অবরুদ্ধ দিল্লী
Blocked Delhi

অবরুদ্ধ রাজধানী দিল্লি। উত্তরপ্রদেশ ও হরিয়ানা সীমানা থেকে লক্ষাধিক কৃষক ৪০ দিনেরও বেশি সময় ধরে হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় বসে আছেন। এঁদের অনেকেই বৃদ্ধ, হিমালয়ের বরফ বাতাস বয়ে আনা উত্তর ভারতের মারাত্মক শীতে ইতিমধ্যেই প্রাণ হারিয়েছেন দেড়শোরও বেশি কৃষক। কিন্তু দীর্ঘ এই সত্যাগ্রহ আন্দোলনে হিংসার ছোঁয়া ছিল না। গত ২৬ জানুয়ারী প্রজাতন্ত্র দিবসে দিল্লির রাস্তায় ট্রাক্টর মিছিলের সময় হিংসার যে ছবি ধরা পড়েছে, তাতে অহিংস সত্যাগ্রহ আন্দোলনকারী কৃষকদের ভূমিকা কতখানি ছিল না নিয়ে সংশয় ধরা পড়েছে দেশে বিদেশের সর্বত্র।

এক বছর আগে এই দিল্লিরই শাহিনবাগে এভাবেই কনকনে ঠান্ডা উপেক্ষা করে মাসের পর মাস সত্যাগ্রহে বসেছিলেন একদল মুসলিম বৃদ্ধা ও মহিলা। কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের আনা নাগরিকত্ব আইন, সিএএ এবং এনআরসি প্রত্যাহারের দাবিতে শাহিনবাগের সেই আন্দোলনেও হিংসার হুল ফোটাতে কসুর করেনি সরকার পক্ষ। প্রকাশ্য রাস্তায় শাহিনবাগের আন্দোলনকারীদের দিকে লক্ষ করে এক যুবককে গুলি চালাতে দেখেও না দেখার ভান করে দাঁড়িয়েছিল বিশাল পুলিশবাহিনী। সরকার ও পুলিশের প্রবল চাপ, ভয় দেখানো উপেক্ষা করেও নীরব সত্যাগ্রহ আন্দোলন থেকে সরে আসেননি শাহিনবাগের দাদিরা। ভারতের মাটিতে তাঁদের দিকে কুৎসার ঢেউ ধেয়ে এলেও তাঁদের সম্মান জানিয়েছে আমেরিকার বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন।

আরও একশো বছর আগে, ব্রিটিশ সরকারের কুখ্যাত রাওলাট আইন প্রত্যাহারের দাবিতে দেশজোড়া অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকা ফেরত এক গুজরাতি ব্যারিস্টার। সেই আন্দোলনের জেরেই প্রথমবার আমাদের সামনে এল ‘সত্যাগ্রহ’ শব্দটি। ব্রিটিশ পুলিশের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে, তাদের লাঠি গুলির সামনে অবিচল থেকে অহিংসাকে আন্দোলনের সবচেয়ে ধারালো অস্ত্র করে তুলেছিলেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। কিন্তু একশো বছর আগের এক ৪ ফেব্রুয়ারী বিহারের গোরখপুরের কাছে চৌরিচৌরা থানার পুলিশের আন্দোলনকারীদের উপর গুলি চালনার পাল্টা জবাব দিতে হিংসাত্মক হয়ে ওঠে আন্দোলন। এতদিন ধরে অহিংস আন্দোলনে পুলিশের অত্যাচার সয়ে থাকা জনতার ক্রোধের আগুনে পুড়ে যায় চৌরিচৌরার থানা, মৃত্যু হয় ২২ জন পুলিশকর্মীর। ভয়ঙ্কর এই ঘটনার অভিঘাতে থমকে যায় গোটা অসহযোগ আন্দোলন। ভগ্নহৃদয়ে দিন কয়েক পরে গোটা দেশ থেকে আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন খোদ মহাত্মা গান্ধী।

চৌরিচৌরার ঘটনার শতবার্ষিকীতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী টেনে এনেছেন কৃষক আন্দোলনের প্রসঙ্গ। কিন্তু শাহিনবাগ ও চলতে থাকা কৃষক আন্দোলন দেখিয়ে দিয়েছে ৫৬ ইঞ্চি ছাতি ফুলিয়ে পৌরুষের দর্প করে বেড়ানো সরকারের হাঁটু কেঁপে যেতে পারে নিরস্ত্র মানুষের নীরব অবস্থানে। গত বছর দিল্লিতে সাম্প্রদায়িক অশান্তিতে বহু মানুষের মৃত্যুর পর শাহিনবাগের আন্দোলনকারীদের এককথায় উৎখাত করে দিয়েছিল পুলিশ। নতুন করে শাহিনবাগে আর কেউ ধরনায় বসেননি। কিন্তু সরকারের অতি উচ্চাকাঙ্ক্ষী এনআরসি প্রক্রিয়া থমকে গিয়েছে। শাহিনবাগের ফুলকি থেকে দেশজোড়া বারুদে অগ্ন্যুৎপাতের চেহারা দেখে বাহুবলী প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিষয়টা নিয়ে আর এগনোর ভরসা পাননি। আপাতত ঠান্ডাঘরে ঠাঁই হয়েছে এনপিআর-এক কাজের। কৃষক আন্দোলনকে কোনও ভাবেই দমাতে না পেরে মরিয়া সরকার এখন কৃষকদের কাছে অনুরোধ করেছে আন্দোলন তুলে নিতে, তার পরিবর্তে দেড় বছরের জন্য কৃষি আইন স্থগিত করতেও রাজি তারা। কিন্তু তাতেও সায় দেয়নি অনড় কৃষক নেতারা। আইন বাতিলের দাবি থেকে একচুলও সরতে নারাজ তাঁরা।

কথায় কথায় বীরত্বের বাহাদুরি দেখানো, পৌরুষের পেশি ফুলিয়ে গলার স্বর সপ্তগ্রামে তুলে দেশভক্তির গান গাওয়া নরেন্দ্র মোদী অমিত শাহের পক্ষে প্রকাশ্যে নমনীয়তা দেখানো কঠিন। তাঁদের এতদিনের সযত্নলালিত সর্বশক্তিমান ভাবমূর্তি বড় ধাক্কা খাবে তাতে। কিন্তু মনে মনে তাঁরা যে আশঙ্কার সিঁদুরে মেঘ দেখছেন তা বুঝতে গণৎকার হওয়ার প্রয়োজন নেই। পৃথিবীর ইতিহাস বারেবারে প্রমাণ রেখেছে ভুখা, সর্বহারা জনতা যখন পথে নামে তখন শাসকের ভিত টলে যায়। মুসোলিনির ইতালি, চেসেস্কুর রোমানিয়া, এবং গত এক দশকে আরব দুনিয়ার একাধিক স্বৈরশাসকের পতন তার উজ্জ্বল উদাহরণ। ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় ঈশ্বরের প্রতিভূ রোমানভ রাজবংশ ছারখার হয়ে গিয়েছিল শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নিপীড়িত, নীরবে মার খেয়ে যাওয়া রুশ জনতার ক্ষোভের আগুনে।

গত ছ’বছর ধরে ভারতের রাজনীতিতে আমূল পরিবর্তন হয়ে গেছে। ভারতবর্ষের যে বৈচিত্রের ইতিহাস হাজার বছর ধরে আমাদের সভ্যতাকে ব্যতিক্রমী করে রেখেছে, সেই বৈচিত্রকে মুছে দিয়ে, সংখ্যাগুরুর ধর্ম, খাদ্যাভ্যাস, ভাষাকে বাকি দেশের উপর চাপিয়ে দেওয়ার নির্লজ্জ চেষ্টা হয়ে চলেছে। ভারতবর্ষের ধর্মনিরপেক্ষতার মজবুত তন্তুকে ছিঁড়ে এক ধার্মিক, একদলীয় শাসনের দিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দেশকে। রাজ্যগুলির হাত থেকে সার্বভৌম ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে ঠুঁটো করে ফেলা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠোমাকেই। সোশ্যাল মিডিয়ার বাড়বাড়ন্তের যুগে মিথ্যা প্রচারের বেসাতিতে আসল ঘটনার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রাখা অনেকটাই সহজ। কিন্তু তা সত্ত্বেও শাহিনবাগের সময় এবং বর্তমান কৃষক আন্দোলনও আন্তর্জাতিক মহলের নজর টেনেছে। তার অন্যতম কারণ এত দীর্ঘদিন ধরে এত বিরাট আকারের অহিংস সত্যাগ্রহের মনস্তাত্ত্বিক কাঠিন্য।

আমাদের শাসকের বিড়ম্বনা বাড়িয়ে দিয়েছে আন্তর্জাতিক পপ স্টার রিহানা ও কিশোরী পরিবেশ আন্দোলনকারী গ্রেটা থুনবার্গের আপাত নিরীহ দু’টি টুইট। ক্যারিবিয়ান দ্বীপের রিহানার টুইটারে ফলোয়ার ১০ কোটি মানুষ। তিনি যদি কোনও একটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চান তবে তা মুহূর্তের মধ্যে এই গ্রহের কোণায় কোণায় পৌঁছে যেতে পারে। রিহানার এই আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তায় ভর করে আমাদের দেশের কৃষক আন্দোলন গত কয়েক দিনে এমন বহু জায়গায় আলোচিত হচ্ছে, যা গত তিন মাসেও হয়নি। বিজেপি সরকারের হাড়ে কাঁপুনি ধরার জন্য রিহানাই যথেষ্ট ছিলেন। কিন্তু তাদের বিড়ম্বনা চতুর্গুণ হয়ে গেছে গ্রেটা থুনবার্গের আগমনে। মাত্র ১৭ বছর বয়সেই নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত গ্রেটা সারা বিশ্বে গত কয়েক বছর ধরে আলোচিত নাম। দিল্লি পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে এফআইআর করার পরেও অবিচল গ্রেটা শাসকের চোখে চোখ রেখে হিমশীতল গলায় বলে চলেছেন, এখনও তিনি কৃষকদেরই পাশে।

রিহানা ও গ্রেটার এই টুইটের পরেই রে রে করে আমাদের দেশের সরকার পোষিত সেলিব্রিটি মহল নেমে পড়েছে তাঁদের নস্যাৎ করে দিতে। ১৩০ কোটির দেশে ক্রিকেট, টেনিস ও সর্বোপরি বিনোদন জগতে সেলিব্রিটির অভাব নেই। পর্দায় কৃষক সেজে হাততালি কুড়নো অভিনেতার দল কৃষক আন্দোলনের সময় ভুলেও রা কাড়েননি। বরং প্রধানমন্ত্রীর গায়ের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে সেলফি তুলতে তাঁরা অনেক বেশি ব্যস্ত। তাঁদের জিম, মেকআাপ রুম, ভ্যানিটি ভ্যান, সমুদ্রের ধারে কোটিক টাকার বহুতলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ঘণ্টা বাজানো, বিদেশে ছুটি কাটানো জীবনে কোথাও ছন্দপতন ঘটায় না শীতের রাতে খোলা আকাশের নীচে মাসের পর মাস কাটানো অন্নদাতাদের যন্ত্রণা। কিন্তু শাসকের অঙ্গুলিহেলনে দম দেওয়া পুতুলের মতো পিল পিল করে তাঁর রিহানাদের মন্তব্য খণ্ডন করতে মাঠে নেমে পড়েছেন। সেই তালিকায় নবতিপর সুরসম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকর আছেন, আছেন ১৩০ কোটি মানুষের দেশের জীবন্ত ঈশ্বর সচিন তেন্ডুলকর এবং এই বিজেপি সরকারের স্বঘোষিত মুখপাত্র কঙ্গনা রানাওয়াত বা অক্ষয় কুমার।

সেলিব্রিটিদের পুজো করতে অভ্যস্ত এই দেশে এবারে সেলিব্রিটিদের হিসেবে একটু গোলমাল হয়ে গেছে। তাঁদের এক সুরে, এক ভাষায় টুইট করতে দেখে দেশ জুড়ে ধিক্কার, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ ধেয়ে এসেছে উল্কার বেগে। ব্যাপার দেখে আর বেশি রা কাড়তে সাহস পাননি দম দেওয়া সেলিব্রিটির দল। কিন্তু এই বিনোদন জগতের রথী মহারথীরা গত কয়েক বছর ধরে কীসের বার্তা দিচ্ছেন দেশের জনতাকে। অক্ষয় কুমারের প্রায় প্রতিটি ছবিতে তিনি প্রবল পৌরুষের প্রতীক, পর্দায় তিনি আসা মাত্র রক্তের গঙ্গা বয়ে যায়, লাশের স্তূপ জমে ওঠে। অধিকাংশ সময়েই তিনি পুলিশ বা সেনা অফিসারের ভূমিকায়। রাষ্ট্রশক্তির ক্ষমতার এক একটি স্তম্ভ হয়ে একাই তিনি দেশকে রক্ষা করেন। এবং প্রত্যাশিতভাবেই অধিকাংশ সময় তাঁর অস্ত্রের নিশানা মুসলিম জঙ্গি বা অন্য কোনও অপরাধী। অজয় দেবগণও কতকটা একই ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছেন পর্দায় গত কেয়ক দশক ধরেই। কঙ্গনার মুখের লাগাম নেই, পর্দায় তাঁর জনপ্রিয়তাতেও। কিন্তু শেষ কয়েকটি ছবিতে তিনিও এসেছেন হিংসার প্রতিভূ হয়েই। ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাইয়ের ভূমিকায় তিনি মুসলিম আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে পর্দায় রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়েছেন। সেই ইমেজ থেকে বাস্তবেও বোধকরি বেরিয়ে আসতে পারছেন না তিনি। সামান্যতম প্রতিবাদ দেখলেই, বিন্দুমাত্র বিরুদ্ধস্বর দেখলেই মুন্ডু ভেঙে দেওয়ার নিদান দিচ্ছেন তিনি। ভারতীয় ক্রিকেট বিরাট কোহলির নেতৃত্বে এক নতুন রূপে জন্ম নিয়েছে। এই ভারতীয় ক্রিকেট দল আদ্যন্ত পেশাদার, অত্যন্ত স্বাস্থ্যসচেতন এবং তীব্র পৌরুষের প্রতীক। জাতীয় দলের প্রতিটি সদস্যের মুখে চাপদাড়ি, চোখেমুখে প্রতিপক্ষকে পিষে ফেলার উগ্রতা, মুখে শাণিত গালাগালি। সাফল্যকে নম্রভাবে গ্রহণ করা তাদের ধাতে নেই। তাদের উগ্র আস্ফালনই নাকি তাদের সাফল্যের চাবিকাঠি।

হবেও বা। কিন্তু এই যে তীব্র আস্ফালন, প্রবল পৌরুষ, বিপক্ষকে ছুড়ে, পিষে ফেলার উগ্র আস্ফালনকারী সেলিব্রিটি মহল, তাঁদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে কারা? হিমাঙ্কের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া তাপমাত্রায়, খোলা আকাশের নীচে খড় বিছিয়ে রুটি-আচার খাওয়া কৃষক সমাজ। যেখানে সন্ধের পর কোথাও বাজে কাওয়ালি, কোথাও গুরবানির সুরে লঙ্গরে তৈরি হয় গরম গরম রুটি। সেখানে শিখ বৃদ্ধের ক্লান্ত পা ধুইয়ে দেন বহু দূরের গ্রাম থেকে আসা মুসলমান যুবক, শিখ প্রৌঢ়ার পাশে বসে রুটি সেঁকেন উত্তরপ্রদেশের দেহাতি বধূ। এই ভারতবর্ষের মিলনমন্দিরে হিংসার ছায়া কোনও দিনই পড়েনি। এই দেশ বহু শাসকের আগ্রাসন দেখেছে অনেক শতাব্দী ধরে, কিন্তু কালের গহ্বরে তারা সকলেই হারিয়ে গেছে। রয়ে গেছে তাদের ফেলে যাওয়া সৌধের কঙ্কাল। জাতি, ধর্ম, ভাষা, নির্বিশেষে ভারতবর্ষের মূল আত্মা কোনও দিন স্পর্শ করতে পারেনি কোনও স্বৈরাচারীর কলুষিত হাত। আজও পারবে না। ভাড়াটে বাহিনী নামিয়ে, চলার পথে কাঁটা বিছিয়ে দিয়েও তাই ৫৬ ইঞ্চি ছাতির সর্বশক্তিমান শাসক আজ আড়ালে ঠকঠক করে কাঁপছে। কারণ তাদের হিংসার সামনে সবচেয়ে বড় প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়েছে কাঁটা বিছানো পথের ওপারে নীরবে বসে থাকা বিপুল জনতরঙ্গের অহিংসা।

- শর্মিষ্ঠা রায়   

খণ্ড-28
সংখ্যা-8