মায়ানমারে “আর কত লাশ পড়লে তবে রাষ্ট্রপুঞ্জ ব্যবস্থা নেবে”
Maynamar Rohingas

সেনা শাসনের নির্মমতা ভোগ করাই যেন মায়ানমারের জনগণের নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশে অনুষ্ঠিত নির্বাচনী ফলাফলকে অগ্ৰাহ্য করে সেনারা ১ ফেব্রুয়ারী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে নেওয়ায় মায়ানমারে সেনা শাসনের ধারাবাহিকতাই আবার ফিরে এল। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে ১৯৪৮ সালে মুক্তির মাত্র ১৪ বছর পর ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন ক্ষমতা দখল করে মায়ানমারকে সেনা শাসনের কবজায় নিয়ে আসেন। এরপর টানা পাঁচ দশক মায়ানমার থেকেছে সেনা শাসনের নিষ্পেষণে। একের পর এক সামরিক একনায়ক ক্ষমতায় বসে কায়েম করেছেন সন্ত্রাসের রাজ, সাক্ষর রেখেছেন নির্মম পৈশাচিকতার। এরই পাশাপাশি গণতন্ত্র কায়েমের জন্য আন্দোলনের এক ধারাও চলতে থাকে, যার নেতৃত্বে থাকেন ১৯৯১ সালে শান্তি নোবেল পুরস্কার প্রাপক আউং সান সু কি। প্রধান সেনা অফিসাররা ২০১১ সালে গণতন্ত্রের কিছুটা অনুশীলন চলতে দিতে রাজি হন ২০০৮ সালে তাদের তৈরি এক সংবিধানের ভিত্তিতে। এই গণতান্ত্রিক অনুশীলন চরিত্রের দিক দিয়ে ছিল একেবারেই আংশিক, অনেকেই যেটাকে অভিহিত করেছেন ‘আধা গণতন্ত্র’ রূপে। এর ভিত্তিতে নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে অসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথ প্রশস্ত হলেও রাষ্ট্র কাঠামোর ওপর সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ বজায় রইল যথেষ্ট মাত্রায়, ২০০৮এর সংবিধান অনুসারেই। সংবিধানের ধারা অনুসারে সংসদের এক চতুর্থাংশ আসন সেনাদের জন্য সংরক্ষিত থাকে। প্রতিরক্ষা, সীমান্ত ও স্বরাষ্ট্রর মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকও সেনারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখে।

২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আউং সান সু কি’র দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) বিপুলভাবে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতাসীন হয়। এনএলডি পাঁচ বছর শাসন চালানোর পর ২০২০ সালের নভেম্বরে আবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে এনএলডি ৮৩ শতাংশ আসন পেয়ে বিপুলভাবে বিজয়ী হয়। কিন্তু সেনা কর্তারা নির্বাচনে জালিয়াতি হওয়ার অভিযোগ এনে নির্বাচনী ফলাফলকে না মানার পথে যায়। নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়েছে বলে নির্বাচন কমিশন রায় দিলেও সেনারা জালিয়াতির অভিযোগে অনড় থেকে নির্বাচনে নিজেদের প্রত্যাখ্যাত হওয়াকে পাশ কাটিয়ে ক্ষমতা দখল করে। সেনা অভ্যুত্থানের প্রধান উদ্যোক্তা হলেন সেনা প্রধান মিন আউং হাইয়াং। সেনাদের সমর্থিত দল ইউনিয়ন সলিডারিটি এণ্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও পুরোপুরি পর্যুদস্ত হয়। সেনাপ্রধান মনে করেছিলেন তাঁদের সমর্থিত দল নির্বাচনে বিজয়ী হলে তিনিই দেশের প্রেসিডেন্ট হবেন, গণতান্ত্রিক পথে। কিন্তু সেই সম্ভাবনা অধরা থাকায় তাঁর মাথায় সামরিক অভ্যুত্থান চেপে বসে। সু কি ও তাঁর দলের অন্যান্য নেতা-মন্ত্রীদের গ্ৰেপ্তার করে তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় যে তাঁরা ঘুষ নিয়েছেন, অনুমতি ছাড়াই বিদেশ থেকে ওয়াকিটকি এনেছেন, করোনার নিয়মাবলী লঙ্ঘন করেছেন, যদিও এই অভিযোগগুলোর কোনোটাই প্রমাণিত নয় এবং কিছু অভিযোগ একেবারেই তুচ্ছ। আগের অভিযোগের সঙ্গে নতুন-নতুন অভিযোগ দিন-দিন যোগ হতে থাকে।

মায়ানমারের জনসংখ্যা ৫ কোটি ৪০ লক্ষ এবং সেনাবাহিনীর সদস্য সংখ্যা ৪ লক্ষ। জনসংখ্যার তুলনায় সেনাবাহিনীর বহরকে বড়ই বলতে হবে। দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থাকার ফলে মায়ানমারের সেনাবাহিনীর মধ্যে এক শক্তিশালী কায়েমি স্বার্থ গড়ে উঠেছে। সেনাবাহিনীর আর্থিক প্রতিপত্তি বিস্মিত না করে পারেনা। সেনাবাহিনীর রয়েছে বিপুল ব্যবসায়ী সাম্রাজ্য -- নিজস্ব ব্যাঙ্ক, হাসপাতাল, স্কুল, বীমা সংস্থা, মোবাইল নেটওয়ার্ক, আনাজপাতির সংস্থা। তাদের আরো রয়েছে চুনি ও অন্যান্য দামি পাথরের খনন ব্যবসা, তামাক-বিয়ার-পণ্যদ্রব্য উৎপাদন-পর্যটন-এর মতো বাণিজ্য ব্যবস্থাপনা। সেনারা টিভি স্টেশন, প্রকাশনা সংস্থা এবং এমনকি চলচ্চিত্র নির্মাণের শিল্পও চালায়। মায়ানমার হোল্ডিংস লিমিটেড নামে বহু বাণিজ্য সংস্থার যে কংলোমারেট বা সমন্বয় সেনাবাহিনী চালায়, তাতে প্রতিটি সেনা ইউনিটের শেয়ার আছে। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রের কিছু কর্পোরেট সংস্থাও এর অংশীদার। রাষ্ট্রপুঞ্জের ২০১৯ সালের এক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মায়ানমারের সেনাবাহিনী তাদের দমনমূলক কার্যকলাপের জন্য আন্তর্জাতিকস্তরে সমর্থন পেতে তাদের ব্যবসায়ী ও অস্ত্র ক্রয়ের চুক্তিগুলোকে কাজে লাগায়। প্রসঙ্গত, মায়ানমারে ভারতীয় পুঁজিপতি আদানিদের একটা বন্দর প্রকল্প রয়েছে। এই প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণের জন্য আদানি পোর্টস এণ্ড সেজ লিমিটেড এবং মায়ানমার ইকনমিক কোঅপারেশন-এর মধ্যে চুক্তির পরিমাণ হল ৩০ মিলিয়ন ডলার। এই মায়ানমার ইকনমিক কোঅপারেশন হল সেনাবাহিনী চালিত অন্যতম বাণিজ্যিক কংলোমারেট। আদানিদের ব্যবসা এইভাবে মায়ানমারের সেনাদের সঙ্গে গাঁটছড়ায় আবদ্ধ। যে সেনাবাহিনীর অর্থনৈতিক কার্যকলাপ এত বিস্তৃত, আর্থিক স্বার্থের ডালপালা এত প্রসারিত, তারা যে নিজেদের ব্যবসায়ী সাম্রাজ্যকে অটুট রাখতে অসামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ সঁপে দেবেনা তা সহজেই বোধগম্য। মাথিয়েসন নামে জনৈক বিশেষজ্ঞ বলেছেন, “নিজেদের স্বার্থ সুরক্ষিত করতেই এই সামরিক অভ্যুত্থান। (ওরা মনে করল) উনি (সু কি) এবার এমন রায় পেয়েছেন যাতে আমাদের অর্থনৈতিক ও সাংবিধানিক ক্ষমতাকে, অভিযুক্ত হয়ে মামলার মুখোমুখি হওয়া থেকে অব্যাহতির অধিকারকে খর্ব করা যাবে। কোনোভাবেই নিজেদের এমন অসহায় করে তুলতে আমরা পারি না”।

মায়ানমার সেনার চরিত্র সম্পর্কে মাথিয়েসন আরো বলেছেন, “এটা সম্পূর্ণরূপে অসংশোধিত ও পুনর্গঠিত না হওয়া স্বৈরাচারী, পৈশাচিক প্রতিষ্ঠান যার ডিএনএ’তে রয়েছে হিংসা ও নৃশংসতা”। মায়ানমারের সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে, দেশের আপামর নাগরিকদের বিরুদ্ধে সেনারা চালায় ধর্ষণ ও অন্যান্য রূপের যৌন হিংসা, বিচারবহির্ভূত হত্যা, তীব্র নিপীড়ন; তারা বলপূর্বক শ্রমদানে এবং সেনাবাহিনীতে যোগদানেও বাধ্য করে। মায়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ উঠেছে এবং সেনা প্রধান মিন আউং হাইয়াং নিজে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন, তাঁর বিরুদ্ধে হেগ-এর আন্তর্জাতিক বিচারালয়ে একটি মামলাও চলছে।

যে সেনাবাহিনীর বৈশিষ্ট্য এই ধরনের, দেশের প্রতিবাদী নাগরিকদের যারা শত্রু জ্ঞান করে, সেনা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে নামা জনগণের রক্ত ঝড়াতে তারা যে অকুণ্ঠিতচিত্ত হবে তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার নয়। বন্দুকবাজ সেনাদের নৃশংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নামা নিহত মানুষের সংখ্যা ৫৫০ ছাড়িয়ে গেছে, যাদের মধ্যে ২৭ মার্চ, সেনা দিবসের দিন রক্তঝড়া শনিবারেই নিহত হয়েছেন ১৪২ জন। নিহতেদের মধ্যে শিশুর সংখ্যা ৫০-এর কাছাকাছি। এরই সাথে আহত হয়েছেন বহু সংখ্যক জনগণ এবং গ্ৰেপ্তার করা হয়েছে কয়েক হাজার মানুষকে। রাতের বেলায় সেনারা পাড়ায়-পাড়ায় ঘুরে বেড়ায়, যথেচ্ছ গুলি চালিয়ে নাগরিকদের ভয় দেখায় এবং তাদের তালিকায় থাকা নির্দিষ্ট নাগরিকদের গ্ৰেপ্তার করে। সেনাদের আতঙ্কে সাংবাদিকরাও নির্ভয়ে কাজ করতে পারেন না। তাঁরা সব সময়েই আশঙ্কা করেন, তাঁদের গ্ৰেপ্তার করা হবে (ইতিমধ্যে ১০ জন সাংবাদিককে গ্ৰেপ্তার করা হয়েছে বলেও জানা গেছে) এবং তাঁদের বাড়িতে তল্লাশি চালানো হবে।

সেনাদের এই নির্মমতা কিন্তু প্রতিরোধের ঢেউকে রুখতে পারছে না। নিজেদের জীবনকে বাজি রেখে হাজার-হাজার যুবক, কারখানা শ্রমিক, শিক্ষক, সাধারণ জনগণ, কলেজ পড়ুয়ারা সেনা দখলদারির বিরুদ্ধে, গণতন্ত্র পুনর্বহালের দাবিতে গড়ে তুলছেন প্রতিরোধ। প্রতিরোধে নামা নেতৃত্ব বলছেন, “আসুন, আমরা দলে-দলে এগিয়ে যাই। আসুন, সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে ক্ষমতা দখল করা সরকারের বিরুদ্ধে আমাদের ক্ষমতা দেখাই, যে সরকার যুবকদের ভবিষ্যত, দেশের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করছে”। তাঁরা আরো বলছেন, “আমরা কোনো এক নেত্রীর জন্য লড়ছি না, আমরা দেশের জন্য লড়ছি, আমরা লড়ছি ভবিষ্যতের জন্য, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য”। কারেন, কাচিন, রাখাইন, রোহিঙ্গাদের মতো সশস্ত্র জনজাতি গোষ্ঠীগুলোও প্রতিরোধ বাহিনীতে যুক্ত হচ্ছে বলে জানা গেছে। কিন্তু সেনার যে বর্বরতা মায়ানমারের জনগণকে দলন করছে, রক্তের রূপে প্রতিরোধের যে মাশুল সেনারা আদায় করে নিচ্ছে, সেই রক্ত বন্যার শেষ কি কোথাও নেই? আন্তর্জাতিক মহল কি দু’একটা সেনা-বিরোধী বুলির মধ্যেই তাদের মানবিক কর্তব্যকে সীমিত রাখবে?  মায়ানমারের পরিস্থিতিতে ‘উদ্বিগ্ন’ হওয়ার মধ্যেই কি রাষ্ট্রপুঞ্জ তার ‘রক্ষা করার দায়িত্ব’ সমাধা করবে?

আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহলের একটা অংশের অভিমত হল, রাষ্ট্রপুঞ্জের অনুমোদনের ভিত্তিতে মার্কিন-গ্ৰেট ব্রিটেন-ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমর্থনপুষ্ট হয়ে মায়ানমারে কোনো সামরিক হস্তক্ষেপ ঘটলে তাতে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে উঠতে পারে, দেখা দিতে পারে বকলমে মার্কিন ও চীনের মধ্যে যুদ্ধ। এই অভিমতকে যুক্তিহীন বলে উড়িয়ে দেওয়া যায়না। বিশ্বের বড়-বড় শক্তিগুলো আজ তাদের জাতীয় স্বার্থকে, বড়-বড় কর্পোরেটদের স্বার্থকে অগ্ৰাধিকারে রেখে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিজেদের অবস্থান নেয়। আর তাই মায়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের নিন্দা করে কোনো প্রস্তাব রাষ্ট্রপুঞ্জের পক্ষে নেওয়া সম্ভব হয় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশ সচিব অ্যান্টনি ব্লিনকেন বলেছেন, “আমরা বিপর্যয়কর সামরিক হস্তক্ষেপের মধ্যে দিয়ে গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া অথবা বলপ্রয়োগ করে স্বৈরতান্ত্রিক জমানাকে উৎখাতের চেষ্টা করব না। অতীতে আমরা এই কৌশলগুলোর প্রয়োগ করেছি। সেগুলোর পিছনে যত সদিচ্ছাই থাক, সেগুলো কাজে দেয়নি”। এই মন্তব্যের মধ্যে কেউ মার্কিনের বিদেশ নীতিতে আমূল দিগপরিবর্তন দেখতে চাইলে ভুল হবে। প্রয়োজন হলে তারা ইরান বা ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে যথেচ্ছ হস্তক্ষেপ করবে; ‘জমানা বদলের’ নীতিকে কখনই বিলকুল বাতিল করবে না। দরকারে আরো একটা ইরাক, আর একটা লিবিয়া তারা ঘটাবে। আর চীনও এখন জাতীয় স্বার্থ, নির্ভেজাল পুঁজিবাদী অনুশীলনের স্বার্থকে অগ্ৰাধিকারে রেখেই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিজেদের চালিত করে। তাই তারা আউন সান সু কি জমানার সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখে, সু কি’র মুক্তির কথা, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের কথা বলে, আবার সেনা শাসনের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব গ্ৰহণেও বাধা দেয়। সেনাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে মায়ানমারে রক্তপাত বন্ধ করাই যখন বৃহৎ শক্তিগুলোর প্রকৃত কর্তব্য হত, জনগণের ওপর দমন রদ করে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার উদ্যোগে সক্রিয়তা দেখানোটাই যথার্থ মানবিক কাজ হত, তখন মুখে ‘উদ্বেগ’ দেখিয়ে সেনা শাসন ও তাদের নির্মমতাকে অব্যাহতভাবে চলতে দেওয়ার পথই তাদের কাছে অভিপ্রেত হল। সেনা প্রধান বলেছেন নির্বাচনে জালিয়াতির তদন্ত শেষ হলে, এক বছর পর জরুরি অবস্থা উঠে গেলে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই আশ্বাসে আশ্বস্ত হয়ে নিজেদের প্রতারিত করে দুনিয়া কি মায়ানমার সেনার ঝড়ানো রক্ত স্রোতকেই অনিবার্য বাস্তবতা বলে মেনে নিয়ে হাত গুটিয়ে থাকবে? নিজ-নিজ স্বার্থ তাড়িত ও নীতি-নৈতিকতা বর্জিত বিশ্বে পাশবিকতার অরাজকতা চললেও, মানবাধিকারের বিপুল বিপর্যয় ঘটলেও তার প্রতি নিস্পৃহ থাকাটাই কি রীতি হবে? মায়ানমারের প্রতিরোধ আন্দোলন থেকে যেমন আওয়াজ উঠে আসছে, “আর কত লাশ পড়লে তবে রাষ্ট্রপুঞ্জ ব্যবস্থা নেবে?”

 genocide of the Myanmar armyagainst the genocide of the Myanmar army

(মায়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের ঘটনায় সিপিআই(এমএল)-এর বিবৃতি)

মায়ানমারের সেনা শাসকরা একটা সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে অসামরিক সরকারকে উৎখাত করেছে এবং সামরিক অভ্যুত্থানের বিরোধিতায় রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানানো জনগণের ওপর নামিয়ে এনেছে পৈশাচিক দমন। মায়ানমারের সেনাবাহিনী ৫০০রও বেশি প্রতিবাদকারী অসামরিক জনগণকে গুলি করে হত্যা করেছে।
সিপিআই(এমএল) সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদরত জনগণের পাশে দাঁড়াচ্ছে ও তাদের প্রতি সংহতি জানাচ্ছে। মায়ানমারের নাগরিক বলে স্বীকৃত প্রতিবাদকারী জনগণ এবং মায়ানমারে নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলার যে প্রচেষ্টা চলছে, আমরা তাকে বিশেষভাবে স্বাগত জানাচ্ছি।

এটা অত্যন্ত লজ্জার ব্যাপার যে, মায়ানমারের সেনা শাসকরা যখন সে দেশের জনগণের ওপর গণহত্যা চালাচ্ছে, ভারত সরকার তখন ২৭ মার্চ মায়ানমারের সেনা দিবসের কুচকাওয়াজে যোগদানের জন্য তার সেনা প্রতিনিধিকে পাঠায়। আমরা এই বিষয়টারও উল্লেখ করতে চাই যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঘনিষ্ঠ দোস্ত আদানি গোষ্ঠীর সঙ্গে মায়ানমারের সেনাবাহিনীর মালিকানাধীন একটা কোম্পানির সুদৃঢ় ব্যবসায়িক গাঁটছড়া রয়েছে। আদানি পোর্টস সংস্থার সর্বোচ্চ কর্তা ২০১৯ সালে মায়ানমার সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ কর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এই সিদ্ধান্তকে এড়ানো আমাদের পক্ষে অসম্ভব হচ্ছে যে মোদী সরকার গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের মূল্যবোধের চেয়ে আদানির স্বার্থকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। সামরিক অভ্যুত্থান এবং গণহত্যার বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিতে হবে বলে আমরা ভারত সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি।

মায়ানমার থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থীদের যেন খাবার ও আশ্রয় দেওয়া না হয় বলে মনিপুরের রাজ্য সরকার যে নির্দেশিকা দিয়েছিল (পরে যা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়) আমরা তাকে ধিক্কার জানাচ্ছি; মায়ানমারে ফিরে গেলে মায়ানমারের সেনাদের হাতে যে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মৃত্যু অবধারিত, সেই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মায়ানমারে নির্বাসিত করার ভারত সরকারের প্রচেষ্টাকেও আমরা ধিক্কার জানাচ্ছি। যে দেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা নাগরিকের স্বীকৃতি পায়না এবং যেখানে তাদের গণহত্যার মুখে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে, সেই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মায়ানমারে ফেরত পাঠানোটা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন (নিপীড়নের মুখে পড়ার সম্ভাবনা থাকা দেশে শরণার্থীদের বলপূর্বক ফেরত পাঠানোর বিরুদ্ধে অধিকার)। এই ইস্যুতে একটা শুনানি গ্ৰহণের সময় সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির এই মন্তব্যেরও আমরা নিন্দা করছি: “আশঙ্কাটা হল এই যে ওদের ফেরত পাঠানো হলে ওদের হত্যা করা হতে পারে। কিন্তু আমরা এটাকে আটকাতে পারি না”।

আমরা দাবি জানাচ্ছি, ভারত আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলুক এবং মায়ানমারের সেনাদের হাতে গণহত্যা থেকে রেহাই পেতে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থী সহ সমস্ত শরণার্থীদের নিরাপদ আশ্রয় দেওয়ার দায়কে মান্যতা দিক।

খণ্ড-28
সংখ্যা-13