এনআরসি এবং সিএএ নিয়ে অমিত শাহ-র মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে ভুলবেন না
Amit Shah's false promises

গত ৩০ মার্চ আনন্দবাজারে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে অমিত শাহ এনআরসি এবং সিএএ নিয়ে আবার একরাশ বাজে কথা বলেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য, করোনার জন্য এখন সিএএ ২০১৯-এর মাধ্যমে নাগরিকত্ব দেওয়া সম্ভব নয়। অথচ এই করোনাকালেই সেপ্টেম্বর ২০২০-তে যে তিনটি কৃষি আইন পাশ হয় তার রুলস বা নিয়মাবলী প্রকাশিত হয় ২০২০-র অক্টোবর, অর্থাৎ এক মাসের মধ্যেই। তাহলে ২০১৯-এর ডিসেম্বরে পাশ হওয়া সিএএ আইনের রুলস ১৪ মাস কেটে যাওয়ার পরেও প্রকাশিত হল না কেন? এই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর নেই।

অমিত শাহ্ আরও বলেছে, “যখন এনআরসি আসবে, তখন বিরোধ করবেন। সিএএ-কে কেন আটকাচ্ছেন? সিএএ-তে নাগরিকত্ব না নিলে, না নিতে পারেন। অসমে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে এনআরসি হচ্ছে।” অর্থাৎ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বোঝাতে চাইছে এনআরসি আর সিএএ-র মধ্যে কোনো যোগসূত্র নেই, এগুলো আলাদা। অথচ এই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীই কিন্তু এপ্রিল ২০১৯-এ গোটা দেশকে “ক্রোনলজি” বুঝিয়েছিলেন, যে আগে সিএএ হবে তারপর দেশজুড়ে এনআরসি হবে।

অসমের নির্বাচনী ইস্তেহারেও বিজেপি নতুন করে আরেকটা এনআরসি করার কথা বলেছে। ওরা অসমে ১৯ লক্ষ মানুষের নাম বাদ দিয়েও খুশী নয়, আরও কয়েক লক্ষ বাঙালিকে বেনাগরিক করতে চাইছে ওরা। সিএএ ২০১৯ যদি সত্যি উদ্বাস্তুদের নিঃশর্ত নাগরিকত্ব দেওয়ার আইন হয় তাহলে সেই আইনে ২০১৪ বা ২০১৯-এর ভোটার লিস্টে নাম থাকা সকলকে ভারতের নাগরিক হিসেবে মান্যতা দেওয়া হল না কেন?

সিএএ ২০১৯ আইনের ২ নম্বর ধারা অনুযায়ী আফগানিস্তান, বাংলাদেশ অথবা পাকিস্তান থেকে হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি বা খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী কেউ ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪-র আগে ভারতে প্রবেশ করে থাকলে এবং কেন্দ্রীয় সরকার তাকে পাসপোর্ট অ্যাক্ট ১৯২০ এবং ফরেনার্স অ্যাক্ট ১৯৪৬-এর আওতায় অব্যাহতি দিয়ে থাকলে তাকে “ইললিগাল মাইগ্রান্ট” অর্থাৎ ‘অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে গণ্য করা হবে না। অর্থাৎ এই আইনের মাধ্যমে পূর্ব বঙ্গের উদ্বাস্তুদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ তকমা থেকে মুক্ত হতেই বেশ কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে, যেমন ভারতে প্রবেশের তারিখ হতে হবে ২০১৪-র ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে। এছাড়া পাসপোর্ট অ্যাক্ট ১৯২০ এবং ফরেনার্স অ্যাক্ট ১৯৪৬-এর আওতায় অব্যাহতি পাবে কেবল তারাই যারা ধর্মীয় উৎপীড়নের কারণে বা আশঙ্কায় ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে।

এই শর্তাবলি পূরণ হলেও কিন্তু উদ্বাস্তুরা নাগরিকত্ব পাবেন না, কেবল মাত্র ভারতের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করার যোগ্যতা অর্জন করবেন। নাগরিকত্ব পাওয়ার বিষয়ে সিএএ ২০১৯-র ৩ নম্বর ধারায় পরিষ্কার বলা হয়েছে যে “রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট” অথবা “ন্যাচারালাইজেশন সার্টিফিকেট” পাওয়ার জন্য আবেদন করতে হবে এবং কিছু শর্তমেনেই এইরকম সার্টিফিকেট দেওয়া হবে। তদুপরি, সিএএ ২০১৯-এর ৬ নম্বর ধারা অনুযায়ী নাগরিকত্বের আবেদন করার আগে আবেদনকারীকে ন্যূনতম ৬ বছর ভারতে বসবাসকারী অথবা ভারত সরকারের অধীনে কর্মরত হতে হবে। সিএএ ২০১৯-এর রুলসে এই সমস্ত শর্ত সমেত নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করার প্রক্রিয়ার বিস্তারিত বিবরণ থাকবে। মতুয়া বা নমঃশূদ্র উদ্বাস্তুদের দাবি অনুযায়ী শর্তহীন নাগরিকত্ব দেওয়া সিএএ ২০১৯ আইনের আওতায় কখনোই সম্ভব নয়। কেন্দ্রের মোদী সরকার ইচ্ছাকৃতভাবেই এই রুলস নির্বাচনের আগে প্রকাশ করেনি যাতে নাগরিকত্ব-র মুলো ঝুলিয়ে দলিত উদ্বাস্তুদের ঝুটি ধরে সমর্থন আদায় করতে পারে। মোদী সরকারের এই আচরণ প্রতারণা ছাড়া কিছুই নয়।

সাক্ষাৎকারে অমিত শাহ বলেন যে এনআরসি সংক্রান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি, তাই “মুসলিম ভাইদের ... ভয়ের কিছু নেই”! একথা বলে তিনি আসলে সত্যকে আড়াল করেছেন। দেশজুড়ে এনআরসি হবে ২০০৩-এর রুলস-এর আওতায়। এই রুলস অনুযায়ী এনআরসি-র প্রথম ধাপ এনপিআর (ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্টার)। ১ এপ্রিল ২০২০ থেকে এই এনপিআর জনগণনার সাথে শুরু হওয়ার কথা ছিল, করোনার জন্য পিছিয়েছে। এই এনপিআর প্রক্রিয়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে কোনো দিন আবার চালু করে দিতে পারে। এই এনপিআর করে তারপর এনআরসি তৈরি করতে গেলে শুধু মুসলিম সংখ্যালঘুরাই নন, বাদ পড়বেন লক্ষ লক্ষ দলিত, আদিবাসী, ভূমিহীন প্রান্তিক মানুষজন, বিবাহিত মহিলা, অসংগঠিত ক্ষেত্রের পরিযায়ী শ্রমিক, বস্তিবাসী এবং পথ-বাসীরা।

অমিত শাহ ভোটের আগে‌ আজে বাজে কথা বলে এদের সকলকে বিভ্রান্ত করছে। বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় এলেই এনপিআর-এনআরসি করবে, এবং তাতে বাংলার লক্ষ লক্ষ মানুষ বিপদে পড়বেন, এটাই বাস্তব।

- প্রসেনজিত বোস 

খণ্ড-28
সংখ্যা-12