করোনা নিরাময় নিয়ে হিন্দুত্ববাদী বুজরুকি
Hindutva bujruki about corona cure - 0

“অ্যালোপ্যাথি একটা নির্বোধ বিজ্ঞান।... অ্যালোপ্যাথি ওষুধ খেয়ে লক্ষ-লক্ষ মানুষ মারা গেছে।... হাসপাতালে শয্যার অভাবে বা অক্সিজেন না পেয়ে যত লোক মারা গেছে, তার চেয়ে বেশি লোক মারা গেছে অ্যালোপ্যাথি ওষুধ খেয়ে।” কথাগুলো স্বাস্থ্য সম্পর্কে হাতুড়ে পরামর্শদাতা বাবা রামদেবের। সামাজিক মাধ্যমে ঘুরতে থাকা একটা ভিডিওতে অ্যালোপ্যাথির বিরুদ্ধে এই বিষোদ্গার রামদেব করছেন বলে দেখা গেছে। এই মন্তব্য নিয়ে সমালোচনা উঠলে ও বিতর্ক তৈরি হলে রামদেব বলেন, এটা তাঁর নিজের মন্তব্য নয়। তাঁর মোবাইলে হোয়াটসঅ্যাপে ফরোয়ার্ড হয়ে আসা একটা ভিডিও বার্তাকেই তিনি পড়ছিলেন। কিন্তু যাঁরা স্বাস্থ্যক্ষেত্রে আধুনিককালের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় নিজেদের নিংড়ে দিচ্ছেন, সংক্রমিত হয়ে মারা যাওয়ার ঝুঁকি সত্বেও করোনা রোগীদের সেবা থেকে সরে আসছেন না, অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত সেই ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের কাছে এরচেয়ে অসম্মানজনক ও গ্লানিকর আর কি হতে পারে? তাঁরা নিজেদের প্রতিক্রিয়া জানাতে লাগলেন, রামদেবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন করলেন সরকারের কাছে। রামদেবের কাছে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার নোটিস পাঠালো আইএমএ। আইএমএ’র সেক্রেটারি জেনারেল জয়েস লেলে বললেন, “সরকারের নীরবতায় আমরা মর্মাহত”। প্রসঙ্গত, রামদেব সরকার ঘনিষ্ঠ যোগগুরু বলেই সমধিক পরিচিত। তাঁর এই মন্তব্যে শুধু দেশে নয়, বিদেশেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির সম্ভাবনার আঁচ করে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষবর্ধন রামদেদেবকে চিঠি লিখে বললেন, “আপনার মন্তব্যের মাধ্যমে আপনি শুধু করোনা যোদ্ধাদেরই অসম্মান করেননি, দেশের জনগণের ভাবাবেগেও আঘাত দিয়েছেন। অ্যালোপ্যাথি সম্পর্কে আপনার মন্তব্য স্বাস্থ্য পরিষেবাক্ষেত্রের কর্মীদের মনোবল ভেঙ্গে দিতে এবং কোভিড১৯’র বিরুদ্ধে আমাদের লড়াইকে দুর্বল করে তুলতে পারে।” চিঠির শেষে তাঁর আবেদন, “আমি আশা করব, আপনি বিষয়টায় গুরুত্ব দিয়ে ভাববেন এবং সারা বিশ্বের করোনা যোদ্ধাদের ভাবাবেগের কথা বিবেচনা করে আপনার মন্তব্য প্রত্যাহার করে নেবেন”। এরপর রামদেবের টুইট গেল হর্ষবর্ধনের কাছে, “আপনার চিঠি পেয়েছি। সেই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ও বিভিন্ন চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে তা শেষ করতে আমি আমার মন্তব্য প্রত্যাহার করছি”। মন্তব্য প্রত্যাহারের এই টুইট বার্তা দেখিয়ে দিল যে, মন্তব্যটি তাঁর নয় এবং ফরোয়ার্ড হয়ে আসা একটি ভিডিও বার্তাই তিনি পড়ছিলেন বলে যে দাবি রামদেব করেছিলেন, তা ছিল সর্বৈব মিথ্যা।

খুব স্বাভাবিক ভাবেই যে প্রশ্নটা ওঠে তা হল, এই মন্তব্য করার ধৃষ্টতা রামদেব পেলেন কোথা থেকে? এটা কি নিছকই মত প্রকাশের গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রয়োগ? না কি এর পিছনে গূঢ় কোনো অভিপ্রায় রয়েছে? এর আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, শাসক দলের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে রামদেবের যথেষ্ঠ ওঠাবসা এবং হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি ও ভাবধারাকে পুষ্ট করতেও রামদেবের অবদান কম নয়। কাজেই, শাসক দল ও সরকারের প্রশ্রয়ই যে অ্যালোপ্যাথির মতো চিকিৎসা বিজ্ঞান বিষয়ে অযৌক্তিক, ভিত্তিহীন ও সংস্কারগ্ৰস্ত মন্তব্যে রামদেবকে স্পর্ধিত করেছে তা নিয়ে প্রশ্নের বোধহয় খুব একটা অবকাশ থাকতে পারে না। এছাড়া, অ্যলোপ্যাথ বিরোধী মন্তব্যের মধ্যে নিজের কোম্পানির তৈরি ওষুধের বিক্রি বাড়িয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্য রয়েছে বলেও অনেকে অভিমত প্রকাশ করেছেন। উল্লেখ্য, রামদেবের সংস্থা পতঞ্জলি গাছগাছড়ার মিশেলে করোনিল নামে একটা ওষুধ বার করে করোনা চিকিৎসার অব্যর্থ ওষুধ বলে দাবি করে। এই ওষুধের কার্যকারিতা প্রমাণসিদ্ধ নয় এবং স্বীকৃত কোনো সংস্থার অনুমোদীতও নয়। অ্যালোপ্যাথির বিরুদ্ধে বিরূপ হয়ে, জনগণ মরিয়া হয়ে করোনিলের ওপর ভরসা করলে পতঞ্জলির প্রভূত লাভ। পতঞ্জলি রামদেবের তৈরি, ফলত হিন্দুত্বের সংযোগ সম্পন্ন একটা কর্পোরেট সংস্থা। করোনা সঙ্কটের মধ্যে একটা মওকা খুঁজে পেয়ে আর্থিক লাভে তাকে কাজে লাগাতে পতঞ্জলি তথা রামদেব ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। পুরোপুরি কাজে লাগিয়েছেন সরকারের মদতকে। করোনিল ট্যাবলেটকে বাজারে আনার সময় কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী স্বয়ং হর্ষবর্ধন রামদেবের পাশে দাঁড়িয়ে করোনিলের নির্ভরযোগ্যতার বিজ্ঞাপন হয়ে ওঠেন। এবছরেরই ১৯ ফেব্রুয়ারি দুই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হর্ষবর্ধন ও নীতীন গডকড়িকে দুপাশে নিয়ে রামদেব ঘোষণা করেন, আয়ুষ মন্ত্রক কোভিড-১৯ চিকিৎসায় করোনিল ব্যবহারে অনুমতি দিয়েছে। সরকারের এই সক্রিয় মদত পেয়ে করোনিলের বিক্রি কয়েকশো কোটি টাকা ছাড়িয়েছে বলে সংবাদ মাধ্যমের খবর। তবে, কোভিড১৯ চিকিৎসায় ফলদায়ীরূপে সুস্পষ্ট প্রমাণ না থাকা শুধু করোনিল ট্যাবলেটকেই নয়, গোময়, গোমূত্র এবং অন্যান্য নানান অকার্যকর ও এমনকি ক্ষতিকারক বস্তুকেও করোনা মোকাবিলার উপায় বলে বিধান দিচ্ছেন বিজেপি নেতা-নেত্রীরা।

করোনা সংক্রমণের মোকাবিলায় বিজেপি নেত্রী প্রজ্ঞা সিং ঠাকুরের বিধান হল - প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণে গোমূত্র পান করতে হবে। গোমূত্র অবশ্য দেশী গরুর হতে হবে। এরফলে করোনা আক্রান্তের ফুসফুস সংক্রমণ মুক্ত হবে। প্রজ্ঞার দাবি, তিনি নিজে প্রতিদিন গোমূত্র সেবন করে থাকেন। এদিকে আবার সংবাদ বেরিয়েছে যে, কোভিড সংক্রমণ নিয়ে প্রজ্ঞাকে দিল্লীর এমস হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল। গুজরাটের বংশকন্ঠ জেলার দিশা তালুকের তেতোড়া গ্ৰামের রাজারাম গৌশালা আশ্রমে রয়েছে কোভিড চিকিৎসার একটা কেন্দ্র, যাতে অ্যালোপ্যাথির সঙ্গে আয়ুর্বেদ পদ্ধতিতেও কোভিড আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা হয়। ঐ কেন্দ্রের ট্রাস্টি রাম রতন দাস জানিয়েছেন, “আমাদের কাছে আয়ুর্বেদ ওষুধ রয়েছে যা কোভিড-১৯ চিকিৎসার মোক্ষম ওষুধ। আয়ুর্বেদকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই আমাদের মূল উদ্দেশ্য। আমরা ভেদলক্ষণো পঞ্চগোভ্য আয়ুর্বেদ চিকিৎসা দিই যা গরুর পাঁচটা উপাদান দিয়ে তৈরি – মূত্র, গোবর, দুধ, ঘি এবং দই।” প্রায় একই ধরনের বিধান দিয়েছেন উত্তরপ্রদেশের মিরাটের বিজেপি নেতা গোপাল শর্মা। প্রচার করা হচ্ছে যে, দেশি ঘি দিয়ে ঘুঁটে পোড়ালে নাকি অক্সিজেন তৈরি হয়। এই প্রশ্নে বোম্বে আইআইটি’র কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং’এর অধ্যাপক অভিজিৎ মজুমদার কি বলছেন শোনা যাক – “প্রথমত, দহন এমন একটা প্রক্রিয়া যা অক্সিজেন শুষে নেয়। আপনি যদি কিছু পোড়ান তবে তাতে অক্সিজেন তৈরি হবে না, বরং তা অক্সিজেন শুষে নেবে। ... আপনি যদি ঘরে ধোঁয়া তৈরি করেন তবে যে রোগীর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে সে সঙ্কটাপন্ন হবে।”

সরকার স্বয়ং যে পরামর্শ দিচ্ছে তা শোনাটাও জরুরি। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার বৃদ্ধি ঘটানো সম্পর্কে আয়ুষ মন্ত্রকের পরামর্শ হল – তিল তেল, নারকেল তেল, বা গরুর দুধ থেকে তৈরি ঘি কয়েক ফোঁটা নাকে ঢালতে হবে – সকাল ও সন্ধ্যায়। কেউ নাকে নিতে না পারলে এক চামচ তিল বা নারকেল তেল মুখে নিয়ে কুলকুচি করে ফেলে দিতে হবে। কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রক একটা বিশেষ উদ্দেশ্যে হৃষিকেশের এআইএমএস’কে কয়েক লক্ষ টাকা আর্থিক সাহায্য দিয়েছে। আর সেই উদ্দেশ্যটা হল, রোগীদের সুস্থ হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে গায়ত্রী মন্ত্র উচ্চারণ এবং প্রাণায়াম কোনো ভূমিকা পালন করে কি না তা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো।

দেহে অক্সিজেনের মাত্রা বাড়ানো সম্পর্কে কর্নাটকের বিজেপি নেতা বিজ শঙ্কেশ্বরের পরামর্শ সম্পর্কে দ্য হিন্দু পত্রিকার সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে – “শ্রী শঙ্কেশ্বর সাম্প্রতিক এক সাংবাদিক বৈঠকে বলেন যে, নাসারন্ধ্র দিয়ে লাইম জুইস নিলে তা অক্সিজেনের মাত্রাকে ৮০ শতাংশ বাড়িয়ে তোলে। তিনি বলেন, ২০০ জনের মধ্যে এই ঘরোয়া চিকিৎসা পদ্ধতিকে ফলপ্রসূ হতে তিনি দেখেছেন, যারমধ্যে তাঁর আত্মীয়স্বজন এবং সহকর্মীরাও রয়েছে।” দ্য হিন্দুর ঐ রিপোর্টে এই কথাও জানানো হয়েছে যে, ঐ পদ্ধতি অনুসরণ করার পর কয়েকজন মারাও গেছেন।

করোনা মোকাবিলার এই সমস্ত অবৈজ্ঞানিক, অপ্রমাণসিদ্ধ বিধান বিজেপি নেতা-নেত্রীরা দিচ্ছেন কেন? তাঁরা নিজেরা, নিজেদের দলের লোকজন ঐ সমস্ত পরামর্শে আস্থা রাখেন? নিজেরা বা তাঁদের বাড়ির লোকজন করোনা আক্রান্ত হলে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা নেওয়ার পরিবর্তে এই সমস্ত ‘দেশীয়’ চিকিৎসা পদ্ধতির ওপর নির্ভর করেছেন বা করতে পারবেন? বিজেপির সর্বোচ্চ স্তরের নেতারাও যে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা নিতেই পছন্দ করেছেন, সে তো সবারই জানা। গোমূত্র, গোবর, ঘুঁটে, ইত্যাদির উপকারিতা নিয়ে প্রচার সংঘ-বিজেপির গো-রাজনীতিরই সম্প্রসারণ। গরুকে কেন্দ্র করে বিদ্বেষ ও বিভেদের যে রাজনীতি হিন্দুত্ববাদীরা চালায়, করোনা কালেও তাকে অব্যাহতভাবে চালিয়ে নিয়ে যাওয়াটা তাদের পরিকল্পনার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। গোমূত্র, গোময়-এর নিরাময় ক্ষমতা নিয়ে প্রচার যতই আষাঢ়ে ও ভিত্তিহীন হোক, বারবার বলে জনমনে তাকে প্রতিষ্ঠিত করা এবং এইভাবে গরুকে পূজ্য তথা মাতা করে তোলার কৌশলকে একনিষ্ঠ ভাবে চালিয়ে নিয়ে যাওয়াটাই বিজেপির অভিপ্রায়। এছাড়া, যুক্তিবাদী হবে না, যা বলা হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন করবে না, নেতা-নেত্রীদের মুখ নিঃসৃত বচনকে অভ্রান্ত বলে মেনে নেবে, এমন জনসাধারণই বিজেপির মতো শাসকদের কাঙ্খিত। জনগণকে যুক্তি নির্ভর হওয়ার চেয়ে বিশ্বাস-নির্ভর করে তুলতে পারলে তারা টোটকা নিরাময়ের ওপর ভরসা করবে, রোগমুক্তিতে সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে না। তবে, কিছু মানুষ বিশ্বাসের অন্ধত্বে ডুবে থাকলেও ব্যাপক সংখ্যাধিক জনগণ কিন্তু অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসাকে ধরেই বাঁচতে চাইছেন। তাঁরা শয্যার অভাব, অক্সিজেনের অনটন, ওষুধের আকাল নিয়ে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন, টিকার অমিল নিয়ে প্রতিবাদে নামছেন। হিন্দুত্ব ব্র্যাণ্ডের হলেও বুজরুকির প্রতারণা ক্ষমতা যে অতি সীমিত তা প্রতিদিনই প্রতিপন্ন হচ্ছে বাস্তবের মাটিতে।

খণ্ড-28
সংখ্যা-19