বুঝে নিক গৈরিক দুর্বৃত্ত
Editorila Heading

পশ্চিমবাংলার ২০২১-এর নির্বাচনের বাকী অর্দ্ধেক পর্ব শেষ হওয়ার পথে। এমন অনভিপ্রেত আট দফায় প্রলম্বিত, মানবাধিকার বিরোধী, ব্যয়বহুল ও বিপজ্জনক বিদ্বেষ-বিভাজন সর্বস্ব নির্বাচন এর আগে কখনও পশ্চিমবঙ্গে হয়নি। সত্তর দশকে কংগ্রেসী সন্ত্রাসে ভোট লুঠের কারণে ১৯৭২-এর নির্বাচন পরিণত হয়েছিল প্রহসনে। দীর্ঘ বামফ্রন্ট শাসনে একাধিক নির্বাচন কলুষিত হয়েছিল রিগিং আর সন্ত্রাসের কারণে। তৃণমূল শাসনেও তার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে, বিশেষত ২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচনে। কিন্তু এর কোনোটাই বিজেপির তুলনায় ধারে কাছে আসে না। নির্বাচনী গণতন্ত্র নিপীড়িত হওয়ার বাংলার কালপঞ্জীতে বিগত নজিরগুলো আজ আর শীর্ষতম হিসেবে বিচার্য হতে পারে না। কারণ এবারের নির্বাচনে সমস্ত দিক থেকেই বীভৎসতা সংঘটিত হচ্ছে নজীরবিহীন মাত্রায়। আর তা সংগঠিত করছে আরএসএস চালিত বিজেপি।

আট দফায় নির্বাচনের যুক্তি ধোপে টেঁকে না। তৃণমূলী নির্বাচনী সন্ত্রাসের পুনরাবৃত্তি হতে না দেওয়ার যুক্তিজাল বিছানোটা একটা অজুহাত। আসল লক্ষ্য হল নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ জোড়া ফলার চাহিদা মতো সভা-সমাবেশ করতে পারার সময় সুযোগের বন্দোবস্ত করে দিতেই এত দফা আয়োজনের বহর। অলক্ষে কেন্দ্রের শাসকদলের প্রভাব খাটানো হয়েছে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের ওপর। নির্বাচন কমিশনও বকলমে বিজেপির প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখিয়ে আসছে একের পর এক। তার তোফাও মিলছে হাতে গরম! নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাঝপথে মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের অবসরগ্রহণের দিনক্ষণ ছিল পাকা, আর তিনি বিদায় নেওয়ার পরপরই পুরস্কার হিসেবে পেয়ে গেলেন গোয়ার রাজ্যপাল পদ। তাঁর জায়গায় স্থলাভিষিক্ত হয়ে গেছেন নতুন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার। কমিশনের সব সদস্যের সামনে পিছনে গোপনে হয়ত ঝুলছে নানা টোপ। নয় কি? নাহলে করোনা আগ্রাসন ধেয়ে এলেও এবং সেই বিপদ বুঝে বাকি সমস্ত নির্বাচন এক দফাতেই সেরে ফেলার যুক্তি থাকলেও, কে শোনে কার কথা! না শুনছে বিজেপি, না শুনছে নির্বাচন কমিশন। ভোটদানের অবাধ পরিবেশ, ভোটারদের নিরাপত্তা রক্ষার কথা বলে বিপুল সংখ্যায় আনা হল কেন্দ্রীয় বাহিনী। তার অনর্থক বিপুল আর্থিক খরচের দুঃসহ বোঝা চাপানো হল রাজ্যের কাঁধে। কোথায় সুরক্ষিত থাকল নিরাপত্তা! পড়ল ছাপ্পা ভোট, কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠল বিজেপির হয়ে প্রভাব খাটানোর, ভোটের লাইনে বাহিনী দৌরাত্ম্য দেখিয়েছে; গুলি করে মেরে ফেলেছে চারজন নিরীহ নাগরিককে। ঘটনাচক্রে তাঁরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। সন্দেহ দানা বাঁধছে, গুলিকান্ডের পিছনে কেন্দ্রের শাসকদল বিজেপির ইন্ধন ছিল। বিজেপি ক্ষমতায় থাকলে গণতন্ত্রের কত বিপদ তার প্রমাণ মেলে গুজরাটে, উত্তরপ্রদেশে, ত্রিপুরায় ও অন্যত্র। ইউএপিএ থেকে এনআরসি-এনপিআর-সিএএ; সিট থেকে নিয়া-র নিপীড়নমূলক হাতিয়ার প্রয়োগেও বোঝা যায় বিজেপি কেমন প্রশ্নাতীত সমালোচনারহিত শেকল পরানো 'গণতন্ত্রে'র প্রবর্তক। পাশাপাশি নির্বাচন সম্পন্ন করার পেছনে সরকারি অর্থের শ্রাদ্ধ চলেছে। তার ওপর কোটি কোটি টাকা ওড়ানো হচ্ছে দলীয় নির্বাচনী খরচে। কোটি টাকার এক-একটি রোড-শো, সভা করছে বিজেপি। এপর্যন্ত হিসাব হল, নির্বাচনী প্রচারে বিমান-হেলিকপ্টার বাবদ খরচ হয়েছে একশ কোটি টাকার ওপর। এর নব্বই শতাংশই খরচ করেছে বিজেপি। এখনও নির্বাচনী প্রচার শেষ হতে দু-দফা বাকি। সুতরাং আরও কোটি কোটি টাকা উড়বে। প্রধানমন্ত্রী বিদেশ থেকে কালো টাকা আনার কথা দিয়েও ফাঁকি দিয়ে চলেন। অন্যদিকে তাঁদের দলের নির্বাচনী খরচের জন্য এত অগুনতি অর্থের যোগান আসে কোথা থেকে? ‘পি এম কেয়ারস্ ফান্ড’ থেকে? যেটিকে ক্ষমতার জোর খাটিয়ে হিসাব দেওয়ার আওতার বাইরে রাখা হয়েছে! নাকি পেয়ারের শিল্পপতিদের কাছ থেকে ইলেক্টোরাল বন্ডের বিনিময়ে স্রোতের মতো আসছে অর্থরাশি! এতসব দেখেও নির্বাচন কমিশন অদ্ভুত নির্বিকার! অথচ অর্থের অভাব দেখিয়ে জনখাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় আবশ্যিক ন্যূনতম কতকিছু মেটানো হয় না। বাংলায় ভোট চাইতে নেমে কেন্দ্রে ও কয়েকটি রাজ্যে ক্ষমতায় থাকা বিজেপির হিম্মৎ নেই গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও সম্প্রীতির লক্ষ্যে কি করেছে সেইসব জবাব দেওয়ার। দেশজুড়ে কর্মসংস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিস্থিতির এত শোচনীয় হাল কেন? কেন কৃষক তার উৎপন্ন ফসলের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না, ঋণফাঁস থেকে তার মুক্তি মিলছে না? কেন শ্রমিকের অস্তিত্ব মূলত নির্ভর হয়ে যাচ্ছে পরিযায়ী শ্রমিকে পরিণত হয়ে যাওয়ার মধ্যে? কেন শিক্ষা এত ব্যয়বহুল ও সংকোচনের শিকার হচ্ছে? কেন স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অবস্থা তথৈবচ? কেন করোনার ছোবল থেকে বাঁচার দায় কেবল রাজ্যগুলোর তথা জনতার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে? কেন করোনা পরীক্ষা নিয়ে বেসরকারি চড়া মূল্যের ব্যবসা চলতে দেওয়া হচ্ছে? কেন্দ্রীয় সরকার ভ্যাকসিনের দাম নির্ধারণে বিস্তর বৈষম্যের পলিসি চাপিয়ে দেয় কি করে? মুনাফাখোর উৎপাদক-ব্যবসায়ীদের তোষণ করতেই নয় কি! জনজীবনের এইসব আরও কত কি বিষয় রয়েছে। যার প্রত্যুত্তর এড়িয়ে বিজেপি নির্বাচনকে ভাসাতে মরীয়া বিদ্বেষ-বিভাজন-সাম্প্রদায়িক-জাতিবাদী রাজনীতির জিগিরে।

বিজেপিকে তাই আর ধোঁকাবাজি চালাতে দেওয়া যায় না, ঠাঁই দেওয়া নয়, ভোট দেওয়া নয়; ভোটদানে নিশ্চিত করতে হবে। বাংলার মাটি দূর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক গৈরিক দুর্বৃত্ত!

খণ্ড-28
সংখ্যা-15