গণতন্ত্রের অগ্নিপরীক্ষা: বিজেপি’র ফ্যাসিবাদী আগ্ৰাসনকে মুখের মতো জবাব দিন
 BJP's fascist aggression

পাঁচটা রাজ্যে যখন নির্ধারিত নির্ঘন্ট মেনে বিধানসভা নির্বাচন চলছে, তখন এমন কিছু ঘটনা ঘটছে যার মধ্যে বর্তমানের শঙ্কাজনক জরুরি রাজনৈতিক বিষয়গুলোকে প্রতিফলিত হতে দেখা যাচ্ছে।

২০২১-এর ৩১ মার্চ অর্থমন্ত্রক ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের বিভিন্ন প্রকল্পে সুদের হারকে যথেষ্ট মাত্রায় হ্রাস করে, যে হ্রাসের পরিমাণ ছিল ৪০ থেকে ১১০ বেসিস পয়েন্ট। পরদিন ১ এপ্রিল সকালে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন টুইট করে জানালেন, সুদের হার একই থাকবে এবং “নজর এড়িয়ে যে নির্দেশিকা জারি হয়েছিল তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে”। সিদ্ধান্তকে পুরোপুরি পাল্টানোর এই ঘোষণা এপ্রিল ফুল-এর দিন করা হলেও মোদী সরকার কিন্তু তড়িঘড়ি সুদ হ্রাসের সিদ্ধান্ত বাতিল করার মধ্যে দিয়ে তাদের প্রকৃত অভিপ্রায় সম্পর্কে কাউকেই বোকা বানাতে পারল না। স্পষ্টতই, অর্থমন্ত্রককে পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল যে, নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত সুদ হ্রাসের সিদ্ধান্তকে মুলতুবি রাখতে হবে — কেননা, ক্ষুদ্র সঞ্চয়ে যাঁরা টাকা রেখেছেন নির্বাচন চলাকালে তাদের বড় ধরনের আঘাত দেওয়ার সিদ্ধান্ত বিজেপি’র কাছে রাজনৈতিকভাবে সর্বনাশা হয়েই দেখা দেবে। মোদী সরকারের মানব বিদ্বেষ, অসততা এবং অপদার্থতা এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে এতটা প্রকট হয়ে পড়ছে যে অন্য কোনো ঘটনায় তা আর হয়নি।

ইতিমধ্যে, আসামে বিজেপি’র এক প্রার্থীর গাড়িতে ভোট গ্ৰহণে ব্যবহৃত একটা এক ইভিএম নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলে দেখা গেল, নির্বাচনের সময় যেটা সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে! নির্বাচন কমিশন এই আষাঢ়ে গল্প ফাঁদল যে, ভোট গ্ৰহণে নিযুক্ত কর্মীদের গাড়ি খারাপ হয়ে গিয়েছিল আর তাই পিছনে আসা গাড়িটা যে প্রার্থীর গাড়ি তা না জেনেই তারা সেই গাড়িতে চেপে পড়েছিল। নির্বাচন কমিশনের এই কৈফিয়তে কেউই বিশ্বাস করবে না। ইভিএম চুরির এই ঘটনা আগেকার কাগজের ব্যালটে ভোট হওয়ার সময়ের বুথ দখলের ঘটনার সঙ্গেই তুলনীয়। আসামের অন্য একটা ঘটনায় একটা বুথে মোট ভোটদাতার সংখ্যা ৯০ হলেও সেখানে ভোট পড়তে দেখা গেল ১৭১টা। কাগজের ব্যালটের চেয়ে ইভিএম মেশিনগুলোকে দখল করা বা রিগিং করার সম্ভাবনা যদি এত অনায়াসই হয় তবে সেগুলোকে আদৌ ব্যবহার করা হচ্ছে কেন?

ত্রুটিপূর্ণ, ঠিকভাবে কাজ করতে না পারা এবং চুরি হয়ে যাওয়া ইভিএম-এর দীর্ঘ ধারার মধ্যে একটা নির্দিষ্ট ধরন দেখা যায়। এই ধরনের যে সমস্ত নিদর্শন সামনে এসেছে, সেই সমস্ত ‘ত্রুটি’ থেকে ব্যাপক সংখ্যাধিক ক্ষেত্রেই লাভবান হয়েছে বিজেপি। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে নির্বাচন কমিশন এই বক্তব্যকে খণ্ডন করে যে ইভিএম এবং ভিভি প্যাট মেশিনগুলোতে কারচুপি করা সম্ভব, এবং তাও আবার এই ঘটনা সত্ত্বেও যে, এই সম্ভাবনাকে স্বীকার করেই বিশ্বের অধিকাংশ দেশ ব্যালট মেশিনগুলোকে বাতিল করেছে। এ ব্যাপারে কোনো সংশয় নেই যে, নির্বাচনী ফলাফল যাই হোক না কেন, নিজেদের ভোটকে সুরক্ষিত করতে ভারতের নির্বাচকমণ্ডলীকে কাগজের ব্যালটে ফিরে যাওয়ার দাবি তুলতে হবে।

বিজেপি এই ব্যাপারে অবহিত যে, নির্বাচন চলা রাজ্যগুলো সহ সারা ভারতেই তারা এমন দল হিসাবে পরিচিত যারা “সমস্ত কিছু বিক্রি করে দিয়েছে, আমাদের সব সম্পদ বিক্রি করে দিয়েছে”। রাষ্ট্রায়ত্তক্ষেত্রের সম্পদের বেসরকারীকরণ, লব্ধ ঋণ শোধ না করে সরকারের বন্ধু কর্পোরেট সংস্থাগুলোর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলো থেকে জনগণের সঞ্চয়ের লুট এবং যে অপরিশোধিত ঋণকে অবশেষে ব্যাঙ্কের খাতা থেকে মুছে ফেলা হয়, ক্ষুদ্র সঞ্চয়ে সুদের হার কমানোর চেষ্টা, এমন কৃষি আইন তৈরি করা যা কৃষিকে বেসরকারী কোম্পানিগুলোর কাছে বিক্রি করে দেয়, শ্রম আইনগুলোকে লঘু করে তুলে মালিকদের সুবিধা করে দেওয়া, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের বেসরকারীকরণ এবং তারসাথে বেকারির হার ৪০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট হওয়া — এই সমস্ত পদক্ষেপ যতই কর্পোরেটদের স্বার্থ রক্ষায় চালিত হচ্ছে, সেগুলো ততই জনবিরোধী হয়ে উঠছে; জনগণ এর পরিণাম ভোগ করছেন ও তার প্রতিরোধ করছেন।

এই সমস্ত ক্ষেত্রে জনগণের তোলা প্রশ্নগুলোর জবাব দিতে না পেরে বিজেপি তাদের নির্বাচনী প্রচারে সেই পুরনো প্রিয় বিষয়েরই শরণ নিচ্ছে — তীব্র বিদ্বেষপূর্ণ মুসলিম-বিরোধী ঘৃণাবর্ষী বুলি। অমিত শাহ আসামের ভোটারদের “আত্মনির্ভর আসাম ও মৌলানা-নির্ভর আসামের” মধ্যে একটাকে বেছে নিতে বলেছেন। এরমধ্যে দিয়ে তিনি বদরুদ্দিন আজমল পরিচালিত এআইইউডিএফ-কেই বুঝিয়েছেন, যে সংগঠন বিরোধী জোটের শরিক। পশ্চিমবাংলায় প্রধানমন্ত্রী বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীকে চূড়ান্ত অবমাননাকর ও নারী বিদ্বেষী ভঙ্গিতে সম্বোধন করেছেন। পশ্চিমবাংলার বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষ মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলেছেন, তিনি যেভাবে শাড়ি পরে প্লাস্টার করা ভাঙ্গা পা দেখাচ্ছেন তা ‘ভারতীয় সংস্কৃতি’র বিরোধী, এবং তার পরিবর্তে তাঁকে বারমুডা পরার পরামর্শ দিয়েছেন। বুদ্ধিজীবী ও শিল্পীদের প্রতি বিজেপি’র মার্কামারা বিদ্বেষের সাক্ষর রেখে দিলীপ ঘোষ ঘোষণা করেছেন যে বুদ্ধিজীবীরা হলেন সমাজের বোঝা। চলচ্চিত্র, থিয়েটার ও সঙ্গীত জগতের যে শিল্পীরা বিজেপি’র বিরুদ্ধে কথা বলছেন, তাদের হুমকি দিয়ে তিনি বলেন, “ওরা যদি রাজনীতির কথা না ছাড়ে আমি ওদের দেখে নেবো। আর আমি যে সেটা কেমনভাবে করতে পারি তা শিল্পীরা জানেন”। পশ্চিম বাংলার মতো রাজ্যে এই ধরনের হুমকিবাজি বিশেষভাবে উদ্বেগের, যে রাজ্য তার প্রাণোচ্ছল ও তর্কপ্রিয় সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের জন্য দীর্ঘকাল ধরে সুপরিচিত।

তবে বিজেপি প্রচারের সবচেয়ে বিষময় অংশ হয়ে থেকেছে বিদ্বেষময় ভাষণ যার লক্ষ্য হল মুসলিম-বিরোধী ঘৃণার ওপর ভর করে হিন্দু ভোটব্যাঙ্ক সৃষ্টি করা, যেটা আজ পর্যন্ত কখনই বাংলার রাজনীতির উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল না। নন্দীগ্রাম আসনে বিজেপি প্রার্থী তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীকে এমন ভাষায় আক্রমণ করেছেন যা বোঝায় যে তিনি হলেন এক মুসলিম মহিলা যিনি ‘অনুপ্রবেশকারী’ এবং ‘রোহিঙ্গাদের’ কাছে ‘ফুপু’। পশ্চিমবাংলায় নির্বাচনী প্রচারে আসা এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বলেন যে মুখ্যমন্ত্রী ‘রোহিঙ্গা গোত্রের’ (নিকৃষ্ট জাতের) মানুষ। এই প্রচারে পৃথিবীর সবচেয়ে নিপীড়িত শরণার্থীদের অন্যতমদের পরিচিতিকে কুকথা হিসাবে ব্যবহার করা হল, এবং তা দিয়ে বোঝানো হল যে, যে প্রার্থী মুসলিম বা মুসলিমদের ঘৃণা না করা হিন্দু, তিনি হিন্দুদের ভোট পাওয়ার যোগ্য নন। এই খোলাখুলি, জলজ্যান্ত ঘৃণাবর্ষী ভাষণের প্রতি নির্বাচন কমিশন নীরবই থেকেছে, আর এটাই তাদের স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।*

তবে, বিজেপি’র সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষবুলি তাদের দেউলিয়াপনা এবং মরিয়াভাবকেই প্রকাশ করে দিচ্ছে। মোদীর বশংবদ গণমাধ্যমগুলো বিজেপি’র অপরাজেয়তা সম্পর্কে এক বিভ্রম সৃষ্টি করতে চেষ্টার কোনো কসুর করছে না। ঐ সমস্ত গণমাধ্যমের সহায়তায় বিজেপি নির্বাচকমণ্ডলীর বিরুদ্ধে তর্জনগর্জন করছে এবং ভোট পড়ার আগেই নিজেকে অনিবার্য বিজয়ী বলে ঘোষণা করছে! তবে নির্বাচন যত এগিয়ে চলেছে, পাঁচ রাজ্যের ভোটাররা ওদের দাবির যথার্থতাকে প্রতিপন্ন করার চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন। বিজেপির বিপুল অর্থ শক্তির (যা অর্জিত হয়েছে সন্দেহজনক ইলেক্টোরাল বণ্ড প্রকল্পের মধ্যে দিয়ে) এবং প্রচার যন্ত্রের মোকাবিলা করে শ্রমিক ও কৃষক, নারী ও তরুণ-তরুণীরা জনগণের ইস্যুগুলোকে সফলভাবে সামনে আনছেন এবং বিদ্বেষময় বুলির দ্বারা চালিত হতে অস্বীকার করছেন।

* (বেশকিছু নির্দিষ্ট অভিযোগ নির্বাচন কমিশনে পেশ হওয়ার পর কমিশন বিজেপি নেতা রাহুল সিনহা, দিলীপ ঘোষ ও শুভেন্দু অধিকারীর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়।)

***

শীতলকুচি – সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের প্রতিক্রিয়া

সেই পাঁচ যুবকের রক্ত এখনও তাজা। শীতলকুচির বাতাসে এখনও বারুদের গন্ধ। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের ফরমান অনুযায়ী সেখানে কেউ যেতে পারবেন না।

এদিকে দিলীপ বাবুরা কাজ শুরু করে দিয়েছেন। রগড়ে দেবার ধমকের পর এখন নতুন ধমক — শীতলকুচি করে দেব। অন্য এক বিজেপি নেতার লোকসভা নির্বাচনের ভিডিও মনে পড়ে যাচ্ছে - সোজা বুকে গুলি করা হবে।

লাশ বেছানো রাস্তায় ওরা ভাবছে ওদের বাংলা জয়ের রথ টগবগিয়ে ছুটে চলবে লক্ষ্যের দিকে।

যোগীর এনকাউন্টার রাজ ও এ্যান্টি রোমিও স্কোয়াড আর অসমের এনআরসি ও ডিটেনশন ক্যাম্প অপেক্ষা করে রয়েছে বাংলা কবে সোনার হবে।

আপনার ভোট যদি হয়ে না গিয়ে থাকে তাহলে এখনও সময় আছে। এক একটা ভোট দিয়ে বলে দিন বাংলাকে জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ হতে দিচ্ছি না।

খণ্ড-28
সংখ্যা-14