২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে কত সুর আর কত গান
How many tunes

ভারতের পূর্বদেশে, এই অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবাংলায় আট পর্বের ভোটের মধ্যে তিন পর্ব ইতিমধ্যেই সমাপ্ত হয়েছে। বাংলায় এবারের ভোটপর্ব অভূতপূর্ব। কেন্দ্রীয় শাসক বিজেপি পরিচালিত তথাকথিত নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন(!) কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে এই নির্বাচন পরিচালনা করছে। অনেকদিন পর বাংলার মসনদ দখল করার জন্য গো-বলয়ের ফ্যাসিষ্ট বিজেপি ‘জয় শ্রীরাম’ ধরনের আক্রমণাত্মক শ্লোগান তুলে সমস্ত শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তারা যেভাবে হোক এবার বাংলাকে তাদের ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান’ প্রকল্পর অংশীদার করে, হিন্দি বলয়ের এক উপনিবেশ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। স্বভাবতই অলীক কুনাট্য রঙ্গের কোনো কমতি নেই। এমনকি গণতন্ত্রের উৎসবে রাষ্ট্রীয় রাইফেলের দ্বারা বাঙালির রক্ত ঝরানোরও খামতি নেই। কুচবিহারের শিতলকুচিতে সিআরপি’র গুলিতে ভোটের লাইনে দাঁড়ানো চারজন বাঙালি মুসলমান পরিযায়ী শ্রমিকের শহীদ হয়ে যাওয়া, এর অনন্য উদাহরণ।

যাই হোক, এবারের নির্বাচনে ঐতিহাসিক কাল হতে নির্মিত বাংলা ও বাঙালির যে বিশেষ সামাজিক আচরণবিধি সেটাই আক্রান্ত। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার নবজাগরণের পর্যায়ে রামমোহন, ১৮৫৭র মহাবিদ্রোহ, সন্যাসবিদ্রোহ, বিদ্যাসাগর, ইয়ংবেঙ্গল, মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ ইত্যাদিদের হাত ধরে এবং পরবর্তীতে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন ও বাংলার বামপন্থী কম্যুনিস্ট আন্দোলনের পথ বেয়ে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল যে ধর্ম নির্বিশেষে সংহতি ও সম্পৃতির ইমারত সেটাকেই আজ ভূলুণ্ঠিত করার চক্রান্তে নেমেছে ফ্যাসিষ্ট বিজেপি-আরএসএস। স্বভাবতই এর বিপরীত সামাজিক-সাংস্কৃতিক চলনও পরিদৃশ্যমান। এমনিই “এত ভঙ্গ বঙ্গদেশ, তবু রঙ্গে ভরা”। এতো নির্বাচন, ভোট! কবে সেই দাদঠাকুর শরৎচন্দ্র পণ্ডিত গান লিখেছিলেন “ভোট দিয়ে যা আয় ভোটাররা/ যদুর কপালে আয় ভোট দিয়ে যা”। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। অজস্র গান ও সৃষ্টির প্লাবনে ভেসে যাচ্ছে বাংলার সামাজিক প্রচার মাধ্যম। কারণ বাংলায় ভোট জনগণের উৎসব। একদম নীচুতলা থেকে উপরতলার অংশগ্রহণে বাংলার ভোট জমজমাট। ভূভারতে এই অভিজ্ঞতা অনুপস্থিত। বাংলায় ভোট দেয় প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ। স্বাভাবিক কারণেই কিছু বিশৃঙ্খলা যেমন থাকে, অন্যদিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে পশ্চিমবাংলা একোমোদ্বীতিয়ম। যাই হোক ভোটে সৃষ্ট গানের সবটা আলোচনা করা একটা লেখার কম্ম নয়। কয়েকটি ‘আসল কম্ম’কে দেখে নেয়া যাক। ‘নিজেদের মতে নিজেদের গান’ এই টাইটেল দিয়ে বাংলার লব্ধপ্রতিষ্ঠ কলাকুশলীরা একটি গান বেঁধেছেন এই ভোটে। লিরিকটা একটু তুলে দিলে অন্যায্য হবে না। “তুমি পুরাণকে বলো ইতিহাস/ ইতিহাসকে বলো পুরানো/ তোমার কাজ শিক্ষাকে লাঠিপেটা করে মূর্খের জ্বালা জুড়ানো/ তোমার ভক্তিতে দাগ রক্তের/ তুমি কাউকেই ভালোবাস না/ তুমি দেশাথি করতে এসেছ/ দেশপ্রেমের কিছুই জানোনা/ তোমার কোনো কথা শুনবো না আর/ … যথেষ্ট বুঝি কীসে ভালো হবে/ নিজেদের মতো ভাববো/ আমি অন্য কোথাও যাব না/আমি ভারতবর্ষেই থাকবো…”। এই হোলো পার্টি বা দলতন্ত্র বহির্ভূত বাংলার উদার গণতান্ত্রিক কণ্ঠস্বর। এই উচ্চারণের মাধ্যমেই তাঁরা বিজেপি-আরএসএসের বিপদকে রুখতে চায়। এর বাইরে যে গানটার উল্লেখ না করলেই নয় সেটার স্রষ্টা সিপিএম। সিপিএমের পক্ষ থেকে আর কোনো গান যে লেখা হয়নি তা কিন্তু নয়। কিন্তু সেগুলো অভিনব কিছু নয় বলেই উল্লেখ করা হলনা। এই প্রথম সিপিএমের পক্ষ থেকে ব্রিগেড সমাবেশের প্রাক্কালে ডিজে বাজিয়ে ‘টুম্পা সোনা হাম্পি দে না’র সুরে এক গান বাঁধা হয়েছে যা কিনা বাংলার বাম-গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক ইতিহাসে অভূতপূর্ব। বাংলায় ‘লা মার্সাই’এর সুরে গান হয়েছে, চটুল আঙ্গিকে নিবারণ পণ্ডিতের ‘মূর্খ গিদাল’ কিংবা হেমাঙ্গ বিশ্বাসের ‘মাউন্ট ব্যাটন মঙ্গলকাব্য’ও আমরা শুনেছি। কিন্তু একটি চটুল অবক্ষয়ী সংস্কৃতি থেকে ধার করা গণজাগরণের প্যারডি আমরা কখনোই শুনিনি। সেদিক দিয়ে দেখলে গণসংস্কৃতির ক্ষেত্রে এ এক অনন্য উদাহরণ। আগামি বাংলার বামপন্থী আন্দোলনই এর স্থান নির্ধারণ করবে। এবার আমরা উল্লেখ করব এই ভোটে সৃষ্ঠ বিজেপি সাংসদ বাবুল সুপ্রিয় পরিচালিত একটি গানকে। ‘দিদি তুমি আমাদের ভালোবাস না’ এই টাইটেলে ছাড়া হয়েছে গানটিকে। লিরিকের অংশ দেখলেই বোঝা যায় - গানটা এরা সৃষ্টি করছেই সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের তাগিদে; সাথে যুক্ত হয়েছে এনআরসি-সিএএ চাই শ্লোগান। ‘বড় যত্ন করে মিথ্যে বলে বিকৃত করি ইতিহাস/ বৃথা স্বপ্ন দেখাও বাঙালি আবার পড়বে তোমার সিলেবাস/ না না না না/ তা হছে না, হবেনা/ … তোমার সিলেবাসে নেই/ কখনো ছিল না দলিত মেয়ে পূর্ণিমা/ মনে পড়ে সেই সিরাজগঞ্জে/ অষ্টমশ্রেণি শরীরে বালিকাবেলা/ তোমার কাজ সত্যিকে মেরে ধরে মিথ্যার ছলাকলা’। গানের প্রতিপাদ্য এতটাই অস্বাভাবিক যে অন্য দেশ বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জও ওদের দাঙ্গা সৃষ্টিকারী সৃজনের বিষয়।

লেখাটির উপক্রমণিকায় একটি কথাই বলতে হয় বাংলার জনগণ যেন - খাল কেটে কেউ নিজের ঘরে কুমির এনো না/ কুমির দেবে মারণ কামড় (ঐ কামড়ে) তুমিও শেষে বাঁচবে না/ খাল কেটে কেউ নিজের ঘরে কুমির এনো না/ কুমিরের দু’চোখেতে জল তোমায় করে যে দুর্বল/ গণতন্ত্রের মায়াকান্না (ওদের) শিকার ধরার ছল/ কুমির থাকে ঘোলা জলে, স্বরুপে দেখা না তার মেলে/ দাঙ্গা বিভেদ ঘৃণা দিয়ে (ওরা) জলটা ঘোলা করে/ ওদের ‘সোনার বাংলা’ ধাপ্পাবাজি ঐ ফাঁদেতে পড়বো না/ (ভায়ে ভায়ে দাঙ্গা করে মরবো না)/ খাল কেটে কেউ নিজের ঘরে কুমির এনো না/ তাই আগামী নির্বাচনে শ্লোগান একটাই - “বিজেপিকে কোনো ভোট নয়”।

- সিতাংশু চক্রবর্ত্তী

খণ্ড-28
সংখ্যা-14