একুশের দাবি: গিগ শ্রমিকদের শ্রমিকের মর্যাদা
The dignity of Gig workers

একুশ শতকের দু’ দুটি দশক পার করে এখন স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে যে, রাজনৈতিক-অর্থনীতির পরিসরে এক আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়ে চলেছে। যে পরিবর্তনের নাগাল না পাওয়া গেলে শেষাবধি বামপন্থীদের পক্ষে সদর্থক কিছু করে ওঠা মুশকিল। এই পরিবর্তনের নানান রকমফের ও প্রযুক্তিগত বিন্যাস আছে। তবে সে সব কথা ছাপিয়ে উঠে এ কথা এই মুহূর্তে অনস্বীকার্য যে, শ্রমজীবী মানুষের জগতে ও আঙ্গিকে এক সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন এসেছে। উত্তরোত্তর সংখ্যাগত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত এক নতুন ধরনের শ্রমজীবী মানুষের উপস্থিতি আজ আর অধরা বা অদৃশ্য নয়। এদের কেউ কেউ নামকরণ করেছেন ‘গিগ শ্রমিক’ বলে। ‘গিগ’ কথাটির অর্থ, বৃহত্তর অর্থে, স্বল্পকালীন। ‘গিগ শ্রমিক’ অর্থে তাই বোঝানো হচ্ছে এমন এক ধরনের শ্রমজীবী মানুষকে যাদের কাজের ধরন ও নিয়োগ স্বল্পকালীন ভিত্তিতে। আরও বিশদে বললে, এঁরা কাজ করবেন বা নিয়োজিত হবেন খুব অল্প সময়ের জন্য (ধরা যাক তিন কি ছ’মাস অথবা এক বছর), অনেক সময়েই পার্টনার-ভিত্তিক চুক্তির মাধ্যমে অথবা খুব সামান্য এক ন্যূনতম মজুরির সঙ্গে কাজের ভিত্তিতে ইনসেন্টিভ মডেলে।

এই ধরনের কাজের আঙ্গিক কেন, কীভাবে ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে তৈরি হচ্ছে? এ নিয়ে বিশদে পরে আলোচনা করা যাবে কিন্তু এই লেখার পরিপ্রেক্ষিতে এটুকুই আপাতত বলা যে, অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ডিজিটালাইজেশন ও অনলাইন-করণের ফলে এবং সর্বোপরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগে এমন এক নতুন ধরনের শ্রমজীবী মানুষের নির্মাণ হয়েছে যাদের আজকের আধুনিকতম অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটির একটি অবশ্যম্ভাবী সুবিশাল লেজ হিসেবে প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। সোজা কথায়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চালনায় এমন এক নতুন ধরনের পরিপূরক শ্রমজীবী মানুষের উত্থান, যারা এই পরিবর্তিত অর্থনীতির জোয়ালকে নিজ কাঁধে বয়ে নিয়ে চলেছেন। এঁরা কারা?

এঁদের একটা বড় অংশ অনলাইন ডেলিভারি বয়; যাদের সংখ্যা দেশ জুড়ে কয়েক লক্ষ- জোমাটো, স্যুইগি, ফ্লিপকার্ট, অ্যামাজন এই অযূত ধরনের সংস্থায় দিনাতিপাত করা শ্রমজীবী মানুষ, প্রাপ্ত অর্ডারের ভিত্তিতে বাড়ি বাড়ি বা অফিস-কারখানায় নিত্য হরেক কিসিমের পণ্য পৌঁছে দিচ্ছেন। এঁদের কোনও ন্যূনতম মজুরি নেই, শ্রমিকের মর্যাদা নেই, সামাজিক সুরক্ষা বলেও কিছু নেই। এঁদের দেখানো হয় পার্টনার বা শরিক হিসেবে, যারা কোম্পানির প্রাপ্ত অর্ডারের ওপর কমিশন ভিত্তিতে স্বনিয়োজিত শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। এদের নিজস্ব বাইক বা অন্য যান থাকতে হবে যাতে করে মাল পৌঁছে দেওয়া যায়। তেল খরচা অথবা সামান্য টিফিন খরচা বাবদ এদের হয়তো কোনও কোনও কোম্পানি স্বল্প কিছু অর্থ অনুদান দিয়ে থাকে। বাকি সবটা রোজগার হয় কমিশন ভিত্তিতে (কোনও কোনও ক্ষেত্রে সঙ্গে একটা বেসিক স্যালারি দেওয়া হয় যার থেকে তেলের খরচাও মেটাতে হয়) যা বেশি রাতের দিকে বাড়তে থাকে। এদের কাজের কোনও নির্দিষ্ট সময় বা সীমা নেই, যখনই এবং যতক্ষণ সম্ভব এঁরা শ্রম দিয়ে চলেন আরও কমিশনের আশায়। মনের মধ্যেও গেঁথে যায় এই ধারণা যে, তাঁর নিজ কাজের বৃদ্ধির মধ্য দিয়েই তাঁর আয়েরও বৃদ্ধি হবে। কিন্তু সে এক গোলকধাঁধা।

শুধুমাত্র অনলাইন ডেলিভারি শ্রমিককুলই নয়, গিগ শ্রমিকদের মধ্যে পড়ে ওলা-উবের’এর ড্রাইভার, আর্বান ক্ল্যাপ’এর মতো বিভিন্ন পরিষেবা-প্রদানকারী দক্ষ শ্রমিকেরা ও অনলাইনে কর্মরত আরও নানা ধরনের শ্রমিক ও কর্মীরা। সবটা জুড়ে এই ধরনের কর্মী বা শ্রমিকদের সংখ্যাই এখন শ্রমিকশ্রেণির সর্ববৃহৎ অংশ। কিন্তু এঁরা কি সাবেকি অর্থে শ্রমিক? নাকি যে কোনও শিল্প-বাণিজ্য উদ্যোগের শরিক মাত্র। এ নিয়ে নানা মুনির নানা মত। তবে অতি সম্প্রতি উবের’এর ক্ষেত্রে ব্রিটেনের শীর্ষ আদালত এক রায়ে জানিয়েছে, এঁদের ‘শ্রমিক’ হিসেবেই গণ্য করতে হবে। শীর্ষ আদালতের বক্তব্য, যান পরিবহনের যে পরিষেবা উবের ড্রাইভাররা দেন, তা খুব পাকাপোক্ত ভাবে উবের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও লিখিত-পড়িত। এই পরিষেবা এমনভাবেই দেওয়া হয় যে সেখানে কোম্পানির ইচ্ছানুযায়ী ড্রাইভারদের নিয়োগ বা বাতিল করা যায় এবং দিনের শেষে খদ্দেরদের আনুগত্য ও শুভ কামনা ড্রাইভাররা নয়, উবের কোম্পানিই পায়। নিঃসন্দেহে এই যুগান্তকারী রায় গিগ শ্রমিকদের জন্য এক বিরাট জয়। এই রায়ের ফলাফল উবেরের সীমানা ছাড়িয়ে এবার নিশ্চয়ই প্রসারিত হবে অন্যান্য সংস্থার গিগ শ্রমিকদের ক্ষেত্রেও।

পশ্চিমবঙ্গে আগামী নির্বাচনে ‘একুশের ডাক: মানুষের দাবিতে গিগ শ্রমিকদের সমস্যার কথা খুব গুরুত্ব সহকারে আলোচনা করা হয়েছে। এ রাজ্যে এই ধরনের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বা সামাজিক সুরক্ষা তো নেইই, উপরন্তু, এদের নিজস্ব কোনও ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনও নেই। যতক্ষণ না এঁরা শ্রমিকের মর্যাদা পাচ্ছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন গড়ে তোলাও এঁদের পক্ষে সমস্যাসঙ্কুল। দিনরাত পরিশ্রম করে এঁদের হাতে দৈনিক যে নেট আয়টা আসে তা অতি সামান্য। মনে রাখতে হবে, এই শ্রমিকেরাই কিন্তু ক্রমেই সমগ্র শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ হয়ে উঠছেন। অধিক মুনাফার লোভে কর্পোরেট কোম্পানিগুলি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে এমন এক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে যাতে এই ধরনের শ্রমিকদের শরিক হিসেবে দেখিয়ে, তাঁদের প্রাপ্য শ্রম অধিকার থেকে বঞ্চিত করে সুউচ্চ মুনাফা নিশ্চিত করা যায়। অবস্থাটা কীরকম?

প্রথমত, এই গিগ শ্রমিকদের ‘শ্রমিক’ মর্যাদাই দেওয়া হয় না। এঁদের দেখানো হয় স্বাধীন স্ব-উদ্যোগী হিসেবে যাদের সঙ্গে কোম্পানিগুলি চুক্তি মোতাবেক কমিশনের ভিত্তিতে কাজ করে। ব্রিটেনের শীর্ষ আদালতের রায় এই ধারণাকে নস্যাৎ করেছে। এখানেও তাই একই দাবিতে এই শ্রমিকদের সংগঠিত করা, আন্দোলনে নামা ও পাশাপাশি আইনি সুরাহা পেতে সর্বাত্মক উদ্যোগ নেওয়া উচিত।

দ্বিতীয়ত, শ্রম সুরক্ষা বিধির যে সুযোগ-সুবিধাগুলি আছে এঁরা সেগুলো পান না। পিএফ, ইএসআই, সবেতন ছুটি, পাঁচ বছর চাকরি হলে গ্র্যাচুইটি — এইসব নানাবিধ শ্রমিক অধিকার তাঁদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয় না। এই সামাজিক সুরক্ষার বিধিগুলি তাঁদের ক্ষেত্রে অবিলম্বে বাধ্যতামূলক করতে হবে।

তৃতীয়ত, এঁদের কাজের দৈনিক নির্ঘন্ট বলে কিছু নেই। কিছুটা স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে এঁরা বেশি কমিশনের আশায় অসময়ে বা রাতবিরেতে কাজ করেন। এঁদের ক্ষেত্রে শ্রমিক বিধি অনুযায়ী আট ঘন্টার বেশি বাড়তি সময়ে কাজ করাকে ওভারটাইম হিসেবে গণ্য করতে হবে। তার সঙ্গে নির্দিষ্ট ও বেশি হারে কমিশনের ব্যবস্থাও থাকতে হবে।

চতুর্থত, সবচেয়ে বড় কথা, এই গিগ শ্রমিকদের আঙ্গিকগত পরিবর্তনের ফলে এদের শ্রমিক হিসেবে না দেখানোর যে কৌশল, তার সুযোগে এঁদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারকেই খর্ব করা হয়েছে। এটা এক ভয়ঙ্কর দিক। অবিলম্বে এঁদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারকে সুনিশ্চিত করতে হবে। অবশ্য সম্প্রতি, উবের ক্যাব চালকদের ট্রেড ইউনিয়ন গঠিত হয়েছে ও তাঁরা তাঁদের নানান দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলনের পথেও আছেন।

পঞ্চমত, এই গিগ শ্রমিকদের কাজ ও কাজের নিরাপত্তার কোনও গ্যারান্টি নেই। যে কোনও অজুহাতে তাঁদের কাজ চলে যেতে পারে অথবা তাঁদের বেসিক স্যালারি (যাদের ক্ষেত্রে আছে) ও কমিশনের হার নিয়েও টানাটানি হতে পারে। সোজা কথায়, এঁরা এক নিরালম্ব বায়ুভূতের মতো সমাজ-অর্থনীতির গায়ে আলগা ভাবে লেপ্টে আছে, যাদের ভূত-ভবিষ্যতের কোনও কূলকিনারা নেই। কেউ কেউ এঁদের কর্ম-অবস্থাকে দাস ব্যবস্থার সঙ্গেও তুলনা করেছেন। অবিলম্বে এই দাস ব্যবস্থার অবসান চাই।

এ হেন পরিস্থিতি গিগ শ্রমিকদের দাবিদাওয়া নিয়ে আজ এক মুখ্য লড়াই গড়ে ওঠার অবকাশই শুধুমাত্র নির্মাণ করছে না, তা সমাজ পরিবর্তনেরও গুরুত্বপূর্ণ দিশারী হিসেবে দেখা দিচ্ছে। একদিকে চরম কর্মহীনতা, অন্যদিকে কর্মরত শ্রমিকদের এক বড় অংশের দুঃসহ যাপন — সমাজ পরিবর্তনের সার্বিক লড়াইয়ে এক নতুন মাত্রা নিয়ে এসেছে। একুশের দাবি সেই লক্ষ্যপূরণে কতটা অগ্রসর হতে পারে, তা লড়তে লড়তেই দেখার।

- অনিন্দ্য ভট্টাচার্য  

খণ্ড-28
সংখ্যা-10