বিজেপির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বাংলার ঐতিহাসিক গণ রায়
historic mass verdict against BJP's aggression

সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের বার্তা

পশ্চিমবাংলায় নির্বাচনে বিজেপির রায় খুব স্পস্ট। এই নির্বাচনে বিজেপি বাংলায় ক্ষমতা দখল করতে চেয়েছিল কিন্তু বাংলার মানুষ বিজেপিকে আটকে দিয়েছে। এই রায় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের পক্ষে। এই নির্বাচনের রায় বিভাজন ও বিদ্বেষের বিরুদ্ধে, জনগণের ঐক্য ও শান্তি সম্প্রীতির পক্ষে।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা দেখলাম যে নির্বাচনের পরে লাগাতার একের পর এক খবর আসতে শুরু করে যে বিভিন্ন জায়গায় মানুষের ওপর হিংসা ও আক্রমণ হচ্ছে, দশ জন মানুষের প্রাণ চলে গেছে। এই যে নির্বাচন পরবর্তী এধরনের হিংসা প্রতিহিংসার ঘটনা তা নির্বাচনে মানুষের যে রায়, সেই রায়ের যে স্পিরিট তার সম্পূর্ণ পরিপন্থী, সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে। কোনো মানুষকেই — সে তিনি বিজেপিকে ভোট দিয়ে থাকুন, সিপিএমকে ভোট দিয়ে থাকুন, কংগ্রেসকে ভোট দিয়ে থাকুন বা তৃণমূলকে ভোট দিয়ে থাকুন — কোনও ভোটারকে তার নিজের পছন্দ অনুযায়ী ভোট দেওয়ার ফলে যদি তার ওপর এটাক হয়, তাদের হত্যা করা হয়, তাদের ওপর দাঙ্গা করা হয়, তাহলে তার থেকে বেশি খারাপ আর কিছু গণতন্ত্রে হতে পারে না। এই যে ব্যাপারটা চলছে পশ্চিম বাংলায়, আমরা মনে করি যে —আজকে মমতা ব্যানার্জী শপথ নিলেন — অবশ্যই এই সরকারকে অত্যন্ত কঠোরভাবে এই হিংসা আটকাতে হবে। এই ধরনের কোনও একটা ঘটনাও যেন আর না ঘটে এবং যে ঘটনাগুলো এখন পর্যন্ত ঘটে গেছে সেই সমস্ত ঘটনায় যারা দোষী তারা যেন শাস্তি পায়, যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাঁরা যেন ন্যায় পান, যাদের ঘর ভাঙ্গা হয়েছে, যাদের বিভিন্নভাবে অনেক ক্ষতি হয়েছে তাঁদের সকলকে যেন পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। এটা হচ্ছে আমাদের প্রথম কথা।

দ্বিতীয় যে প্রশ্নটা তা হল বিজেপি এই ঘটনাগুলোকে নিয়ে রাজ্যে একটা বিরাট ছক কষছে যে কি করে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ করা যায়। বিভিন্ন রকম মিথ্যা খবর, ভূয়ো খবর, ফেক টুইট, ফেক ফেসবুক পোস্ট, হোয়াটস্যাপ পোস্ট, ফটো ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এবং তার মধ্যে বেশ কিছু, ইতিমধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে, এগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যে, সেগুলো ভূয়ো, প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু তা সত্বেও বিজেপি এই চেষ্টাটা চালিয়ে যাচ্ছে। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে তারা চায়, যে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণটা তারা বিধানসভা নির্বাচনে করতে চেয়েছিল এবং মেরুকরণ করে ক্ষমতায় আসতে চেয়েছিল সেটা অসমাপ্ত থেকে গেছে, সেটা সফল হতে পারেনি, সেই কাজটা তারা এখন করতে চায়। বিরোধী দলের জায়গা হিসেবে বিধানসভায় থেকে তারা এবারে এই কাজগুলো করতে চায়। সেজন্য এটার বিরুদ্ধে আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে। বাংলা রুখে দাঁড়িয়েছিল নির্বাচনে। আমরা সবাই সজাগ ছিলাম। এই যে ৪৮% ভোট তৃণমূল কংগ্রেস পেল এটা তৃণমূল কংগ্রেসের একার ভোট নয়। তৃণমূল কংগ্রেসের একার যে ভোট আছে তার সাথে সাথে যুক্ত হয়েছে পশ্চিমবাংলার ব্যাপক শান্তিপ্রিয় মানুষ গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষ, যারা পশ্চিমবাংলায় বিজেপিকে চান না, বিজেপির সরকার হোক বিপর্যয় নেমে আসুক এটা চান না তাঁরা তৃণমূল কংগ্রেসকে ভোট দিয়েছে। এই যে পশ্চিমবাংলার ব্যাপক বামপন্থী উদারবাদী মানুষ, তাদের এই নির্বাচনের সময়ে যে ভূমিকাটা ছিল সেই ভূমিকাটা আমাদের জারি রাখতে হবে। আরও বেশি করে জারি রাখতে হবে কারণ বিধানসভার ভেতরে এবার এমন একটা অবস্থা তৈরি হয়েছে যেখানে বিরোধী দল বলতে শুধু বিজেপি। সেখানে কোনও বামপন্থী বিধায়ক নেই, সেখানে এমনকি কংগ্রেসেরও কোনও বিধায়ক নেই। বিধানসভার ভেতরে এই যে এক ভারসাম্যহীন অবস্থা তৈরি হল, এই ভারসাম্যহীনতার বিপরীতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে অনেক বেশি করে আমাদের সজাগ থাকতে হবে, সক্রিয় থাকতে হবে, সতর্ক থাকতে হবে, একজোট থাকতে হবে।

Bengal's historic mass verdict

পশ্চিমবাংলায় কোভিড পরিস্থিতি অত্যন্ত বিপজ্জনক। গোটা দেশেই বিপজ্জনক, এবং বাংলায় বিশেষ করে এই যে এত লম্বা নির্বাচন চলল — আট দফা নির্বাচন চলল — এই নির্বাচন যদি চার দফা পাঁচ দফায়ও শেষ হয়ে যেত, এপ্রিলের মাঝামাঝি যদি শেষ হয়ে যেত তাহলে আজকে পরিস্থিতি কিন্তু এত খারাপ হত না। কিন্তু সেটা তো হয়নি, ইলেকশন কমিশন এর জন্য দায়ী। কিন্তু যাই হোক, এখন আমাদের যে পরিস্থিতির মোকাবিলা করা হচ্ছে সেখানে বিরাট সংখ্যায় কোভিডের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা টেরও পাচ্ছি না কারণ টেস্ট হচ্ছে না। সরকারী হাসপাতালে সপ্তাহে মাত্র একদিন টেস্ট হচ্ছে, সাধারণ মানুষ টেস্ট করানোর সুযোগ পাচ্ছে না। এছাড়া যে চিকিৎসার দরকার, বেড দরকার, অক্সিজেন দরকার, ভ্যাক্সিন দরকার – এগুলো অপ্রতুল। সারা দেশেই অপ্রতুল, পশ্চিমবাংলাতেও কম। ফলে এই মুহূর্তে আমাদের কাছে একটা বড় প্রশ্ন হচ্ছে যে বাংলার বুকে এই কোভিডের যে আক্রমণ এই আক্রমণটাকে রুখে দিতে হবে এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। ফলে, আর হিংসা নয়। নির্বাচন পরবর্তী এই ধরনের হিংসা প্রতিহিংসার ঘটনা নয়, গণতন্ত্রের ওপর কোনও আক্রমণ নয়, কোনোরকম কোনও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ বিভাজন নয়। আমরা সবাই মিলে একসাথে কোভিডের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই। এটাই এখন হওয়া উচিত আমাদের স্পিরিট। আজকে কলকাতায় লেনিনমূর্তির পাদদেশে একটা সংক্ষিপ্ত নাগরিক প্রতিবাদ হল যেখানে আমরা এই দাবিগুলোই তুলেছিলাম যে, সরকার চলুক। জনগণ রায় দিয়েছে সরকার গঠিত হয়েছে। সরকার চলুক, সন্ত্রাস নয়। শান্তি চাই, দাঙ্গা নয়। এবং লড়াইটা চলুক কোভিডের বিরুদ্ধে, এই মহামারীর বিরুদ্ধে।

পশ্চিমবাংলার নির্বাচনের যে রায় তা গোটা ভারতবর্ষের মানুষকে আশা জাগিয়েছে অনুপ্রাণিত করেছে। যে কৃষকরা আন্দোলন করছেন, যে শ্রমিকরা আন্দোলন করছেন পাব্লিক সেক্টর বাঁচানোর জন্য, প্রাইভেটাইজেশনের বিরুদ্ধে, যুবকেরা যারা আন্দোলন করছেন চাকরির দাবিতে, গোটা দেশে সংবিধান বাঁচানোর জন্য যারা লড়ছেন, নাগরিকত্বের অধিকারের জন্য যারা লড়ছেন, মহিলাদের অধিকারের জন্য যারা লড়ছেন, সবাই অনুপ্রাণিত হয়েছেন বাংলার এই নির্বাচনের ফলাফল দেখে, এটা দেখে যে, এই যে প্রচার করা হয় যে বিজেপিকে আর ঠেকানো যাবে না – এটা নয়, এটা মিথ্যা প্রচার, বিজেপিকে রীতিমতো ঠেকিয়ে দেওয়া সম্ভব, যেভাবে বাংলা ঠেকিয়ে দিয়েছে, আগামি দিনে এইভাবে উত্তরপ্রদেশও ঠেকিয়ে দিতে পারে, এবং ২০২৪-এ এইভাবেই গোটা দেশ ঠেকিয়ে দিতে পারে। ২০২৪ তো এখনও দেরী আছে। এই মুহুর্তেগোটা দেশে দাবি উঠছে যে মোদী সরকার হয় কোভিডের ব্যাপারে কাজ করুক, আর না হলে, যদি সরকার না চালাতে পারে, তাহলে মোদী পদত্যাগ করুক, পদত্যাগ করে ভারতবর্ষে অন্তত একটা সরকার থাকুক যে সরকার এই কোভিড পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারবে। এই মুহূর্তে মনে হয় একটা বড় আন্দোলনের পরিবেশ গড়ে উঠছে গোটা দেশ জুড়ে, এবং এই আন্দোলনে পশ্চিমবাংলার জনতার এই রায় থেকে প্রেরণা নিয়ে শক্তি নিয়ে আমরা সবাই মিলে এগিয়ে যাব। এবং বাংলার ভেতরে বামপন্থীদের যে বিধানসভার মধ্যে একটা দুর্বলতার জায়গা তৈরি হল সেই দুর্বলতাকে কাটিয়ে উঠে বামপন্থি শক্তি নতুন করে আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে, নতুন উদ্যমে আমরা রাস্তায় থেকে এই শক্তি অর্জন করব। এটা আজ আমাদের সকলের কাছেই চ্যালেঞ্জ। আমরা সিপিআই(এমএল)-এর পক্ষ থেকে সিপিআই(এমএল)-এর সমস্ত কর্মী ও সমর্থকদের কাছে এবং গোটা পশ্চিমবাংলার সমস্ত বাম কর্মীবাহিনী এবং যারা সচেতন সক্রিয় নাগরিক, শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ সকলের কাছে এই আবেদন রাখি যে আমরা সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে পশ্চিমবাংলায় পরিস্থিতি সামাল দিই, পরিস্থতির মোকাবিলা করি এবং বাংলার বুকে বিজেপি যে চক্রান্ত করছে সেই চক্রান্তকে রুখে দিই। এবং তৃণমূল কংগ্রেস যদি এটা মনে করে যে তারা এবার বিরাট একটা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে অতএব সংখ্যাগরিষ্ঠতা মানেই হচ্ছে পশ্চিমিবাংলার বুকে এক ধরনের স্বৈরাচার চালানোর লাইসেন্স, তাহলে এটা খুব ভুল হবে। এই তৃতীয় দফার যে তৃণমূলের সরকার ক্ষমতায় এসছে, গণতন্ত্র যেন আক্রান্ত না হয় মানুষের অধিকার যেন বিঘ্নিত না হয়। শান্তি যেন আক্রান্ত ও বিঘ্নিত না হয়, এবং পশ্চিমবাংলার মানুষের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ঐক্যর ওপর যেন কোনও আঘাত নেমে না আসে এটা আমাদের দেখার দায়িত্ব সকলের, দেখার দায়িত্ব সরকারের, দেখার দায়িত্ব মানুষের। আমরা সবাই মিলে এই কাজটা পালন করব। আমরা চাই বাংলার বুকে গণতান্ত্রিক শক্তি, বামপন্থী শক্তি সংহত থাকুক, আরও শক্তিশালী হোক।

(পার্টি রাজ্য ফেসবুক পেজের লাইভ বার্তা থেকে অনুলিখিত)

খণ্ড-28
সংখ্যা-16