যোগীর রাজ্যে হাথরসে আবারও দুর্বৃত্ত দাপট
the rogue power is again in Hathras

২ আগস্ট মালদহে বিজেপির নির্বাচনী প্রচারে এসে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ যে ভাষণ দেন তার মধ্যে এই কথাগুলোও ছিল – “এমনকি নারীদেরও রেহাই দেওয়া হচ্ছে না (এই রাজ্যে)। যে সরকার নারীদের এবং সামগ্ৰিকভাবে রাজ্যের অধিবাসীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে না, একদিনও ক্ষমতায় থাকার অধিকার তাদের নেই।” পরিস্থিতির কি পরিহাস, যেদিন আদিত্যনাথ এই কথাগুলো উচ্চারণ করছিলেন সে দিনই তাঁর রাজ্যের হাথরসের নজলপুর গ্ৰামে শ্লীলতাহানির শিকার এক যুবতীর বাবাকে গুলি করে হত্যা করল যৌন নিগ্ৰহে অভিযুক্তরা। তাঁর রাজ্যে সমাজবিরোধীদের কিভাবে তিনি শায়েস্তা করেছেন, সেই আস্ফালনও আদিত্যনাথ সেদিনের ভাষণে করেছিলেন। প্রসঙ্গত, হাথরস হল উত্তরপ্রদেশের সেই জেলা যেখানে ধর্ষিতা দলিত তরুণীর মৃত্যু এবং প্রশাসনের অমানবিকতা ও স্বেচ্ছাচারিতা গত বছরের সেপ্টেম্বরে সারা দেশে আলোড়ন তুলেছিল। অভিযোগ, ধর্ষণের প্রমাণ লোপাটের অভিপ্রায়ে পুলিশ পরিবারের অসম্মতি সত্ত্বেও ধর্ষিতার দেহ পেট্রল দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল।

বাবার মৃত্যুর পর কাঁদতে-কাঁদতে করজোড়ে ন্যায়বিচার চাওয়া নিগৃহীতা তরুণী জানিয়েছেন – তাঁর শ্লীলতাহানি ঘটানোয় তাঁর বাবা অম্বরীশ শর্মা ২০১৮ সালের ১৬ জুলাই পুলিশের কাছে একটি অভিযোগ দায়ের করেন। মূল অভিযুক্ত ছিল গৌরব শর্মা এবং অন্যান্য অভিযুক্তরা ছিল ললিত শর্মা, রোহিতাস শর্মা, নিখিল শর্মা ও আরো দুজন। অভিযোগ দায়ের হওয়ার পর গৌরব শর্মা গ্ৰেপ্তার হলেও ১৪ দিন পরই সে জামিন পেয়ে যায়। এরপর দু’বছর ধরে অভিযুক্তরা এবং পুলিশও মামলা তুলে নেওয়ার জন্য তাদের ওপর চাপ দিতে থাকে। হত্যার দু’দিন আগেও তার বাবাকে খুন করার হুমকি গৌরব দিয়েছিল বলে নিগৃহীতা জানিয়েছেন। অবশেষে, ২ আগস্ট তাঁর বাবা যখন তাঁদের আলু জমিতে কাজ করছিলেন, সে সময় গাড়িতে করে গৌরব সহ ছয় দুষ্কৃতী এসে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে বাবাকে হত্যা করে। তিনি আরো জানিয়েছেন, বাবাকে গুলি করার পর সাহায্য চেয়ে তিনি পুলিশকে ফোন করলেও তারা আসেনি, নানা বাহানায় বিলম্ব করেছে।

উত্তরপ্রদেশে দুর্বৃত্তদের দাপট তথা মাফিয়া পরিঘটনাটা কতটা প্রভাবশালী তার অনুধাবনের জন্য বিকাশ দুবে আখ্যানের উল্লেখ এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে না। গত বছরের জুলাই মাসের গোড়াতেই পুলিশ বিকাশ দুবে ও তার শাগরেদদের ধরতে গেলে বিকাশ দুবে চালিত দুর্বৃত্ত বাহিনী একজন ডিএসপি ও তিন জন সাব-ইন্সপেক্টর সহ আট পুলিশ কর্মীকে হত্যা করে। অভিযোগ, পুলিশ যে বিকাশ দুবে ও তার দলবলকে ধরতে যাচ্ছে, সে খবর প্রশাসনের ওপরতলা থেকে বিকাশ দুবের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। তার বিরুদ্ধে ৫০টারও বেশি অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ থাকলেও বিকাশ দুবে কিভাবে দীর্ঘদিন গ্ৰেপ্তারি এড়িয়ে চলেছিল তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল এবং উত্তরটা যে রাজনৈতিক পরিমণ্ডল ও প্রশাসনের অন্দরে নিহিত রয়েছে তাও দ্বিধাহীন ভাবে উঠে এসেছিল। পরে বিকাশ দুবের গ্ৰেপ্তারি ও ‘এনকাউন্টারে’ নিহত হওয়ার ঘটনা যথার্থই সংঘর্ষের ঘটনা নাকি দুর্বৃত্ত-পুলিশ-প্রশাসন গাঁটছড়ার উন্মোচনকে ধামাচাপা দেওয়ার লক্ষ্যে উন্মোচনের সম্ভাবনাময় উৎসকে সাফ করা, সেই প্রশ্নকে সে সময় এড়ানো যায়নি।

উত্তরপ্রদেশে বারবারই সমাজবিরোধীদের দৌরাত্ম্যের খবর ও নারী নিগ্ৰহের ঘটনার উন্মোচন আদিত্যনাথের দুষ্কৃতী দমনের আস্ফালনকে রাজনৈতিক চালবাজি বলে প্রতিপন্ন করেছে। এই প্রতিবেদন লেখা যেদিন চলছে সেই ৬ আগস্টেও শামলি জেলার রাজবির গ্ৰামে ঘরে একা থাকা ২৮ বছরের এক যুবতীর শ্লীলতাহানির ঘটনা খবর হয়েছে। উত্তরপ্রদেশ এমনই এক রাজ্য যেখানে সশস্ত্র ডাকাতি, মুক্তিপণ আদায়ের লক্ষ্যে অপহরণ, নারী নিগ্ৰহ, তোলাবাজি, জমি গ্ৰাসের মতো অপরাধ প্রাত্যহিকের ব্যাপার এবং রাজনীতি-পুলিশ-দুর্বৃত্ত আঁতাত এক অবিসংবাদী বাস্তবতা। নিগৃহীতার বাবার হত্যার পর বিজেপি গৌরব শর্মাকে সমাজবাদী পার্টি সমর্থক রূপে প্রচার করছে, অখিলেশ যাদব আবার গৌরব শর্মার সঙ্গে আলিগড়ের বিজেপি সাংসদের ছবি সামাজিক মাধ্যমে টুইট করছেন। পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, উত্তরপ্রদেশে বর্তমানে ৪০৩ জন বিধানসভা সদস্যর মধ্যে ১৪৩ জনের বিরুদ্ধেই অপরাধমূলক কাজকর্মে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। যে দলের শাসনাধীনে উত্তরপ্রদেশ দুর্বৃত্তদের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠেছে, রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন যেখানে প্রশ্নহীন প্রবল বাস্তবতা, সেই দল পশ্চিমবাংলায় শাসন ক্ষমতায় এলে পশ্চিমবাংলারও আর একটা উত্তরপ্রদেশ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়ার নয়। এই প্রতিবেদনের শুরুতে আদিত্যনাতের ভাষণের যে অংশবিশেষ উল্লিখিত হয়েছিল, যাতে নারীদের নিরাপত্তা দেওয়ার অক্ষমতায় সরকারের একদিনও ক্ষমতায় থাকার অধিকারকে নাকচ করা হয়েছিল, সেই অঙ্গীকারকে আদিত্যনাথ প্রত্যাশিতভাবেই ভুলে গেছেন বলে দেখা যাচ্ছে!

খণ্ড-28
সংখ্যা-9