নব্য বাবুদের হাট গ্রাস করছে খোয়াই বন এবং আদিবাসীদের গ্রাম ও জীবনযাত্রা
Khowai forest and tribal villages and way of life are consum

খোয়াই বনের হাটের পার্শ্ববর্তী গ্রামের অধিবাসীবৃন্দের ডাকা এক অভূতপূর্ব সভায় যাওয়ার সুযোগ পেয়ে বহু কিছু শিখলাম। বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চের অন্যতম সদস্য সোনা মুর্মু এই সভার খবর দিয়েছিলেন।

সেই কবে শুরু হয়েছিল এই হাট সোনাঝুরি জঙ্গলের একধারে, উদ্দেশ্য ছিল স্থানীয় মানুষ তাদের নিজের হাতে তৈরি পসরা নিয়ে বসবেন শনিবারের বিকালে, নিজেরাই কেনাবেচা করবেন এবং সন্ধ্যা লাগলে সব গুটিয়ে ফিরে যাবেন। কোনো স্থায়ী আস্তানা এখানে হবে না। কিছু হস্তশিল্পের পাশাপাশি সেখানে ঘরে তৈরি পিঠে পুলি পেয়েছি। আমাদের প্রিয় শ্যামলীদিকে দেখেছি কাগজের তৈরি শান্তির পাখি নিয়ে বসেছেন। স্থানীয় গ্রামের বাচ্চারা নুড়িপাথরের বিনিময়ে সেই পাখি পেয়েছে।

কালক্রমে সেই খোয়াইবনের অন্য হাট গুরুতর বাণ্যিজিক বাজারে পরিণত হয়েছে। শনিবার ছাপিয়ে রবি সোম মঙ্গল সব দিনেই হাট বসছে। একটা ছেড়ে কত কটা হাট। সেখানে একই কোম্পানির একই উৎপাদন পাঁচ জায়গায় পাঁচ জনা বেচছেন। প্রয়োজনের অনেক উপরে চেপেছে সৌখিন চটক। যা বিক্রি হয়, তা কেনার সাধ বা সাধ্য কোনোটাই স্থানীয় মানুষের নেই।

স্থায়ী হোটেল বসেছে, চারিদিকে রমরমা রিসোর্ট। কলকাতা থেকে সোজা ঢাউস গাড়িতে হাটের মাঝে। শান্তিনিকেতন রবীন্দ্রনাথ কোনো কিছু নয়, লক্ষ্য শুধু হাট। অরণ্যের দিনরাত্রি এখন এই বিপণনে মুখর। পথ ঢেকেছে‌ বিচিত্র সব যানে, আশেপাশের গ্রামের মানুষের বেরোনোর পথ নেই। অসুস্থ হলে কোন পথে হাসপাতাল পৌঁছবেন কেউ জানেন না। আদিবাসী মেয়েদের গ্রুপ ড্যান্স আর বাউল সং দিয়ে সংস্কৃতির দারুণ চর্চা চলছে। আমোদের অন্যান্য আয়োজন সহযোগে।

পাশের কয়েকটি সাঁওতাল গ্রামের ক্ষুব্ধ মানুষ আজ স্পষ্ট ভাষায় জানালেন এই হাট তাদের সংস্কৃতি ও যাপনের উপর বিরাট আঘাত হানছে। চিরকাল যা হয়ে আসছে, শহুরে বাবুদের ফূর্তির জন্য তাদের জমি গিলছে জমিহাঙর। সরতে সরতে তারা কোণঠাসা। তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ক্ষমতায়ন নিয়ে কেউ ভাবিত নয়।‌ তাদের ছেলেরা লেখাপড়া বাদ দিয়ে বাবুদের কীর্তি দেখে বেড়াচ্ছে। দেখাই যাচ্ছে পর্যটনে যারা আসেন, তাদের কাছে স্থানীয় মানুষ একেবারেই তুচ্ছ। ওরা বলছিলেন, যে ধরনের কুরুচিকর আচরণ তারা প্রকাশ্যে করেন, এ কি তারা নিজেদের এলাকায় পারবেন! গভীর ক্ষোভে একজন বললেন, কেন এই বনভূমিতেই তাদের হাট করতে হবে? আর কি কোনো জায়গা নেই। আদিবাসী মেয়েদের বিশেষ উৎসবের সাথে যুক্ত যে নাচ, কটা পয়সা ফেলে এরা যখন তখন এই নাচ দেখছেন, এ সব কী হচ্ছে? একজন বয়স্ক মানুষ বাবু বিবিদের উল্লাসের যেটুকু বর্ণনা দিতে পারলেন তাতে বিবমিষা জাগছিল।

সভায় এই সিদ্ধান্ত হয় যে এই হাট বন্ধ করতে হবে।‌ নিঃসন্দেহে এক আলোড়ন জাগানো দাবি যার পক্ষে তারা তাদের কথা স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন।

জল জঙ্গল জমির উপর যাদের অধিকার স্বতঃসিদ্ধ আজ তাদের উপর চলতে থাকা এই আগ্রাসনের কথা শুনতে শুনতে অত্যন্ত লজ্জিত বোধ করেছি।  বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চের তরফে তাদের আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছি।

- মনীষা ব্যানার্জী 

খণ্ড-28
সংখ্যা-11