সংকল্প হয়ে উঠুক ব্রহ্মাস্ত্র
Let the resolve become Brahmastra

বিজেপিকে ক্ষমতায় আনলে তবেই আসবে ‘আসল পরিবর্তন’ — এই প্রচারে জনমত ভাসাতে মরীয়া মোদী-শাহদের দল। প্রবল অর্থবল সহযোগে রোড-শো, সভা-সমাবেশ, নিজেদের দ্বারা নিজেদের জন্য পুস্পবৃষ্টি, রাশি রাশি প্রচারপত্র-ইস্তাহার বিলোনো, ডিজিটাল ও মিডিয়ার ব্যাপক প্রচার, এই সবকিছুর দৌলতে একটা বিশাল কিছু করে দেখানোর ছাপ ফেলতে অতি সক্রিয় বিজেপি। এটা সার বিষয় যে, বিজেপি এরাজ্যে ছোট থেকে বড় হতে পেরেছে কোনো আন্দোলন করে নয়। হিন্দুত্বের এক আভ্যন্তরীণ চাপা উৎসে রাম রাজনীতির বাহ্যিক প্রভাবে এক ধীর বৃদ্ধির গতিধারা এখানে তার ছিল। বিগত লোকসভা নির্বাচনে পেয়ে যায় ৩০ শতাংশ বাম ভোট, আর এবারের নির্বাচনে জুটেছে তৃণমূল ভাঙা ডাকাবুকো একটা অংশ, এই তৃণমূল ছুট অংশের ভোট-প্রভাব ঠিক কতটা তা বুঝে ওঠা এখনই সম্ভব নয়। দলটা দুই ভিন্ন নির্বাচনী পরিস্থিতিতে দুই উপর্যুপরি সুযোগে ফায়দা তুলেছে। আর এখন বড় বাড়তে চাইছে ‘গণতন্ত্র ও উন্নয়ন পুনরুদ্ধারের’ হাতছানি আর ‘এক পার্টি’ ও ‘ডবল ইঞ্জিন সরকারের’ বোলচাল দিয়ে। এসব করে উঠতে না পারলে বিজেপির এতটা বেড়ে ওঠা সম্ভব ছিল না। যতই ফুলে ফেঁপে উঠুক মাত্র পাঁচ বছরে পাওয়া ভোট এখনও তার নিশ্চিত ভোট নয়। এখনও এই ভোটের ব্যাপক অংশে দোলাচল ভাসমান ভাব থাকবে। অতএব, যথোচিত প্রধান প্রতিপক্ষের গুরুত্ব দিয়ে বিজেপির উন্মোচন ও বিরোধিতা চালিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। তার সাথে দরকার মানুষের জীবন-জীবিকার আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহকে তুলে ধরা। তাহলে তার পায়ের তলা থেকে আলগা মাটি সরিয়ে দেওয়া সম্ভব। আর এভাবে যেমন বাম শক্তি যেমন পারদর্শী হতে পারবে বাম সমর্থনের পরিধির বিস্তার ঘটাতে, তেমনি খোয়ানো বাম ভোট ফিরে আসতে পারে বাম পরিসরে। বৃহত্তর গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তিগুলোও নতুন করে প্রকৃত বাম দিশায় আকর্ষিত হতে পারে। পরিস্থিতি যেমন বিজেপির দিক থেকে আগ্রাসন ধেয়ে আসার নিরীখে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি প্রতিকূল, তেমনি বিজেপিকে হারানোর মাধ্যমে তার থাবা থেকে বাংলাকে বাঁচানোর আহ্বানও সাড়া পাচ্ছে।

প্রচারের শেষ বেলায় পৌঁছে কর্মসংস্থান প্রশ্নে জেরবার বিজেপির চাণক্য নেতা অমিত শাহ অগত্যা বলছেন, বাংলায় ক্ষমতায় এলে রাজ্যের পাটশিল্পের পুনরুজ্জীবন ঘটানো হবে, তার জন্য নাকি আড়াই হাজার কোটিটাকা বরাদ্দের কথা ‘সংকল্প পত্রে’ রাখা হয়েছে! তাছাড়া শিল্প পার্ক, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প, হিমঘর তৈরি, কৃষিসংস্কার হবে। কিন্তু এযাবত এসব প্রয়াস কেন চালানো হয়নি বা হবেই যে তার নিশ্চয়তা কি, সেইসব প্রশ্নে শাহজী আর কথা বাড়ানোয় নেই। দাবি করছেন বছরে এক-দু কোটি হাতে নতুন রোজগারের অবস্থা তৈরি হবে। তবে রোজগার মানে কোনো চাকরি নয়। মানে স্থায়ী কোনো কর্মসংস্থান হবে না। ফের সেই বছরে দু’কোটি বেকারের হাতে চাকরির ভাঙা রেকর্ডের বদলে এবার শোনানো হচ্ছে অস্থায়ী রোজগারের নতুন প্রতিশ্রুতি। শাহজী আরও শুনিয়েছেন ‘ল্যান্ড ব্যাঙ্ক’ গঠন করা হবে ‘কৃষক-কর্পোরেট-জেলাশাসক মিলে। তার মানে ‘শিল্পের নামে’ আবার হাত পড়বে কৃষি জমিতে, তার জন্য ‘কৃষক প্রতিনিধি’ হিসাবে রাখা হবে কিছু অনুগত লোকজনকে, যারা অন্যায় জমি গ্রাসের ওপর ‘সম্মতির সীলমোহর’ লাগাতে সহায়ক হবেন, ঠিক যেমন কৃষক বিরোধী তিনটি আইনের স্বীকৃতি আদায়ে অনুগত কৃষক নেতাদের ব্যবহার করা হয়েছে। রাজ্যে হাজার হাজার একর পরিত্যক্ত জমি রয়েছে বছরের পর বছর বন্ধ হয়ে থাকা কলকারখানার। এইসব জমিতে শিল্পের পুনরুজ্জীবনের নির্দিষ্ট ভাবনা থাকছে না কেন? জমি জট থাকতে পারে। সদিচ্ছা থাকলে জরুরি পদক্ষেপ করে সেইসমস্ত জটজটিলতা দূর করা যায়, কিন্তু হচ্ছে না কেন? কারণ, মোদী সরকার আর বিজেপির কাছে অনেকবেশী তাড়নার বিষয় হল, তথাকথিত বাংলাদেশী অনুপ্রবেশ এবং তৃণমূল সরকারের ‘সংখ্যালঘু তোষণ’-এর সমস্যা! এহেন নন-ইস্যুকে ‘ইস্যু’ বানানোটা উন্মাদনা সৃষ্টির রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যেই। তার জন্য বিজেপি অহেতুক জিগির তুলতে পারে সিএএ নিয়ে, নাগরিকত্ব প্রদানের আইন সংশোধন ও রূপায়ণ নিয়ে। কিন্তু কর্মসংস্থানের প্রশ্নে তাদের কোন সত্যিকারের মাথাব্যথা নেই, স্বচ্ছ অবস্থান নেই, শোনানো হচ্ছে কেবল ক্ষমতায় এলে ‘ল্যান্ড ব্যাঙ্ক’ তৈরির গল্প। এখানে ‘ডবল ইঞ্জিনে’র সরকার আনলে শাহজী বলছেন, গঠন করবেন সরকারি কর্মচারিদের জন্য সপ্তম বেতন কমিশন। অন্যদিকে মানুষের কাছে ধরা পড়ে যাচ্ছে সেই চাতুরি। পার্শ্ববর্তী রাজ্য ত্রিপুরায় বিজেপি সরকার ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছে সরকারি কর্মচারিদের পেনশন তুলে দেওয়ার প্রাথমিক লক্ষ্যমাত্রা। বোঝার অপেক্ষায় রাখছে না, বিজেপি শাসনে এসবই হল ‘আসল পরিবর্তন’! বাংলাকে মুঠোয় আনতে পারলে এসবই করবে। তাই পক্ষান্তরে, এই বিজেপিকে বাংলায় প্রতিহত করতে যা প্রয়োজন তা করতে হবেই। কথায় আছে, নির্ভুল বিচার বিশ্লেষণ থেকে জন্ম নেয় নির্ভুল প্রত্যয়, আর নির্ভুল প্রত্যয় থেকে তৈরি হয় টানটান সচেতন সংকল্প। বিজেপির বিরুদ্ধে এটাই হয়ে উঠুক ব্রহ্মাস্ত্র।

খণ্ড-28
সংখ্যা-12