হিন্দুত্ব-কর্তৃত্ববাদীদের টুলকিট এবং সংগঠিত হিংসার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না কেন?
Why no action is being taken against Hindutva-authoritarian toolkit

বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র ২০২০ সালের ১৬ নভেম্বর টেলিগ্ৰাম সামাজিক মাধ্যমে “হিন্দু ইকোসিস্টেম” গোষ্ঠী তৈরি করেন। প্রসঙ্গত, কপিল মিশ্র হলেন সেই কুখ্যাত নেতা যিনি ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে তাঁর ঘৃণাবর্ষী ভাষণ দিয়ে দিল্লীতে সাম্প্রদায়িক হিংসা উস্কিয়ে তুলেছিলেন, যে ভাষণের মধ্যে “বিশ্বাসঘাতকদের গুলি করে মারো”র আহ্বানও ছিল (“বিশ্বাসঘাতক” আসলে ছিল মুসলিম ও সিএএ-বিরোধী প্রতিবাদকারীদের বোঝানোর সাংকেতিক শব্দ)। কপিল মিশ্রর “হিন্দু ইকোসিস্টেম” গোষ্ঠী নিয়ে নিউজলন্ড্রি পোর্টাল একটি তদন্তমূলক প্রতিবেদন তৈরি করে। দু-জন সাংবাদিক ঐ গোষ্ঠীর মধ্যে ঢুকে পড়েন এবং কিভাবে তারা কাজ চালায় তা নিয়ে তদন্ত করেন। ঐ গোষ্ঠী যে মুসলিম, খ্রিস্টান ও শিখ সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে হিংসা উস্কিয়ে তোলার জন্য সুপরিকল্পিতভাবে বিষয়বস্তু তৈরি করে প্রচার করে সে সম্পর্কে ঐ দুই সাংবাদিক প্রমাণ জোগাড় করেন। তাঁরা জানতে পারেন, ঐ হিংসা টুলকিটের মধ্যে দিয়ে তীব্রতর করে তোলা হয়, যে টুলকিট বিদ্বেষ ছড়ানোর হ্যাশট্যাগের মধ্যে দিয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে টুইটারে ঝড় তোলে, এবং মানুষের মনকে বিষিয়ে তোলার উদ্দেশ্যে ভুয়ো ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব ছড়ায়। কপিল মিশ্র টুইটারে তাঁর ঘৃণা ছড়ানোর ইকোসিস্টেমের জন্য খোলাখুলিভাবেই সদস্য নিয়োগ করতে থাকেন। টুইটারে ওঠানো ঘৃণাবর্ষী ঝড়গুলো খোলাখুলিভাবে ছড়িয়ে পড়তে থাকে, এবং ঘনঘন সেগুলোর পুনরাবৃত্তি ঘটতে দেখা যায়। গ্ৰেটা থুনবার্গ কৃষক প্রতিবাদের প্রবক্তা একটা টুলকিট ব্যবহার করে টুইট করলে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহর নিয়ন্ত্রণাধীন দিল্লী পুলিশ তার ভিত্তিতে অবলীলায় এফ আই আর করে, কিন্তু ঐ বিদ্বেষমূলক, হিংসা ছড়ানোর ও বিপজ্জনক ইকোসিস্টেমের বিরুদ্ধে তারা কোন ব্যবস্থা নেয়নি কেন?

নিউজলন্ড্রির রিপোর্টে বলা হয়েছে, “ভারতের বিরুদ্ধে “আন্তর্জাতিক চক্রান্ত” বলে গ্ৰেটা থুনবার্গ-এর টুলকিটকে যে ধিক্কার জানানো হচ্ছে তার পিছনে একটা মূল কারণ হল, কৃষক প্রতিবাদের দিকে মনোযোগ দেওয়ার জন্য কবে অনলাইন ও কবে অফলাইন কার্যকলাপ চালাতে হবে সে সব দিনের উল্লেখ তাতে ছিল। হিন্দুত্ববাদী ইকোসিস্টেমও একই কাজ করে থাকে, তবে, একটা ন্যায়সঙ্গত বিষয়ে সমর্থন জানাতে গ্ৰেটা একটা মাত্র নথি শেয়ার করলেও কপিল মিশ্রর গোষ্ঠী বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ঘৃণাকে তীব্রতর করে তুলতে প্রতিদিন বহুসংখ্যক নথিকেই শেয়ার করে থাকে। ...

“হিন্দুত্ববাদী ইকোসিস্টেম-এর মতো গোষ্ঠীর মাধ্যমে যে কাজটা করা হচ্ছে তার তাৎপর্য আপনি যদি অনুধাবন করতে না পারেন তবে আমাদের সেটা স্পষ্ট ভাষায় বলতে দিন : ওরা ভুয়ো তথ্য, সম্প্রচার, নির্দিষ্ট লক্ষ্যে চালানো ঘৃণার উৎস। ওরা সুসংগঠিতভাবে হিন্দু কর্তৃত্ববাদী ও সংখ্যালঘু-বিরোধী বিষয়বস্তু তৈরি করে সেগুলোকে প্রচার করে, এবং সাম্প্রদায়িক ঘৃণা উস্কিয়ে তোলে।

“সাম্প্রদায়িক ঘৃণা উস্কিয়ে তোলার জন্য ২০০০০ লোক পরস্পরের সঙ্গে সমন্বয়সাধন করে কাজ করে চলেছে; ওদের রেডারে যা কিছুই ধরা দেয় সে সবকেই ওরা ঘৃণায় রঞ্জিত করে ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব বানায়, ঘৃণার নেটওয়ার্কে ঈপ্সিত ফল আনার জন্য সেটাকে তাৎক্ষণিকভাবে শেয়ার করতে ছবি, ভিডিও ও ফরোয়ার্ড-এর জোগান মজুত থাকে।”

সংঘের সংগঠনগুলো অনলাইনে যে হাজার হাজার কারখানা খুলে ঘৃণা ছড়ানোর কারবার চালায়, কপিল মিশ্রর কারখানা তার মধ্যে একটা মাত্র। দিল্লীতে ২০২০র ফেব্রুয়ারী মাসে যে মুসলিম-বিরোধী হিংসা চালানো হয়, তার সাথে অনলাইনে প্রচারিত ঘৃণার সরাসরি সংযোগের ভূমিকাকে উন্মোচিত করে আর্টিক্যাল-১৪ পোর্টাল একটা তদন্তমূলক রিপোর্ট তৈরি করে। শ্বেতা দেশাইয়ের তৈরি করা “রাগিণী তেওয়ারি ও বন্ধুদের ঘৃণা সঞ্চারী এডভেঞ্চার” শীর্ষক রিপোর্টে বলা হয়, “দিল্লী পুলিশ দাবি করে থাকে যে, ভারতের শাসক দলের সঙ্গে সংযোগ থাকা হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলো ফেব্রুয়ারীর “দাঙ্গা” ষড়যন্ত্রের অংশ ছিল বলে কোনো প্রমাণ তারা পায়নি। আমাদের তদন্তে কিন্তু যথেষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ উঠে এসেছে, যাতে দেখা যাচ্ছে দাঙ্গা সংঘটনের ঠিক আগের দিনগুলোতে হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলো ফেসবুকে উস্কানিমূলক উদ্যোগ ও পরিকল্পনা নিয়েছিল। ফেসবুক ইণ্ডিয়া তাদের নিজেদেরই নীতিমালা প্রয়োগ করতে অনীহা দেখানোয় প্ররোচনা দায়ী বার্তা ও ভিডিওগুলো লাগাতার দেখা দিতে থাকে।” ঐ প্রতিবেদনে বিশেষভাবে উল্লেখিত হয়েছে রাগিণী তেওয়ারির তোলা ভিডিওগুলোর কথা, যিনি দিল্লীর জাফরাবাদ ও মৌজপুর এলাকায় মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী হিংসা উস্কিয়ে তোলার আস্ফালন করেছেন। দাঙ্গাবাজ ভিড়কে চালিত করার যথেষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ থাকলেও দিল্লী পুলিশ রাগিণী তেওয়ারির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। অন্য দিকে তারা সিএএ-বিরোধী আন্দোলনকারী ও নারীবাদী আন্দোলনের কর্মীদের এই অভিযোগের ভিত্তিতে ইউএপিএ আইনে অভিযুক্ত করেছে যে, তাদের হোয়াটসঅ্যাপ গোষ্ঠী নারী নেতৃত্বে চালিত নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে অহিংস প্রতিবাদে যে সমর্থন জানিয়েছে তা ভারত-বিরোধী ষড়যন্ত্রেরই শামিল।

একইভাবে পুরো এক বছর পর দেখা যাচ্ছে, এবিভিপি-র হাঙ্গামাকারী এক ভিড় জেএনইউ-র ছাত্র ও শিক্ষকদের ওপর যে সহিংস হানাদারি চালায়, সেই ঘটনায় দিল্লী পুলিশ এক জনকেও গ্ৰেপ্তার করতে পারেনি। তাদের হামলাবাজি শেষ হওয়ার পর দিল্লী পুলিশ নিরাপদে তাদের জেএনইউ থেকে বার করে নিয়ে যায়, এবং পুলিশ তাদের কাউকেই থামানো বা গ্ৰেপ্তারের চেষ্টা করে না। জেএনইউ-র ছাত্ররা এবং তদন্তকারী সাংবাদিকরা হোস্টেলের ভিতর হাঙ্গামা চালানোর জন্য এবিভিপি নেতা কোমোল শর্মার পরিচিতি ফাঁস করে দিলেও দিল্লী পুলিশ কিছু না জানার ভান করে থাকে।

খণ্ড-28
সংখ্যা-8