আবেদন
সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার ডাকে ২৬ মে কালা দিবস
May 26 is called Black Day

২৬ মে কালা দিবস হিসেবে পালন করার আবেদন রেখেছে সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা (এসকেএম)। ভারতীয় গণতন্ত্রে ২৬ মে এক কালা দিন। ২০১৪ সালের ঠিক এই দিনে আর তারপর আবার দ্বিতীয় বারের জন্য ২০১৯-র ৩০ মে তারিখে নরেন্দ্র মোদী শপথ নেন। ২৬ মে হল সেই দিন, যেদিন “ চলো দিল্লি” কিষাণ আন্দোলন তার ছ’মাস পূর্ণ করবে। ওই দিনেই কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন গুলো সারা ভারত ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল গরিব মানুষদের হাতে নগদ টাকা তুলে দেওয়া, সমস্ত দুঃস্থ পরিবারকে নিখরচায় রেশনের দাবিতে, শহরাঞ্চলে মনরেগার প্রকল্পকে সম্প্রসারিত করতে, রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থা ও সরকারি দপ্তরের বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে, এনপিএস বাতিল ও আগেকার পেনশন প্রকল্প বহাল রাখা প্রভৃতি দাবিতে, আর সেটাও ৬ মাস পার হবে।

এই জন্য ওইদিনটা কালা দিবস হিসাবে পালন করার ডাক দেওয়া হয়েছে কারণ, বিগত সাত বছর ধরে যে মোদী সরকার ক্ষমতায় রয়েছে, সেই সরকারটি মসনদে আসার আগে যে লম্বা চওড়া প্রতিশ্রুতি গুলো দিয়েছিল তা পূরণ করতে নিদারুণ ভাবে ব্যর্থই শুধু হয়নি, বরং খেটে খাওয়া মানুষের সমস্ত ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধেই খোলাখুলি কাজ করেছে। সংসদে বর্বর সংখ্যাগরিষ্ঠতার দোহাই দিয়ে কোভিডের মারাত্মক দ্বিতীয় ঢেউয়ের মধ্যেও চূড়ান্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ করে চলেছে।

* মোদী সরকার নিজের কাঁধ থেকে সমস্ত দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলে কোভিড মোকাবিলায় অসহায় মানুষদের যাবতীয় মেডিকাল সংক্রান্ত পদক্ষেপ রাজ্য সরকারগুলোর উপর চাপিয়ে দিয়েছে — টিকা নেই, নেই অক্সিজেন ও হাসপাতালের বেড, এমনকি শেষকৃত্য সম্পন্ন করার জোগানেও হাহাকার দেখা যাচ্ছে সর্বত্র। ১৮-৪৪ বয়সিদের টিকা দেওয়ার দায়হীন ঘোষণা করার অব্যবহিত পরেই তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হল। বোঝাই যাচ্ছে, এই গভীর সংকটকে কিভাবে সামাল দেওয়া হবে সে ব্যাপারে সরকার সম্পূর্ণ অন্ধকারেই রয়েছে। এই মারণ ভাইরাসের সাথে যুদ্ধের ক্ষেত্রে সরকারের অপরাধসম অবহেলা আজ উন্মোচিত।

* এই অতিমারীর সুযোগ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার কর্পোরেট স্বার্থবাহী আইনগুলোকেই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তা তিনটি কৃষি আইন বা চারটি শ্রমকোড হোক না কেন। সরকারী ক্ষেত্র বা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার ঢালাও বেসরকারীকরণ, রেল-বন্দর ও পোর্টের সব সম্পদ বিক্রি, ইতিমধ্যে ৫০০ টি কয়লা ব্লককে নিলামে তোলার জন্য সনাক্ত করা হয়ে গেছে, ৪০টি ব্লক নিলাম হয়ে গেছে, যার মধ্যে ৩৯টি গেছে আদানি, বেদান্তদের খপ্পরে, জলের দরে বেসরকারি সংস্থার কাছে বেচে দেওয়া হয়েছে ছ’টি বিমানবন্দর। প্রতিরক্ষা ও রেলের সমস্ত উৎপাদন ইউনিটগুলো কর্পোরেশনের অধীনে আনা হবে, ব্যাঙ্ক-বিমা ও খুচরো ব্যবসায় অবাধে ঢুকবে এফডিআই, বিপিসিএল-এমটিএনএল, ইস্পাত, খনিজ ও বেশ কিছু রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। নীতি আয়োগ এমন ১০০টি সংস্থাকে চিহ্নিত করেছে যেখান থেকে কিছু  “আয়” করা যায়। মনেটাইজ হল সেই নতুন শব্দবন্ধ, যার আড়ালে বেসরকারীকরণ বা বেচে দেওয়ার কাজটা করা হচ্ছে।

* পরিযায়ী শ্রমিক সহ অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমজীবী মানুষদের জন্য প্রয়োজন বেঁচে-বর্তে থাকার জন্য খাদ্য সামগ্রি, হাতে নগদ টাকা ও কর্মসংস্থান। এই বিরাট চ্যালেঞ্জটা হাতে নিতে গেলে সরকারকে তার এক্তিয়ারে থাকা নানা উৎসগুলোকে কাজে লাগাতে হবে — এফসিআই-এর মজুত খাদ্যশস্য বিতরণ, সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে যে কোভিড যোদ্ধারা লড়ছেন তাঁদের জন্য বিমা, নরেগার খাতে বরাদ্দ বাড়ানো, শহরাঞ্চলের জন্য নরেগা ধরনের কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্প, ইত্যাদি। এই সমস্ত ব্যাপারে সরকার হাত পা গুটিয়ে নিশ্চল হয়ে বসে রয়েছে।

* কেন্দ্রীয় সরকার এমন সমস্ত আইন পাস করালো যা কেউ দাবি করেনি। তা কৃষি আইন হোক বা শ্রম কোড, সিএএ বা নয়া শিক্ষা নীতি, ঢালাও বেসরকারীকরণ ইত্যাদি, কিন্তু যে সমস্ত জনপ্রিয় দাবিগুলো সামনে এসেছে, যেমন, কৃষি পণ্যের জন্য এমএসপি সুনিশ্চিত করা, জিএসটি-র আওতায় পেট্রল ডিজেলকে নিয়ে আসা ইত্যাদি তা মেনে নিতে অস্বীকার করে চলেছে।

* কোভিড অতিমারিকে মোকাবিলা করার জন্য নাকি রাজকোষ ফাঁকা, অথচ, নির্লজ্জ ভাবে কুড়ি হাজার কোটি টাকা খরচ করে সরকার “সেন্ট্রাল ভিস্টা প্রজেক্ট”এর নির্মাণ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে যেখানে থাকবে নতুন সংসদ ভবন। নির্বাচনী বন্ড, পিএম কেয়ার্স-এর মতো অস্বচ্ছ মার্কা তহবিল থেকেই হয়তো বা যার খরচ মেটানো হচ্ছে। এই সরকার চরম অগণতান্ত্রিক পন্থায় চালিয়ে যাচ্ছে তার কর্মধারা — সরকারকে সমালোচনা করার অপরাধে যে কাউকেই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, ত্রিপাক্ষিক আলাপ আলোচনা করতে অস্বীকার, বিরোধীদের দমন করতে সাংবিধানিক সংস্থা গুলো ব্যবহার ইত্যাদি। দেখা গেল, সিবিআই-ইডি-এনআইএ-সুপ্রিম কোর্ট-আরবিআই-রাজ্যগুলোর রাজ্যপালদের কাজে লাগাচ্ছে রাজনৈতিক বিরোধীদের শায়েস্তা করতে, দল ভাঙিয়ে নির্বাচিত রাজ্য সরকারকে হয়রান করতে অর্থবল ও ওই সমস্ত সংস্থাগুলোকে কাজে লাগাতে এই সরকার উঠেপড়ে লেগেছে।

এই তালিকায় আরও অনেক কিছু যুক্ত করা যায়। এখন সময় এসেছে কোদালকে কোদাল বলা। আসুন, আমরা ভারতীয় গণতন্ত্রে ২৬ মে তারিখটাকে কালা দিবস হিসাবে পালন করি। সেদিন কালো ব্যাজ পরে, কালো পতাকা নিয়ে সংঘটিত করি এই কালা দিবস।

ওই দিন শপথ নিই, যতদিন পর্যন্ত আমাদের দাবি আদায় না হয়, ততদিন ক্লান্তিহীনভাবে আমরা চালিয়ে যাব আমাদের লড়াই। একটা বার্তা আমরা সর্বত্র পৌঁছে দেব যে মোদী তাঁর ইচ্ছে মতো যা খুশি তাই করে যাবে, আর শ্রমজীবী মানুষেরা নিষ্ক্রিয় দর্শক হয়ে দূর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চুপচাপ এটা দেখবে, তা হতে দেওয়া যাবে না।

আমাদের দাবি —

১) নিখরচায় সর্বজনীন টিকাকরণ
২) সমস্ত স্তরে সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে মজবুত করতে হবে।
৩) সমস্ত অসংগঠিত, ইনফর্মাল সেক্টরের শ্রমিকদের ও কর্মহীনদের বিনা মূল্যে খাদ্য শস্য ও মাসে নগদ ৭,৫০০ টাকা দিতে হবে।
৪) তিনটি কৃষি আইন বাতিল কর, বিদ্যুত (সংশোধনী) বিল, ২০২১ প্রত্যাহার কর, কৃষি পণ্যের উপর এমএসপি সুনিশ্চিত কর।
৫) ৪ শ্রম কোড ও খসড়া কেন্দ্রীয় নিয়ম বিধি (রুলস্) প্রত্যাহার করে অবিলম্বে ভারতীয় শ্রম সম্মেলন আহ্বান কর।
৬) সরকারী বিভাগ ও রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থাগুলোর বেসরকারীকরণ, কর্পোরেশন বানাবার নীতি থেকে সরে এসো।
৭) যে সমস্ত বিজেপি শাসিত রাজ্য বা তাদের দোসর নিজেদের খেয়ালখুশি মতো ৩৮টি শ্রম আইন মুলতুবি রেখেছে, তা অবিলম্বে প্রত্যাহার কর — যেগুলো আন্তর্জাতিক শ্রম সনদকে লঙ্ঘন করে, যেমন, সংগঠিত হওয়ার অধিকার কনভেনশন ৮৭, যৌথ দরকষাকষির কনভেনশন ৯৮, ত্রিপাক্ষিক বৈঠক ও আলাপ আলোচনা সংক্রান্ত কনভেনশন ১৪৪ প্রভৃতি।

১০ টি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের সমস্ত অন্তর্ভুক্ত ইউনিট, সমমনোভাবাপন্ন সমস্ত স্বাধীন ইউনিয়ন বা ফেডারেশন এখন থেকে কোমর বাঁধুক আগামীতে আরও সরাসরি অনির্দিষ্টকালের অ্যাকশনের জন্য। ইউনিয়নের কর্মী বাহিনী ও সাধারণ জনতাকে কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রমিক বিরোধী, কৃষক বিরোধী জনবিরোধী জাতীয় স্বার্থ বিরোধী নীতিগুলোর মর্মবস্তু সম্পর্কে আলোকিত করতে হবে।

এআইসিসিটিইউ, আইএনটিইউসি, এআইটিইউসি,

এইচএমএস, সিআইটিইউ, এআইইউটিইউসি, টিইউসিসি, সেবা,

এলপিএফ, ইউটিইউসি এবং সমস্ত স্বাধীন সেক্টারভিত্তিক ফেডারেশন/সমিতি।

খণ্ড-28
সংখ্যা-18