মোচিত করছে। মোদী সরকার কেন কৃষি আইনগুলোকে বাতিল করার পথে যাচ্ছে না, বিপরীতে কৃষক আন্দোলনের কর্মী এবং পরিবেশ আন্দোলনের সমর্থকদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহ আইন ও ইউএপিএ আইনের অধীনে অভিযোগ দায়ের করছে, তার কারণ হল -- আন্দোলনের এই কর্মীরা যা উন্মোচিত করে দিচ্ছেন তা হল, কৃষি আইনগুলো কিভাবে আদানি গোষ্ঠী ও তাদের মতো লোকজনদের স্বার্থ সিদ্ধি করছে; এবং আদানিদের যে সমস্ত প্রকল্প ভারতে এবং অন্যান্য দেশে বনভূমি ও পরিবেশের ক্ষতিসাধন করছে তার বিরুদ্ধে কার্যকরী প্রচার গড়ে তুলছেন।

দেখা যাচ্ছে যে, মোদী সরকারের অধীনে গোটা ব্যবস্থাটাই স্যাঙাতি কর্পোরেটদের লুন্ঠন এবং সংখ্যালঘু-বিরোধী ঘৃণা, বৈষম্য ও হিংসাকে উৎসাহিত করে তোলে এবং এর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ ব্যক্ত করলে বা প্রতিরোধ গড়ে তুললে তাতে ফৌজদারি অপরাধের রং দেওয়া হয়। আমাদের সর্বশক্তি দিয়ে লড়াই গড়ে তুলে মোদী জমানার এই কর্পোরেটপন্থী, আদানি-আম্বানী পন্থী, ঘৃণার মদতকারী টুলকিটের স্বরূপ উন্মোচন করে দিতে হবে।

(লিবারেশন মার্চ ২০২১) 

খণ্ড-28
সংখ্যা-8