এক অক্ষম জনসমাজ নির্মাণ প্রকল্প
One disabled community building project

গত ৩১ মার্চ রাতে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রকের তরফে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে জানানো হয় যে ১ এপ্রিল থেকে স্বল্প সঞ্চয়ের ওপর সুদের হার কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। মুহূর্তেই তোলপাড় হল দেশ। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিবাদের ঝড় উঠল। পরদিন সাত সকালে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন ট্যুইট করে জানিয়ে দিলেন যে প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তি প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে; যা প্রকাশ পেয়েছে তা ‘অসাবধানতা’ বশত। কী কাণ্ড! তাহলে কি একজন সরকারী আধিকারিকের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি অত্যন্ত জরুরি বিজ্ঞপ্তি, মন্ত্রী, সচিব ও ঊর্ধ্বতন আধিকারিকদের এড়িয়ে গিয়ে এবং প্রয়োজনীয় ফাইল, নোট ও অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার অনুমোদন ব্যতীতই জনসমক্ষে প্রকাশ পেয়ে গেল? আর এই কথাটা স্বয়ং অর্থমন্ত্রী আমাদের বিশ্বাস করতে বলছেন?

ডাল মে অবশ্যই কুছ কালা হ্যায়! তাহলে রহস্যটা বোঝা যাক।

শুধু স্বল্প সঞ্চয়েই নয়, সাধারণ মানুষের গচ্ছিত ব্যাঙ্ক আমানতে সুদ হ্রাস থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের ডিএ স্থগিত, রেল-ব্যাঙ্ক সহ লাভজনক রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রকে বেচে দেওয়া, কৃষিক্ষেত্রের সক্ষমতা ও কৃষকের স্বাধীন রোজগারকে নির্মূল করা, শ্রমজীবী মানুষের জীবন-জীবিকাকে তছনছ করে দেওয়া, ছোট শিল্প ও স্থানীয় বাণিজ্যকে পঙ্গু করে অথর্ব করে ফেলা -- কোন কাজটি করতে এই সরকার বাকি রেখেছে? তাই, স্বল্প সঞ্চয়ে সুদ হ্রাসের পরিকল্পনাটা এদের পক্ষে মোটেও অকরণীয় কিছু ছিল না। গণ্ডগোলটা হয়েছে অর্থমন্ত্রীর খানিক রাজনৈতিক বালখিল্যতার জন্য। আসলে তিনি এটুকুই জানেন, তামিলনাড়ুর বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি কোনও ধর্তব্যযোগ্য শক্তিই নয়। কিন্তু অসম ও বাংলাতেও যে তাঁর দলকে নির্বাচনে লড়তে হচ্ছে, বিশেষ করে বাংলায় তাদের দলের অস্তিত্ব রয়েছে তীব্র ও ব্যাপক বিরুদ্ধতার সম্মুখীন হওয়া নিদারুণ সংকটে -- সেই কাণ্ডজ্ঞানটি তাঁর মাথায় কাজ করেনি। যেমন, আরও বহু সাধারণ অর্থনৈতিক বোধ তাঁরমধ্যে একেবারেই কাজ করে না (বুঝে হোক কি না বুঝে)। অতএব, সক্কাল সক্কাল তাঁর দলের শীর্ষ জুটির ধমকধামক খেয়ে সাত-তাড়াতাড়ি তাঁকে আপাতত সিদ্ধান্ত বদল করতে হয়েছে। তিনি জানেন, ১ জুলাই থেকে সেই বিজ্ঞপ্তি আবারও কার্যকর হবে।

এ তো গেল ভোটের বাজারে তিন মাস আগে বা পরে সিদ্ধান্ত স্থগিত বা চালু করার কথা। কিন্তু কেন লাগাতার এই সুদ হ্রাসের প্রয়াস? কেন সর্বতোভাবে চেপে ধরা হচ্ছে আমজনতার বেঁচে থাকার সমস্ত উপায় ও রসদকে? তা বুঝতে হলে শুধু আজকের পরিবর্তিত রাজনৈতিক-অর্থনীতিকে অনুধাবন করলেই হবে না, এদেশে বিজেপি দলটি যে নির্দিষ্ট এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে কায়েম করতে চাইছে তার ভিতরের গতিশীলতাকেও বুঝতে হবে। অর্থাৎ, উদারবাদী পুঁজিবাদী ব্যবস্থা থেকে তারা যাত্রা করতে চাইছে এক ফ্যাসিবাদী-পুঁজিবাদের দিকে (অনেকে বলেন ক্রোনি ক্যাপিটালিজম) যা তাদের ‘এক দেশ এক পার্টি’ ব্যবস্থা পত্তনের মূল ভিত্তি। তাদের সেই অভিলাষকে একটু সাজিয়ে ফেলা যাক।

১) তাদের কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হল আদানি-আম্বানি নির্ভর এমন এক নিরেট আধার গড়ে তোলা যেখানে দেশের যাবতীয় অর্থনীতির সম্পদ এসে কেন্দ্রীভূত হবে গুটিকয়েক কর্পোরেট হাউজের হাতে। এই হাউজের সঙ্গেই থাকবে তাদের গভীর রাজনৈতিক-অর্থনীতিগত সখ্য। তা এই অর্থে যে, সেই সম্পদকে কাজে লাগিয়ে তারা এমন এক বানিয়াতন্ত্র গড়ে তুলবে যেখানে ব্যক্তিগতস্তরে প্রয়োজন মতো অর্থ বিলিয়ে নিজেদের দলীয় রাজনৈতিক আধিপত্যকে নিশ্চিত করতে পারা যাবে। এইজন্যই কিছুদিন আগে এরাজ্যে এক জনসভায় অমিত শাহ খুব জোরের সঙ্গে বলেছেন যে তিনি বানিয়া এবং তাই অর্থের জন্য তার ওপর যেন সকলের বিশ্বাস থাকে। অর্থাৎ, সারা দেশ জুড়ে রাজনীতিকদের কেনাবেচা করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া বা থাকার যে কার্যসূচীটি তারা একবগ্গা ভাবে ঠেলে নিয়ে চলেছে তারজন্য অর্থের কোথাও কোনও কার্পণ্য হবেনা। ‘লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন’ (পড়ুন আদানি-আম্বানি)। শুধু রাজনীতিক কেন, এই বিপুল অর্থের অংশ দিয়ে তারা বিচারব্যবস্থা, মিডিয়া ও গণতন্ত্রের সমস্ত কলামগুলিকে দখলে নিয়ে নেবে। তাদের ‘আত্মনির্ভর’ ভারতের এই হল সার কথা। যারা টাকার কাছে বিকোতে চাইবেন না, তাদের জন্য থাকবে কেন্দ্র থেকে ছোঁড়া বাকী ব্রহ্মাস্ত্রগুলি -- এনআইএ, সিবিআই, ইডি, ইনকাম ট্যাক্স ইত্যাদি।

২) অতএব, এই উদ্দিষ্ট সাধনের জন্য প্রাথমিকভাবে দরকার, দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রগুলিকে আদানি-আম্বানিদের বেচে দেওয়া, যাতে তারা মহীরূহের মতো ‘এক-হাতে থাকা অর্থভাণ্ডার’ হয়ে গড়ে উঠতে পারে। এই এক-হাতে অর্থভাণ্ডারকে কুক্ষিগত করাটাই তাদের প্রাথমিক এজেন্ডা। করোনার সুযোগ নিয়ে এই কাজটি অনেকাংশেই কেন্দ্রীয় সরকার সম্পন্ন করে ফেলেছে। সারা বিশ্বে গত এক বছরে সব থেকে বেশি সম্পদ বেড়েছে আদানি গোষ্ঠীর।

৩) পাশাপাশি, সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতাকে ধূলিসাৎ করে দিতে হবে। এই প্রক্রিয়া দু’ভাবে চলতে পারে। এক, ব্যাঙ্ক বা স্বল্প সঞ্চয়ের প্রকল্পে বিনিয়োগ করে মানুষের হাতে যাতে খুব সামান্য অর্থ ফেরত আসে তার ব্যবস্থা পাকা করা। তার জন্যই নিয়ম করে সুদের হার কমিয়ে যেতে হবে। এইভাবে সুরক্ষিত প্রকল্পগুলি থেকে মানুষের আয় কমে গেলে তারা অধিক আয়ের জন্য শেয়ার বাজারে যেতে বাধ্য হবে। অর্থাৎ, আমজনতাকে একপ্রকার বাধ্য করা কর্পোরেট শেয়ার কিনে বা ইক্যুইটি ফান্ডে বিনিয়োগ করিয়ে বড় বড় কর্পোরেটদের হাতে নিজেদের সঞ্চিত অর্থ তুলে দেওয়া। দুই, স্থায়ী চাকরি বা শ্রম বাজারকে পঙ্গু করে শ্রমিক ও কর্মচারীদের এমন এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেওয়া যেখানে তারা মানসিক ও অর্থনৈতিকভাবে একেবারে অক্ষম হয়ে পড়বে। মোদ্দা কথায় তাদের আকাঙ্ক্ষিত চিত্রটি হল -- কর্মের কোনও সুনিশ্চিতি থাকবে না, কর্মজগতে সুরক্ষা থাকবে না, ন্যূনতম আয়েরও কোনও ব্যবস্থা থাকবে না। এই সার্বিক দ্বিমুখি কৌশলের অভীষ্ট লক্ষ্য একটিই -- এক অক্ষম জনসমাজ নির্মাণ করা যেখানে মানুষ বাধ্যত এক বিশালাকায় দৈত্যকুলের নিছক করুণার ওপর বেঁচে থাকবে।

৪) নিঃস্ব, রিক্ত ও দীর্ণ এমন এক জনসমাজ গড়ে উঠলেই তো সম্ভব ‘এক দেশ এক দল’এর স্বপ্নপূরণ। একদিকে থাকবে এক-কেন্দ্র শাসিত দেশ ও এক-দল কর্তৃক অনুশাসিত মানুষ, অপরদিকে এক অক্ষম জনসমাজ, চূড়ান্ত গণতন্ত্রহীনতা ও বিদ্বেষভরা যাপন; আড়ালে সক্রিয় মুষ্টিমেয় কর্পোরেট চালিত এক নৃশংস আর্থিক ব্যবস্থা।

এই অভিমুখেই চলেছে দেশের অর্থনীতি। চলেছে মানে, সেই পানেই তাকে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। স্বল্প সঞ্চয় বা ব্যাঙ্কের আমানতে সুদের হার কমানো এর থেকে বিচ্ছিন্ন কোনও প্রবণতা নয়। অস্থির ও অসুস্থ এক সমাজ নির্মাণের লক্ষ্যে বিজেপি আজ যেভাবে উন্মাদের মতো অগ্রসর হচ্ছে, সেখানে শুধু রাজনৈতিক, সামাজিক বা সাংস্কৃতিক আধিপত্যই যথেষ্ট নয়, অর্থনৈতিকভাবে অক্ষম ও নির্ভরশীল জনসমাজ গঠনও তার স্থির অভীষ্ট, নচেৎ, তার ফ্যাসিবাদ পূর্ণতা পাবে না।

- অনিন্দ্য ভট্টাচার্য 

খণ্ড-28
সংখ্যা-13