খাদ্য সুরক্ষায় ভর্তুকি কমিয়ে আনার লক্ষ্যে রেশন প্রাপকদের সংখ্যা হ্রাস করা চলবে না
The number of ration recipients

সংবাদপত্রে সম্প্রতি প্রকাশিত একটা সংবাদ থেকে জানা যাচ্ছে – খাদ্য সুরক্ষা আইনের অধীনে যারা রেশন থেকে সস্তায় চাল-গম পান, কেন্দ্রীয় সরকার তাদের সংখ্যাটা কমিয়ে আনার কথা ভাবছে। প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, কেন্দ্রীয় খাদ্য সচিব এবং পরিসংখ্যান ও কর্মসূচী রূপায়ণ মন্ত্রকের সচিবের সঙ্গে বেশ কয়েক দফা বৈঠক করার পর নীতি আয়োগ সরকারের কাছে সুপারিশ করেছে যে, গ্রাম ও শহরে যত শতাংশ মানুষকে খাদ্য সুরক্ষা আইনে ভর্তুকিতে খাদ্যশস্য দেওয়া হয়, সেই হারটাকে কমিয়ে আনা দরকার। এর পক্ষে নীতি আয়োগের যুক্তি হল — গত এক দশকে দেশে অর্থনীতির যে বৃদ্ধি ও উন্নতি ঘটেছে তাকে বিবেচনায় আনলে দেখা যাবে দরিদ্র জনগণের একটা অংশের আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটেছে, ফলে খাদ্য সুরক্ষা আইনের সুবিধা পাওয়ার দরকার তাদের আর নেই। রেশনে সস্তায় চাল-গম দেওয়ার জন্য বর্তমানে প্রদত্ত ভর্তুকির পরিমাণ ৪২২৬১৮ কোটি টাকা। ২০২০-২১-এর অর্থনৈতিক সমীক্ষায় বলা হয়, খাদ্য সুরক্ষায় ভর্তুকির এই পরিমাণ “এতটাই বড় যে তা নিয়ন্ত্রণের অতীত”। নীতি আয়োগ সরকারের অভিপ্রায়ে সায় দিতে সুপারিশ করে যে ভর্তুকির এই পরিমাণটাকে কমিয়ে আনা দরকার, আর কম করা গেলে যে অর্থের সাশ্রয় হবে তাকে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যর মতো খাতে ব্যয় করা যাবে।

উল্লেখ্য, খাদ্য সুরক্ষা আইনের অধীনে সস্তায় চাল-গম পায় অন্ত্যোদয় আন্না পরিবারগুলো যারা দেশের দরিদ্রতম জনগণ। পরিবার পিছু এদের জন্য মাসে বরাদ্দ ৩৫ কেজি খাদ্যশস্য। এই আইনের আর সুবিধা প্রাপকরা হল “প্রায়োরিটি হাউসহোল্ড” বা অগ্রাধিকার বলে গণ্য পরিবারগুলো, যে সমস্ত পরিবারের সদস্যদের মাসে মাথাপিছু ৫ কেজি করে খাদ্যশস্য দেওয়া হয়। মনমোহন সিং-এর সরকার ২০১৩ সালে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, গ্রামের ৭৫ শতাংশ জনগণ এবং শহরের ৫০ শতাংশ জনগণকে খাদ্য সুরক্ষা আইনে ভর্তুকিতে খাদ্যশস্য দেওয়া হবে। এই হারে সুবিধা প্রাপকদের সংখ্যাটা দাঁড়াচ্ছে প্রায় ৮১ কোটি ৩৫ লক্ষ বা মোট জনসংখ্যার ৬৭ শতাংশ। এর সাপেক্ষে নীতি আয়োগের সুপারিশ হল সুবিধা প্রাপকদের হার কমিয়ে গ্রামাঞ্চলের ক্ষেত্রে ৬০ শতাংশ এবং শহরাঞ্চলের ক্ষেত্রে ৪০ শতাংশ করা হোক। তাদের আরো হিসেবে, হার অপরিবর্তিত থাকলে ২০১৩-র পর জনসংখ্যা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে সস্তায় রেশন দিতে হবে ৮৯.৫২ কোটি মানুষকে যা খাদ্যশস্যে ভর্তুকির পরিমাণকে আরো বাড়িয়ে তুলবে। আর তাদের সুপারিশ করা হারে সস্তায় রেশন প্রাপকদের সংখ্যাটা নেমে আসবে ৭১.৬২ কোটিতে। ফলে, খাদ্যশস্যে ভর্তুকির পরিমাণ বেশ কিছুটা কমানো যাবে।

অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কারণে দরিদ্র জনগণের একটা অংশের দারিদ্র সীমার বাইরে এসে রেশন-নির্ভরতা কাটিয়ে ওঠার নীতি আয়োগের অভিমত কি আদৌ বাস্তব সম্মত? কোনো একটা নীতি বা কর্মসূচীর প্রবর্তনে সরকার যেমন তাদের পছন্দ মতো কমিটি গঠন করে সেই কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে এগিয়ে যায়, খাদ্য সুরক্ষায় ভর্তুকি ছাঁটতে মরিয়া সরকারের কাছে নীতি আয়োগের সুপারিশ কি সেরকমই একটা অবলম্বন হচ্ছে? অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতি কখনই এমন সন্তোজনক ছবি তুলে ধরে না যার ভিত্তিতে বলা যায় যে তা দরিদ্র জনগণের দুরবস্থা ঘুচিয়ে তাদের অবস্থাকে উন্নত করেছে। নোটবন্দি অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান এবং আয়ে এমন ধাক্কা দেয় যে তার প্রভাব এখনও কাটানো যায়নি বলেই অনেক অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ মনে করেন। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে সরকার প্রথমে চেপে গেলেও পরে স্বীকার করতে বাধ্য হল যে, বেকারির হার ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছেছে। অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার কমতে শুরু করে পাঁচ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম ৪.৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছিল লোকসভা নির্বাচনের বছরেই। এরপর এল কোভিড-১৯ পরিস্থিতি এবং চূড়ান্ত কাণ্ডজ্ঞানহীন লকডাউন। নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি দূরে থাক, কাজ খোয়ালেন ২ কোটিরও বেশি মানুষ, পরিযায়ী শ্রমিক। উপার্জনের পথ বন্ধ হয়ে গিয়ে তাদের জীবনে নেমে এল চরম বিপর্যয়। ২০২০-র এপ্রিল থেকে জুন ত্রৈমাসিকে অর্থনীতির সংকোচন ঘটল অভাবনীয় মাত্রায়, বৃদ্ধি নেমে গেল শূন্যের ২৩.৯ শতাংশ নীচে, পরের ত্রৈমাসিকেও অর্থনীতির সংকোচন ৭.৫ শতাংশ ঘটায় অর্থনীতি মন্দার গ্রাসে বলে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হল। বিশেষজ্ঞদের অনুমান, ২০২০-২১ অর্থবর্ষে অর্থনীতির সংকোচন হবে ৮ শতাংশ। অর্থনীতির এই পরিস্থিতি দরিদ্র জনগণের আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটিয়ে তাদের রেশন-নির্ভরতা থেকে মুক্তি দিয়েছে বা দিতে পারবে, এমন কথা কোনো বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই বলতে পারবেন না।

অনেকে এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন — এবং তা আমাদের অভিজ্ঞতার সঙ্গেও মিলে যায় – রেশনের সুবিধা পেয়েছেন বলে কোভিড কালে বহু মানুষ অনাহারে মৃত্যুকে এড়াতে পেরেছেন। ভারতে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি এবং রাষ্ট্রপুঞ্জের হিসেব বলছে, পৃথিবীর সমস্ত ক্ষুধার্ত মানুষের এক চতুর্থাংশই রয়েছে ভারতে। এখানে কোটি-কোটি শিশু অপুষ্টিতে ভোগে। খাদ্য সুরক্ষা আইনে সুবিধা প্রাপক পরিবারগুলোর সংখ্যা কমিয়ে আনলে তা খাদ্য নিরাপত্তাকেই বিপন্ন করে তুলবে। রেশনের ওপর নির্ভর করে যে মানুষগুলো কোনো রকমে টিকে থাকেন, তাদের অস্তিত্ব এবং ভবিষ্যত বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে।

রেশনে সুবিধা প্রাপক পরিবারের সংখ্যাকে কমিয়ে আনার বিষয়টা এখনও সিদ্ধান্ত নয়, সুপারিশের পর্যায়েই রয়েছে। তবে, আমাদের নজরদারি জারি রাখতে হবে এবং এই ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় সরকার গ্ৰহণ করলে তার বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিরোধ গড়ে তোলাটাই হবে যথার্থ প্রত্যুত্তর।

খণ্ড-28
সংখ্যা-10