অরক্ষিত, নিরাপত্তাহীন দাস শ্রমিক তৈরি করলো নয়া শ্রম কোড
unprotected, insecure slave labor

১ এপ্রিল থেকে দেশব্যাপী যে শ্রম কোড লাগু হওয়ার কথা ছিল, তা সাময়িকভাবে স্থগিত থাকছে। বেশ কিছু রাজ্য কোডগুলোর নিয়ম বিধি বা রুলস এখনো তৈরি করেনি। সংবিধানে শ্রম বা লেবার যুগ্ম তালিকাভুক্ত থাকায় তাই এখন তা রূপায়ন করা যাচ্ছে না। বিগত যে বছরটি আমরা প্রত্যক্ষ করি নজিরবিহীন বেকারত্ব ও পরিযায়ী শ্রমিকদের হৃদয়বিদারক অমানবিক দুর্দশা, সেই অভিশপ্ত বছরেই মোদী সরকার সংসদে পাশ করালো তিনটি শ্রম বিল – শ্রম সম্পর্ক বা ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিলেশনস, পেশাগত সুরক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মস্থলের অবস্থা (অকুপেশনাল সেফটি, হেলথ অ্যান্ড ওয়ার্কিং কন্ডিশন্স) এবং সামাজিক সুরক্ষা বা সোশ্যাল সিকিউরিটি। দেশের বর্তমান ‘সেকেলে ও জটিল শ্রম কানুন’গুলোকে আরও আধুনিক ও সহজ সরল করার শয়তানি যুক্তির আড়ালে। তার আগে, ২০১৯-এ পাশ করানো হয় বেতন বিধি বা কোড অন ওয়েজেস। মোট ৪৪টি কেন্দ্রীয় শ্রম আইনকে চারটি শ্রম কোডে মিশিয়ে যে নয়া শ্রম আইন তৈরি হলো, কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রক মনে করছে এটাই হয়ে উঠবে আগামীদিনের গেম চেঞ্জার।

২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) শতবার্ষিকীতে পা দিল। গোটা দুনিয়া জুড়ে শ্রমিকদের আর্থিক, সামাজিক, পেশাগত ক্ষেত্রে ক্রমাবনতি ও বিশ্বজোড়া বেড়ে চলা কুৎসিত আর্থিক বৈষম্যকে ঠেকাতে আইএলও তার শতবার্ষিকীর প্রধান স্লোগান রাখে শ্রমিকদের স্বার্থবাহী ‘মানবকেন্দ্রীক’ বিকাশ বা হিউমান সেন্ট্রিক ডেভেলপমেন্ট। শ্রমিক ইউনিয়নগুলোকে আরো বেশি দরকষাকষির অধিকার সুনিশ্চিত করা, তাঁদের ন্যূনতম মজুরির লক্ষনীয় বৃদ্ধি, শ্রম আইনকে আরও বেশি শ্রম স্বার্থবাহী করা, সামাজিক সুরক্ষা মজবুত করা, প্রভৃতি বেশ কিছু অবহেলিত ক্ষেত্রে স্বাক্ষরকারী দেশগুলো যাতে রীতিমতো নজর দেয় তা একের পর এক পলিসি ঘোষণার মাধ্যমে তারা জানায়। কিন্তু, স্বাক্ষরকারী দেশ হিসাবে মোদীর ভারত করলো ঠিক তার উল্টো।

তখনও কিন্তু দুনিয়া জুড়ে কোভিড১৯ হানা দেয়নি। আমাদের দেশ কোভিড হানার ঢের আগে থেকেই আর্থিক সংকটে জেরবার হতে শুরু করে। শ্রমিকশ্রেণী সহ আম জনতার সংকুচিত ক্রয় ক্ষমতা ভোগব্যয়ের সংকট ডেকে আনে। ভারতের কর্মহীনতা ৪৫ বছরের মধ্যে পৌঁছে গেল সর্বোচ্চ সীমায়। আর, প্যান্ডেমিকের আক্রমণের পর ভারতে এই প্রথম নেমে আসে ‘টেকনিক্যাল রিসেশন’, কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষ রুটি রুজি খোয়ালেন, শুধুমাত্র গতবছর এপ্রিলেই ১২.২ কোটি শ্রমজীবী মানুষ কাজ হারালেন, আর সেন্টার ফর মনিটারিং ইন্ডিয়ান ইকনমির হিসাব অনুযায়ী ২০১৯-২০’র সাপেক্ষে এপ্রিলে কর্মসংস্থান হ্রাস পায় ৩০ শতাংশ। গোটা দেশ জুড়ে গতবছর লকডাউন ঘোষিত হলো ২৪ মার্চ। তারপর তিন তিন বার তার মেয়াদ বাড়ানো হয়। গোটা দুনিয়ায় এরকম নির্মম লকডাউন আর কোথায় দেখা যায়নি। আর, ঠিক এই পৃষ্ঠভূমির উপর দাঁড়িয়ে, অতিমারির সুযোগকে কাজে লাগিয়ে, মোদীর ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র পাশ করালো তিনটি শ্রম কোড – নতুন কাজের সুযোগ তৈরি ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির যুক্তিকে সামনে খাঁড়া করে। লকডাউনে বিধ্বস্থ বিপর্যস্থ অগণন মানুষকে আর্থিক সুরাহা দেওয়া তো দুরস্থান, তাঁদের আরো বড় সর্বনাশ ডেকে আনতে হরণ করা হলো এতদিনকার অর্জিত যাবতীয় আইনি অধিকার ও সুযোগ সুবিধা।

কাজের নতুন সুযোগ খুলে দেওয়ার লক্ষ্যে যে শ্রমকোড আনার কথা মোদী সরকার বলছে, বাস্তব চিত্রটা ঠিক কি?

ভারতের আর্থিক বৃদ্ধি হয়েছে ইনফর্মাল ক্ষেত্রের বিপুল বিকাশ ঘটিয়ে। ১৯৯১’র পর থেকে নব্য উদার অর্থনীতি বিগত ২২ বছর যাবৎ মাত্র ২.২ কোটি কাজ তৈরি করেছে, যার মধ্যে ৯২ শতাংশই ইনফর্মাল। ২০১৮-১৯’র আর্থিক সমীক্ষা অনুযায়ী ভারতের সমগ্র শ্রমশক্তির ৯০ শতাংশই ইনফর্মাল। এরমধ্যে ৭৫ শতাংশ ইনফর্মাল শ্রমিকের রুটি রুজি কেড়ে নেয় অতিমারী। অ্যাকশন এইড একটি সমীক্ষায় এই তথ্য প্রকাশ করেছে। আর, বিশ্বব্যাঙ্ক এক রিপোর্টে দেখিয়েছে, এপ্রিলে ১.২ কোটি ভারতবাসী নতুন করে যুক্ত হয়েছেন দারিদ্র সীমার তালিকায়। অক্টোবরের আরেকটা রিপোর্টে বিশ্ব ব্যাঙ্ক দেখিয়েছে, যে কোভিড১৯ কী মারাত্মকভাবে ইনফর্মাল সেক্টরের শ্রমিকদের উপর আঘাত নামিয়েছে। সেই রিপোর্টে বলা হয়েছে, “ইনফর্মাল সেক্টরের শ্রমিকরাই বিপুল সংখ্যায় কাজ হারিয়েছেন। আর যে সমস্ত পরিবারগুলো চরম দারিদ্রে নিক্ষিপ্ত হয়েছে, সেই পরিবারগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নির্ভরশীল ছিল ওই ইনফর্মাল অর্থনীতির উপরে। ইনফর্মাল সেক্টরের তুলনায় সংগঠিত বা ফর্মাল ক্ষেত্রগুলো কিছু মুনাফা অর্জন করলেও তা এসেছে কর্মীদের সংখ্যা কমিয়ে, বেতন হ্রাস করে, যা আখেরে বাড়িয়ে তুলেছে আর্থিক বৈষম্য”। আর, সমস্ত মহলই এখন এটা মেনে নিয়েছে যে প্যান্ডেমিক পরবর্তী অর্থনীতি আরও বেশি ইনফর্মাল নির্ভর হয়ে পড়বে।

জেএনইউ’র অধ্যাপক মেহরোত্রা একটি হিসাব কষে দেখিয়েছেন, ২০১২ সালের পর থেকেই কর্মসংস্থানের হার কমতে শুরু করেছে আর বিগত সাত বছর ধরে গ্রামীণ ও শহুরে ক্ষেত্রে প্রকৃত মজুরি হয় স্থিতাবস্থায় রয়েছে বা কমেছে। ২০২০ সালে এই প্রবণতা আরও নেতিবাচক হয়েছে, যা ২০২১ পর্যন্ত কমতেই থাকবে। ২০১৯’র আগে থেকেই অকৃষি ক্ষেত্রে অর্থনীতি যে মন্থরতার মুখ দেখতে শুরু করে, ২০১৯’র পর তা আরও নিম্নগামী হবে।

এরই পাশাপাশি, আইএলও’র ২০২০-২১’র বিশ্ব মজুরি রিপোর্ট (গ্লোবাল ওয়েজ রিপোর্ট) দেখিয়েছে, ২০১৫ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় (অর্থাৎ, বাংলাদেশ-নেপালপাকিস্থান-শ্রীলঙ্কা) ভারতের প্রকৃত মজুরি সবচেয়ে কম বৃদ্ধি পেয়েছে। আর, ভারতই হচ্ছে একমাত্র দেশ, ২০১৮ সালে মজুরির ক্ষেত্রে যার কোনো বৃদ্ধিই হয়নি। ২০১৯’র পরিসংখ্যান এখনও পাওয়া যায়নি।

লকডাউনের মাশুল ভারতের শ্রমিকশ্রেণিকে বিরাট মাত্রায় দিতে হয়। ২০১৭-১৮’র সাপেক্ষে এই লকডাউনের সময়ে ক্যাজুয়াল, স্থায়ী ও বেতনভুক কর্মীদের মাসিক মজুরি হ্রাস প্রাপ্ত হয় মোট ৩৩,৮০০ কোটি টাকা (ইন্দিরা গান্ধী ইনস্টিটিউট অফ ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ-এর সমীক্ষা অনুযায়ী)। ক্যাজুয়াল ও নিয়মিত/ বেতনভুক কর্মীরা এই সময় মোট বেতন থেকে যে পরিমাণ খুইয়েছেন তা যথাক্রমে ২৩.৪ ও ১৬.৮ শতাংশ।

এরকম এক পরিস্থিতিতে শ্রমজীবী মানুষের বেতন/মজুরির নিরাপত্তা বা সুরক্ষা দেওয়াটাই মোদী সরকারের অগ্রাধিকারের রাখার বদলে এই বিপুল শ্রমজীবী মানুষের রোজগারই আরো বিপন্ন হয়ে গেল সংসদে পাশ হওয়া বেতন বিধিতে। গোটা দুনিয়া জুড়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান যখন অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারের জন্য মজুরির সুরক্ষার পাশাপাশি মজুরি বৃদ্ধির পরামর্শ দিচ্ছে, মোদী সরকার ঠিক সেই সময়ে এতোদিন শ্রমিকদের যা ছিঁটেফোটা অধিকার ও সুরক্ষা ছিল তা বেমালুম লোপাট করে চরম অরক্ষিত অবস্থায় ঠেলে দিল কর্পোরেট দানবদের কবলে।

বিন্দুমাত্র সুরক্ষার বদলে পয়লা এপ্রিল থেকে যে শ্রম কোড লাগু হতে চলেছে, তা নিয়োগকর্তাকে দিল যখন তখন ছাঁটাই করার অবাধ অধিকার। এই কোডের সুবাদে গড়ে উঠতে চলেছে নব্য দাস শ্রমিকদের বিপুল এক বাহিনী ভারতীয় রাষ্ট্র যাদের দেবে না কোনো সুরক্ষা, নিরাপত্তা। শ্রম কোড পাশ হওয়ার আগেই দেশের ৪০ শতাংশ শ্রমিক বিধিবদ্ধ ন্যূনতম মজুরি থেকে বঞ্চিত। এরপর পরিস্থতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা একমাত্র ভবিষ্যৎই বলবে।

১৮ বছর আগে ভারতের দ্বিতীয় জাতীয় শ্রম কমিশন শ্রম আইনগুলোকে এক ছাতার তলায় আনার যে সুপারিশ করে, মোদী সরকার সেটাই রূপায়িত করার সিদ্ধান্ত নেয় পাঁচ বছর পর। মজার ব্যাপার হলো, যে জাতীয় শ্রম কমিশনের সুপারিশগুলোকে বাস্তবায়িত করতে মোদী সরকার এতো তৎপরতা দেখালো, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর আজ পর্যন্ত এই সর্বোচ্চ ত্রিপক্ষীয় মঞ্চের একটি বৈঠকও ডাকার তিনি সময় পেলেন না। নতুন শ্রম কোডে শিল্প সম্পর্কে আমূল বদল আনবে ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্ট। এটা হলো এমনই এক ধরন যা স্থায়ী কাজ বা স্থায়ী কর্মীর এযাবৎ বর্গটাকেই বাতিল করে দিল। নিয়োগকর্তা কোনো দালাল বা কন্ট্রাক্টর ছাড়াই সরাসরি যে কোনো শ্রমিকের সাথে পারস্পরিক চুক্তির ভিত্তিতে নির্দিষ্ট এক সময়সীমার জন্য তাঁকে নিয়োগ করতে পারবেন আর সেই সময় উত্তীর্ণ হলে তাকে বিদায় জানানোর পুরো আইনি অধিকার থাকবে। তারজন্য নিয়োগ কর্তাকে দিতে হবে না এক কানা কড়িও ক্ষতিপূরণ, যা আগের আইনে ছিল। দুটো অত্যন্ত অসম পক্ষের মধ্যে এই চুক্তির ক্ষেত্রে নিয়োগকর্তাই যে থাকবে প্রাধান্যমূলক অবস্থানে, তা বলাই বাহুল্য। এই অসুরক্ষিত অবস্থায় যে কোনো পারস্পরিক বোঝাপড়া অনেক ধরনের অন্যায্য শ্রম শর্তের ভিত্তি তৈরি করে রাখে। যেমন, নিয়োগকর্তা শ্রমিককে বেশিক্ষণ কাজ করিয়ে নিতে বাধ্য করতে পারে, তার মজুরি, ছুটি নিয়ে অন্যায় বা অন্যায্য আচরণ করতে পারে। তাঁকে দিয়ে স্থায়ী কর্মীর কাজ করানোর সবুজ সংকেত এবার আইনি বৈধতা পেল।

ভিত্তিতে মোদী সরকার শ্রম আইনগুলোকে চারটে শ্রম কোডে মিশিয়ে দেয়, সেই শ্রম কমিশনই ২০০২ সালে জানিয়েছিল যে, কোনো স্থায়ী কাজের জন্য একজন শ্রমিককে দু’বছরের বেশি অস্থায়ী বা ক্যাজুয়াল হিসাবে নিয়োগ করে রাখা যাবে না।

এই আইআর বিলটি যখন স্ট্যান্ডিং কমিটির কাছে ২০১৯ সালে যায় তখন ওই কমিটি স্পষ্ট করে জানায় যে কোন কোন শর্তে, কোন কোন কাজের ধরনে, ন্যূনতম ও সর্বাধিক কত সময়সীমার জন্য এই ফিক্সড টার্ম কর্মীদের নিয়োগ করা হবে, তা যেন স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা থাকে। কিন্তু দেখা গেল, আইআর কোড এই সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে পুরোপুরি এড়িয়ে গেল।

প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, আইএলও তার এক রিপোর্টে (২০১৬) জানিয়েছে বিভিন্ন দেশ কিভাবে এই ফিক্সড টার্ম ধরনকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেছে। ভিয়েতনাম, ব্রাজিল এবং চীন পরপর দু’বারের বেশি এই ফিক্সড টার্ম কন্ট্রাক্টকে নবীকরণ করতে দিচ্ছে না। ফিলিপাইন্স, বৎসোয়ানা ফিক্সড টার্ম কাজকে ছাড়পত্র দিচ্ছে মাত্র এক বছরের জন্য। আর, গোটা কর্মী সংখ্যার মাত্র ২০ শতাংশের অধিক ফিক্সড টার্ম ও এজেন্সি শ্রমিকদের নিয়োগ করার ছাড়পত্র দেয়নি ইতালি।

সামাজিক সুরক্ষা কোড

কোড অন সোশ্যাল সিকিউরিটি বা সামাজিক সুরক্ষা কোড লোকসভায় পেশ হয় ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০-তে। মোট ৯টি কেন্দ্রীয় আইনের অবলুপ্তি ঘটিয়ে তৈরি হলো এই কোড। সমস্ত অসংগঠিত শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার যে দাবি এই কোডে করা হয়েছে তা পুরোপুরি এক ভাওতা। যে জাতীয় শ্রম কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে তৈরি হলো এই কোড, সেই কমিশনই খুব জোরালোভাবে সর্বজনীন, সর্বাঙ্গীণ সামাজিক সুরক্ষার বন্দোবস্ত করার সুপারিশ করে। সেখানে এটাও বলা হয়, কোনো ধরনের শ্রমিককেই সামাজিক সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। জাতীয় শ্রম কমিশনের সুপারিশ ছিল, (১) সমস্ত ধরনের সংস্থার ক্ষেত্রে সামাজিক সুরক্ষার সুযোগ সম্প্রসারিত করতে হবে, (২) এই সুযোগ পেতে গেলে মজুরির যে ঊর্দ্ধসীমা বর্তমানে রয়েছে, তা বাতিল করা, (৩) সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের যে সমস্ত বন্দোবস্ত রয়েছে সেগুলোকে একটার অধীনে নিয়ে আসা। এ ছাড়াও, সমস্ত ধরনের সুযোগ সুবিধা পাওয়ার জন্য কর্মী ও নিয়োগকর্তার কাছ থেকে একটাই কন্ট্রিবিউশান নেওয়া হোক আর সেটার ঊর্দ্ধসীমাও বেঁধে দেওয়া হোক। কিন্তু এই সমস্ত সুপারিশের একটাও স্থান হলো না নতুন শ্রম কোডে।

এবার সংস্থার আয়তন অনুযায়ী অর্থাৎ কর্মী সংখ্যা অনুযায়ী কিছু সুযোগ সুবিধাকে নতুন কোড বাধ্যতামূলক করেছে। যেমন, পেনশন বা চিকিৎসা সুবিধা সেই সংস্থাগুলোতে বাধ্যতামূলক যেখানে কর্মীর সংখ্যা ১০ অথবা ২০। কিন্তু, বাদবাকি সমস্ত অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকেরা, যেমন যে সংস্থায় কর্মীর সংখ্যা ১০-এর কম, বা স্বনিযুক্ত, তারা বাদ চলে গেলেন। তারা একমাত্র সংশ্লিষ্ট সরকারের কোনো একটি সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের অধীনে আসতে পারেন, যদি সরকার তেমন কোনো প্রকল্প ঘোষণা করে। এইভাবে, বিশাল সংখ্যক এই সমস্ত শ্রমিকদের নির্ভর করে থাকতে হবে সরকারী ঘোষণার বা তার দয়ার উপর। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা দরকার যে, কেন্দ্রীয় সরকারের পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভে রিপোর্টে (২০১৮-১৯) বলা হয়েছে অকৃষি ক্ষেত্রে ৭০ শতাংশ নিয়মিত মজুরি প্রাপক বা বেতনভুক কর্মীদের কোনো ধরনের লিখিত কন্ট্রাক্ট নেই, আর, ৫২ শতাংশ কর্মীর নেই কোনো ধরনের সামাজিক সুরক্ষা। সংসদের স্ট্যান্ডিং কমিটি অন লেবার (২০২০)-র সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব ছিল সর্বজনীন সামাজিক সুরক্ষা অর্জনের লক্ষ্যে এই কোড যেন একটা নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেয়। আরও বেশি বেশি সংস্থাওগুলোকে এর আওতায় নিয়ে আসা এবং সুযোগ সুবিধাগুলোকে নির্দিষ্ট করা, সংস্থাগুলোর কর্মী সংস্থা বেঁধে না দেওয়া এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, গোটা কৃষিক্ষেত্রকে এর আওতায় নিয়ে আসার সুপারিশ ছিল। ‘কর্মী’র পরিভাষাকে সম্প্রসারিত করে আশা, অঙ্গনওয়াড়ী, অসংগঠিত শ্রমিক ও তার আওতায় কৃষি শ্রমিকদেরও যুক্ত করার প্রস্তাব ছিল, আন্তঃরাজ্য পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য আলাদা এক তহবিল গঠন, অসংগঠিত শ্রমিকদের হাতে যখন কাজ থাকবে না তখন তাঁদের স্বার্থে এক বিমার ব্যবস্থা করা এবং কয়েকটি ক্ষেত্র, যেমন, লৌহ আকরিক খনি, বিড়ি শ্রমিকদের জন্য শ্রমিক কল্যাণ তহবিল ফের চালু করার প্রস্তাব ছিল। কিন্তু সেই সমস্ত সুপারিশগুলো আজ পর্যন্ত কার্যকর করা গেল না।

১০-এর অধিক নির্মাণ শ্রমিক যে সংস্থার সাথে যুক্ত, তাঁরা সামাজিক সুরক্ষার অধীনে আসবেন, কিন্তু বাড়ি বাড়ি নির্মাণ কাজের সাথে যুক্ত বিপুল সংখ্যক শ্রমিকেরা নির্মাণ বোর্ডের সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন। ৫০ লক্ষ টাকার উপর খরচ হয়নি এমন নির্মাণ কাজের সাথে যুক্ত শ্রমিকেরা এই বোর্ডের সুযোগ পাবেন না। প্রসঙ্গত আরও উল্লেখ্য, আইএলও শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষার দিকটিকে নিছক কোনো আর্থিক সাহায্য হিসাবে না দেখে, তাদের আন্তর্জাতিক সনদে এটাকে মানবাধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

ফিক্সড টার্ম কর্মীদের গ্রাচুইটি

২০২০-র কোড অনুযায়ী, যে সমস্ত কর্মীরা লাগাতার ৫ বছর কাজ করেছেন, তাঁরা গ্রাচুইটি পাবেন। কিন্তু, ফিক্সড টার্ম কর্মীর কাজের চুক্তি যদি আগেই শেষ হয়ে যায়, তবে ওই সময় সীমা এক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। নতুন কোড জানাচ্ছে, ফিক্সড টার্ম কর্মীর ক্ষেত্রে গ্রাচুইটি তাঁর নিয়োগকর্তা দেবেন প্রো-রাটা ভিত্তিতে, অর্থাৎ, গোটা ফিক্সড টার্ম পর্যায়ে প্রাপ্য মজুরির অনুপাতে। কিন্তু, আইআর কোড জানিয়েছে যে সমস্ত ফিক্সড টার্ম কর্মীরা এক বছর পূর্ণ করেছে তারাই গ্রাচুইটির আওতায় আসবেন। সামাজিক সুরক্ষা কোড ও আইআর কোডে ফিক্সড টার্ম কর্মীর গ্রাচুইটির ক্ষেত্রে দুধরনের কথা বলা আছে। এ কথা স্পষ্ট নয় যে, এক বছরের কম হলে ফিক্সড টার্ম কর্মী সামাজিক সুরক্ষা কোডের শর্ত অনুযায়ী গ্রাচুইটি পাবেন কি পাবেন না।

মহিলাদের ক্ষেত্রে কি বলেছে এই শ্রম কোড

মহিলাদের আরও কাজের সুযোগ দেওয়ার বাহানায় সমস্ত ধরনের কাজেই মহিলাদের যুক্ত করার অবাধ অধিকার দিয়ে দেওয়া হলো সকাল ৭.০০-র আগে ও রাত ৭.০০-র পরেও। এতোদিন, রাতের শিফটে মহিলাদের নিয়োগ করা যেতো না। যেখানে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থাকবে, সেখানে সরকার নিয়োগকর্তাকে মহিলাদের ‘যথাযথ সুরক্ষা ব্যবস্থা’ বজায় রাখার জন্য আবেদন জানাবে। কিন্তু, সেই সমস্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা (বিধি নয়) লঙ্ঘন করলে কি ধরনের শাস্তি মূলক পদক্ষেপ সরকার নেবে তার কোন উল্লেখ কোডে নেই। ফলে, সমস্ত ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে মহিলাদের নিয়োগ করার ক্ষেত্রে এখন আর কোনো বাধা রইল না।

মাতৃত্বকালীন ছুটির ক্ষেত্রে আগেও নানান কন্টকিত শর্তেসেটাকে অকেজো করে দিয়েছিল মালিকপক্ষ। এবরও এমন সব শর্ত বহাল থাকলো যে সন্তান সম্ভবা মহিলাদের কর্মচ্যুতির সংখ্যা অনেক বেড়ে যাবে।

এদিকে, শ্রম কোড ১৮ বছরের কম বয়সীদের খনিতে নিয়োজিত করা নিষিদ্ধ করেছে। আবার, ১৬ বছরের ঊর্দ্ধে যাদের বয়স, তাদের অ্যাপ্রেন্টিস হিসাবে নিয়োগ করার ছাড়পত্র দিয়েছে।

সর্বজনীন সামাজিক সুরক্ষার লক্ষ্যে এর আগে জাতীয় শ্রম কমিশনগুলো বিভিন্ন সময়ে নানা সুপারিশ ও প্রস্তাব সরকারের কাছে দেয়। যেমন, ৪৪-৪৫তম জাতীয় শ্রম কমিশন নির্দিষ্টভাবে স্কীম কর্মীদের ‘কর্মচারি’ হিসাবে সরকারী স্বীকৃতি, তাঁদের জন্য ন্যূনতম মজুরি এবং ইএসআই, পিএফ’র মতো সামাজিক সুরক্ষা চালু করার প্রস্তাব দিয়েছিল। দ্বিতীয় জাতীয় শ্রম কমিশন ২০০২ সালে ক্ষুদ্র সংস্থার (যখানে ২০-র কম শ্রমিক কর্মরত) জন্য পৃথক এক আইন রচনার কথা বলে। সেখানে তাদের প্রস্তাব ছিল, ক্ষুদ্র সংস্থাগুলোকে পুরোপুরি আইনের আওতা থেকে মুকুব না করে বরং মজুরি প্রদান–কল্যাণমূলক কাজ–সামাজিক সুরক্ষা প্রবর্তন, ছাঁটাই ও ক্লোজারের ক্ষেত্রে কিছু নমনীয় শর্ত আরোপ করা হোক। অর্জুন সেনগুপ্তের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল কমিশন ফর এন্টারপ্রাইজেস ইন দ্য আন অরগানাইসড সেক্টর (এনসিইইউএস) কৃষি ও কৃষি বহির্ভূত শ্রমজীবী মানুষদের জন্য বেশ কয়েকটি সুপারিশ করে সামাজিক সুরক্ষা এবং কাজের ন্যূনতম শর্তাবলি নির্ধারণ করার লক্ষ্যে। প্রস্তাব ছিল উল্লিখিত দুটি ক্ষেত্রের জন্য আলাদা আলাদা বিল আনা হোক।

এটা জেনে রাখা ভালো যে, বেশিরভাগ দেশই ছোট, ক্ষুদ্র ক্ষেত্রগুলোকে পুরোপুরি আইনের বাইরে রাখে না। আইএলও তার রিপোর্টে জানিয়েছে যে তার মাত্র দশ শতাংশ সদস্য দেশ ক্ষুদ্র ও ছোট শিল্পগুলোকে সমস্ত আইনের বাইরে রেখেছে। বেশিরভাগ দেশ এপ্রশ্নে একটা মিশ্র বা মাঝামাঝি পন্থা অনুসরণ করে চলেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত রাষ্ট্র (ইউকে), দক্ষিণ আফ্রিকা ও ফিলিপাইন্স সর্বজনীন সামাজিক সুরক্ষার নীতি অনুসরণ করে চলে, যদিও প্রথম দু’টি দেশে গৃহ পরিচারিকারা এর আওতায় নেই।

একদিকে, আমজনতার উপর দমন তীব্র থেকে তীব্রতর করা, সমস্ত আইনি সুরক্ষা – সুযোগ সুবিধা কেড়ে নেওয়া, গোটা দেশকে কারাগার বানানো আর বিপরীতে মুষ্ঠিমেয় কর্পোরেটদের স্বার্থেদেশ ও রাষ্ট্রকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া – এই হলো মোদী সরকারের ফ্যাসিস্ট রাজের অন্যতম আরেকটা দিক। এর বিরুদ্ধে ক্রমেই সোচ্চার হয়ে উঠেছে নানা স্তরের মানুষ – কৃষক, শ্রমিক ছাত্র যুব সম্প্রদায়। সামনের দিন বিরাট বিরাট আন্দোলনের ক্ষেত্রগুলো তৈরি হয়ে উঠছে।

- অতনু চক্রবর্তী 

খণ্ড-28
সংখ্যা-12