খবরা-খবর
কুঁদঘাট নিকাশি নালায় তরল আবর্জনা চাপা পড়ে শ্বাসরোধে মৃত্যু চার সাফাই কর্মীর
suffocated to death in Kundghat sewer

কুঁদঘাট, ২৫ ফেব্রুয়ারী ২০২১ – পূর্ব পুটিয়ারি ইঁটখোলা মাঠের কাছে নির্মীয়মাণ পাম্পিং স্টেশনের সঙ্গে নিকাশি নালা সংযুক্তি করণের কাজ চলছিল জোর কদমে। পাম্পিং স্টেশনের জলাধারে নিকাশি জল পাঠানোর জন্য প্রায় ২৫ ফুট গভীরে পাতা ৬০ ইঞ্চি পাইপের গেট খুলে দিতে বলা হয় একজন সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ সাফাই কর্মীকে, গভীর ম্যানহোলে নেমে কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় কোনো সামগ্রী ছাড়াই। খবরে প্রকাশ পাইপের গেট খোলা মাত্র বহুদিন ধরে জমে থাকা তরল আবর্জনা ও বিষাক্ত গ্যাসের (মিথেন?) স্রোত নিমেষে গ্রাস করে নেয় ওই কর্মীকে। গ্যাসের প্রভাবে অচৈতন্য কর্মী ডুবে মারা যান। কিছুক্ষণ পরে ওই কর্মীর দুই ভাই ও আরও একজন অনভিজ্ঞ শ্রমিক ওই ম্যানহোলে নেমে যান প্রথম শ্রমিককে উদ্ধারের জন্য। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এই তিন জনের একই ভাবে মৃত্যু হয়। ওপরে অপেক্ষায় থাকা আরও তিন কর্মী এরপর সতর্কতার সাথে ম্যানহোলে কিছুটা নেমে আসেন তবে গ্যাসের প্রভাবে অচৈতন্য হওয়ার আগেই কোনোভাবে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হন।

রাজ্য সরকারের বিপর্যয় মোকাবিলা দফতর ও দমকল বাহিনীর সাহায্যে দ্রুতই ডুবুরি নামিয়ে ম্যানহোল থেকে দেহগুলি উদ্ধার করা হয়। হাসপাতালে চারজনকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। গ্যাসের প্রভাবে আচ্ছন্ন তিনজন আহত ও ভীষণভাবে আতঙ্কিত শ্রমিকদের বাঘাযতীন স্টেট জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য কোলকাতার বিস্তীর্ণ এলাকায় নিকাশি ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর কাজ চলছে কোলকাতা কর্পোরেশনের অধীন কেইআইআইপি (কোলকাতা এনভায়রনমেন্টাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট)-এর মাধ্যমে।

ঘটনার পরে তাৎক্ষণিক ভাবে জানা গেল নিহত তিন ভাই: মহম্মদ আলমগীর (৩৫), জাহাঙ্গীর আলম (২২), সাব্বির হোসেন (১৯) এবং লিয়াকৎ আলি (২০)। আহত হন : সইফুল ইসলাম (২৪), মহম্মদ সলোমন (৩৫), মাহাবুল হক (২২)। এরা সবাই মালদহ হরিশচন্দ্র পুরের তালসুর গ্রামের বাসিন্দা, প্রথমোক্ত তিনজন একই পরিবারের সদস্য, বাবার নাম তুরাব আলি, হত দরিদ্র প্রান্তিক চাষি। ম্যানহোলে ঢোকার সময় এদের কাউকেই সিকিউরিটিবেল্ট বা মাস্ক পড়ানো হয়নি। কোনও ম্যানহোলে কাজের অনেক আগে থেকেই কাছাকাছি ম্যানহোলের ঢাকনাগুলি খুলে রাখা নিয়ম, যাতে জমে থাকা সম্ভাব্য বিষাক্ত গ্যাস বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ পায়। ম্যানহোলের মধ্যে কি পরিমান জল আসতে পারে আগাম অনুমান করে তদনুযায়ী ব্যাবস্থা নেওয়া হয়নি। আসলে ঘটনার সময় কোন আধিকারিক বা ইঞ্জিনিয়ার ওখানে ছিলেনই না। যেমন, নিহত সাব্বির ও লিয়াকৎ এই ভয়ঙ্কর বিপদজনক কাজে নতুন, সেটা দেখার লোকই ছিল না। এসব কিছুই দায়িত্বপ্রাপ্ত ঠিকাদার সংস্থার দিক থেকে চরমতম গাফিলতি এবং কেন্দ্রীয় সরকার প্রণীত ‘দ্য প্রহিবিশন অফ এমপ্লয়মেন্ট অ্যাজ ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জারস অ্যান্ড দেয়ার রিহ্যাবিলিটেশন অ্যাক্ট ২০১৩’-র পরিপন্থী।

কোলকাতা কর্পোরেশনের বোর্ড অফ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের সভাপতি শ্রী ফিরহাদ হাকিম তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠনের ঘোষণা করেন, যদি তাদের অনুসন্ধান রিপোর্টে ঠিকাদার সংস্থার কেউ অভিযুক্ত হন তাহলে তার বিরুদ্ধে এফআইআর করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি আরও জানান যে সংশ্লিষ্ট কন্ট্রাক্টরকে মৃত শ্রমিক প্রতি ৫ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিতে বলা হয়েছে। ২৭ ফেব্রুয়ারী এআইসিসিটিইউ, আইপোয়া এবং গণতান্ত্রিক নাগরিক উদ্যোগের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত এক ডেপুটেশন টিমকে রিজেন্ট পার্ক থানার ওসি জানান যে তারাও একটি অনুসন্ধানকারী টিম গঠন করেছেন। যদিও অভিযুক্তের নাম তিনি জানাতে চাননি।

২৬ ফেব্রুয়ারি উল্লিখিত তিনটি সংগঠন ছাড়াও পিডিএসএফ, আইসা, এককমাত্রা ও আরও কিছু ছাত্র সংগঠন মিলিত ভাবে কুঁদঘাট মেট্রো স্টেশন থেকে ঘটনাস্থল পর্যন্ত একটি মিছিলের আয়োজন করেন। একটি ছোট সভার মধ্যে দিয়ে কর্মসূচী সমাপ্ত হয়, ‘২১ ডাক, বিজেপির বিরুদ্ধে বাংলা’ এই ব্যানারকে সামনে রেখে কর্মসূচী, বিক্ষোভ জারি থাকবে। আগামী ৩ মার্চ সেক্সপীয়ার সরণিতে অবস্থিত কেইআইআইপি দফতরের সামনে বেলা ২টোয় গণসংগঠনগুলির এক বিক্ষোভ কর্মসূচী ঘোষণা করা হয়েছে। এআইসিসিটিইউ’র সভাপতি অতনু চক্রবর্তী জানালেন যে আগামী ৪ মার্চ শ্রমমন্ত্রীর কাছে ডেপুটেশন ও মেমোরান্ডামে সাফাই কর্মীদের দুর্দশার বিষয়টা গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করা হবে। কর্পোরেশন ও সরকারের বিভিন্ন আধিকারিকের কাছে চিঠি দিয়ে তাদের বক্তব্য জানতে চাওয়া হবে।

গোটা ভারতবর্ষে সাফাই কর্মীরা চরম লাঞ্ছনা ও দুর্দশার মধ্যে বেঁচে আছেন। যেভাবে সরকার প্রণীত নিরাপত্তা বিধিকে ছেঁড়া কাগজে পরিণত করে বেআইনিভাবে ম্যানহোলের কাজে সাফাই কর্মীদের নিয়োগ করে তাদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হলো তার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের জন্য আমরা কঠোর শাস্তির দাবি করছি। গোটা ভারতে প্রতি পাঁচ দিনে একজন সাফাই কর্মীর মৃত্যু হয়, এই কাজ এতটাই ঝুঁকিপূর্ণ। কুঁদঘাটে নিহত সাফাই কর্মীরা সকলেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের, তারা পরিযায়ী এবং তাদের পরিচয় ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জারস। ফলে মনুবাদী বিজেপি’র এই ঘটনায় কোনও হেলদোল নেই। বর্ণ ব্যবস্থার সিঁড়ির একদম নীচের ধাপের মানুষেরা যুগ যুগ ধরে এই পেশায় নিয়োজিত। নিম্নলিখিত দাবির ভিত্তিতে আমাদের লড়াই জারি থাকবে।

১) মৃত শ্রমিকদের প্রত্যেককে ১০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ রাজ্য সরকারকে দিতে হবে।
২) সংশ্লিষ্ট কন্ট্রাক্টরের লাইসেন্স বাতিল ও গ্রেফতার করতে হবে।
৩) কায়িক শ্রম নয়, নর্দমা সাফাই আধুনিক যন্ত্রে করতে হবে।
৪) অস্থায়ী কর্মীদের স্থায়ীকরণ করতে হবে।
৫) সাফাই কর্মীদের আধুনিক সরঞ্জাম দিতে হবে, সামাজিক সুরক্ষা এবং জীবনবীমার আওতায় আনতে হবে।

- শান্তনু  

খণ্ড-28
সংখ্যা-8