ভাঁজছে নতুন ভাঁজ
Folding new folds

বিজেপি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা বেছে নিল তৃণমূল দল ভেঙে আসা সবচেয়ে ডাকসাইটে নেতাকে। দলের সামনে এছাড়া অন্য কোনো ওজনদার কেউ নেই। পুরোনো প্রথম সারির রাজ্য নেতারা কেউ জিততে পারেননি, হেরে বসে আছেন। ফলে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে বাংলার বিধায়ক নেতা বাছাইয়ে প্রাথমিকভাবে তাকাতে হয়েছে পর্যায়ক্রমে টিএমসি ছেড়ে আসা নির্বাচনে বিজয়ী দুই নেতার দিকে। তাদের একজন টিএমসি-র ভেঙে বিজেপিকে বড় করতে 'চাণক্য'-র ভূমিকা রেখেছেন, আরেকজন দেখিয়েছেন বিজেপির ফ্যসিস্ত আগ্রাসনের চাহিদা পূরণের সবচেয়ে আগ্রাসী ভূমিকা। যদিও প্রথমজন জিতেছেন দ্বিতীয়জনের তুলনায় অনেক বেশি ভোটের ব্যবধানে, তবু বিরোধী নেতা হওয়ার ভাগ্য খুলল অবশেষে শেষোক্ত জনেরই। তৃণমূল নেত্রীকে হারানোর ট্রেডমার্ককে সবার ওপরে নজীর করে রাখতে। গোটা নির্বাচন প্রচারাভিযানে বিজেপির শীর্ষ নেতাযুগল সহ প্রধানতম তারকা প্রচারক ছিলেন যে চার-পাঁচজন, তার মধ্যেও ছিলেন উপরোক্ত ডাকসাইটে নেতা। বিধায়ক নেতা নির্বাচন করার প্রস্তাবেের আনুষ্ঠানিক উত্থাপন করানো হল 'চাণক্য' নেতাকে দিয়ে। এর পিছনেও একটা চাল আছে। যাতে এনিয়ে দলের প্রাক্তন তৃণমূলীদের মধ্যে কোনো গোষ্ঠী কোন্দল মাথা তুলতে না পারে তার উৎস মুখে জল ঢেলে দেওয়া।

বিজেপির নবনির্বাচিত বিধায়ক দলনেতা প্রারম্ভে গৌরচন্দ্রিকা করেছেন, তাঁর ভূমিকা থাকবে বিধানসভার ভিতরে ও বাইরে গণতন্ত্রের জন্য লড়াইয়ে এবং যেখানে প্রয়োজন রাজ্য সরকারের প্রতি গঠনমূলক আচরণে!

এই নেতার মুখে ‘গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী’ সাজার কথা শোনাচ্ছে প্রহসনের মতোই। নন্দীগ্রাম কেন্দ্রের এই বিজেপি প্রার্থী প্রচারে গণতন্ত্রের প্রশ্নটিকে কেমন ব্যবহার করতে মরীয়া হয়েছিলেন তার নমুনা আর কারও অজ্ঞাত নেই। ‘গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা’র ডুগডুগি বাজিয়েছিলেন ফ্যাসিবাদী শক্তিকে এরাজ্যে ক্ষমতায় আনতে। ফ্যাসিবাদ যে সর্বদা কোনো না কোনো রূপের ‘শত্রুপক্ষ’ নিশানায় রেখে কেবলমাত্র প্রশ্নাতীত আনুগত্যের ‘গণতন্ত্র’ চায় তার পরিচয় পাওয়া মিলছে কেন্দ্রের মোদী রাজ চলার মধ্যে, উত্তরপ্রদেশের যোগী রাজের মধ্যে, অসমে হাড়হিম ধরানো হিমন্ত বিশ্বশর্মার রাজত্বে, ত্রিপুরায় বিজেপির দমন-পীড়নের রাজশাসনে। বাংলার বিধানসভায় বিরোধী নেতার আসনে যাকে নিয়ে আসা হল তিনি নির্বাচনী প্রচারে তুঙ্গে তুলেছিলেন বিদ্বেষ-বিভাজন-হিংসা-হুমকির রাজনীতিকে, রাজনীতির সাম্প্রদায়িকীকরণকে ব্যবহার করেছিলেন সমস্ত সীমা ছাড়ানো মাত্রায়। কৃষক আন্দোলনের ঐক্যের ঐতিহাসিক প্রাঙ্গনকে সামনে থেকেই বিভেদ আর হানাহানি বাধিয়ে দেওয়ার ক্ষমাহীন অপরাধ করেছেন। তাই আজ ‘গণতন্ত্রের পরিত্রাতা’ সাজতে চাইলে হয়ত বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ‘গুডবুকে’ নাম তুলতে পারবেন, কিন্তু জনগণকে বোকা বানাতে পারবেন না।

নব বিরোধী বিধায়ক নেতা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের বুলি আউরানোর আড়ালে আসল নয়া কিছু পরিবেশ তৈরি করতে চাইছেন। এটা বাস্তব যে, নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতিতে কিছু হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেছে, হয়ত এখনও ঘটে চলেছে। যদিও এর জন্য বিজেপিরই নির্বাচনী প্রচারে বিষোদগার সবচেয়ে দায়ী, তবু তার হিংসাত্মক প্রতিক্রিয়া ও তার মাশুল গুণতে যুযুধান দলগুলোর উভয়পক্ষেরই যে ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে, তা একেবারেই কাম্য নয়, রাজ্য প্রশাসনকে তা থামাতে হবে, যাদের বিশ্বাসযোগ্যতা রয়েছে তাদেরকে শান্তি-সম্প্রীতি ফেরানোর উদ্যোগ নিতে দিতে হবে। কিন্তু বিজেপি ভাঁজছে ‘একের মধ্যে তিন’ জুড়ে অশান্তি বাধানোর নয়া পরিকল্পনা। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের পাঠানো টিম, রাজ্যপাল ও বিধানসভার বিরোধী দলনেতা, সবার মুখ দিয়ে বেরোচ্ছে একই গরল। যেন করোনার চেয়েও বড় ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতি এখন টিএমসি-র সন্ত্রাসে বিজেপির শিকার হওয়া! যে প্রচারিত ‘সন্ত্রাসের’ অধিকাংশই ভূয়ো, সাজানো। যে সাজানো প্রচার এমনকি চালানো হচ্ছে করোনার মোকাবিলায় মোদী বন্দনা করে! অথচ যে প্রশ্নে মোদী সরকার চরম অমানবিক ধিক্কার কুড়োচ্ছে দেশে-বিদেশে! করোনার মোকাবিলা নিয়ে রাজ্য বিজেপির কোনো কর্মসূচী নেই, বিরোধী নেতার মুখে কোনো অগ্রাধিকার নেই। ওরা কেন্দ্রের কাছ থেকে করোনা যুদ্ধের রসদ আদায়ের রাজ্যের অধিকারের দাবিতে বিন্দুমাত্র সরব হওয়া দূরের কথা, ন্যূনতম দরবার করার নাম করছে না। এই হচ্ছে ওদের ‘গঠনমূলক আচরণের’ ফ্যসিস্ট নমুনা।

আজকের নতুন পরিস্থিতিতে, বিশেষত করোনার পরিপ্রেক্ষিতে, বিজেপির শয়তানির স্বরূপগুলো চিনতে হবে, এর রাজনৈতিক-সামাজিক মোকাবিলা করতে হবে।

খণ্ড-28
সংখ্যা-17