হিংসা প্রশমিত কর, দোষীদের শাস্তি দাও দাঙ্গার উস্কানি প্রতিহত করো
Quench the violence

পশ্চিমবাংলার বিধানসভা নির্বাচনের রায় হল বিজেপির মুসলিম বিরোধী প্রচারের সার্বিক প্রত্যাখ্যান। তবে, ফলাফল বেরোনোর পরপরপরই পশ্চিমবাংলায় উদ্বেগজনকভাবে হিংসার ঘটনা ঘটে চলেছে, যাতে সমস্ত দলের সমর্থকরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আরও উদ্বেগের ব্যাপার হল, বিজেপি নেতারা ভুয়ো খবর ছড়িয়ে নির্বাচনী রায় এবং তার সাথে নির্বাচনপরবর্তী হিংসায় সাম্প্রদায়িক রং লাগাতে উঠেপড়ে লেগেছেন।

এখন এটা সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে, পশ্চিমবাংলায় নির্বাচন-পরবর্তী হিংসায় যারা আহত বা নিহত হয়েছেন তারা বিজেপি, তৃণমূল কংগ্রেস এবং সিপিআই(এম)-এর লোকজন। কিছু ক্ষেত্রে সিপিআই(এমএল) কর্মীরা হিংসা থামাতে গেলে তাঁদেরও হিংসার মুখে পড়তে হয়। বিজয়ী তৃণমূল কংগ্রেস একতরফাভাবে তার প্রতিপক্ষদের ওপর হিংসা চালাচ্ছে, ঘটনা এমন না হলেও আর এক দফার জন্য পুনরায় নির্বাচিত হওয়ায় হিংসাকে প্রশমিত করা এবং হিংসার জন্য যারা দোষী তাদের গ্রেপ্তার করা ও তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করার দায় সুনিশ্চিতভাবে তাদেরই।

পরিস্থিতিকে শান্ত করতে চাওয়ার পরিবর্তে বিজেপির গুরুত্বপূর্ণ নেতারা সাম্প্রদায়িক হিংসাকে উস্কিয়ে তুলতে এবং সাম্প্রদায়িক রং লাগিয়ে রায়কে কালিমালিপ্ত করতে উঠেপড়ে লেগেছেন। বাংলায় বিজেপির নির্ধারক পরাজয়ের জন্য বিজেপির রাজ্যসভা সাংসদ রাকেশ সিনহা মুসলিম ‘সংখ্যালঘু ভেটো’কে দায়ী করেছেন! তিনি প্রতারণাপূর্ণভাবে এই ইঙ্গিতই দিয়েছেন যে, এককাট্টা হয়ে ভোট দিয়ে মুসলিমরা একটা হিন্দু পার্টিকে হারিয়ে দিয়েছে। প্রকৃত ঘটনা হল, হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের ব্যাপক সংখ্যাধিক ভোটারই বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন। বিজেপির প্রাক্তন রাজ্যসভা সাংসদ স্বপন দাশগুপ্ত, যিনি বিধায়ক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাস্ত হয়েছেন, টুইট করে এই ভুয়ো খবরটি প্রচার করেছেন যে, তৃণমূল কংগ্রেসের মুসলিম লোকজন বিজেপির হিন্দুভোটারদের গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছে। বিজেপির সাধারণ সম্পাদক কৈলাস বিজয়বর্গীয় একটা ভিডিও টুইট করেছেন যাতে দাবি করা হয়েছে যে মুসলিম জনতা হিন্দুদের প্রহার করছে। এই ভিডিওটা সম্পূর্ণ ভুয়ো বলে প্রমাণিত হয়েছে।

বিজেপির প্রচার যন্ত্র নির্বাচনী লড়াইকে পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী দলগুলোর মধ্যে লড়াইয়ের পরিবর্তে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে লড়াই বলে তুলে ধরতে চেষ্টা চালাচ্ছে। আর তাই সামাজিক মাধ্যমে তাদের প্রচারে এবং রাকেশ সিনহার টুইটে দাবি করা হয়েছে, ৩০ শতাংশ মুসলিম “ঐক্যবদ্ধভাবে” ভোট দিলেও ৭০ শতাংশ হিন্দু ভোটারের মধ্যে বিভাজন রয়েছে, আর এই কারণেই হিন্দু আধিপত্যবাদী বিজেপিকে পরাস্ত হতে হয়। আসল ঘটনা কিন্তু পুরোপুরি আলাদা : অধিকাংশ হিন্দু এবং মুসলিম ভোটারই সমানভাবে বিজেপির সাম্প্রদায়িক ঘৃণার রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন।

পশ্চিমবাংলায় বিজেপির প্রচার একটা মাত্র এজেণ্ডার ওপরই ভর করেছিল — টিএমসি-কে মুসলিমপন্থী ও হিন্দু-বিরোধী রূপে তুলে ধরা, আর সেটা করতে গিয়ে তারা যতটা ইসলাম-বিরোধী কুৎসিত ভাষা কল্পনা করা যায় ততটাই ব্যবহার করেছে। এই প্রচার একেবারে মুখ থুবড়ে পড়ে। নির্বাচনী ফলাফল দেখিয়ে দিচ্ছে, হিন্দুভোটার সহ বাংলার ভোটাররা এই প্রচারকে শুধু অবিশ্বাসযোগ্য বলেই মনে করেননি, বিদ্বেষমূলক ও বিপজ্জনক বলেও গণ্য করেছেন। নির্বাচন পরবর্তী পর্যায়ে বিজেপির প্রচারে যে অলীক “মুসলিম ভোটব্যাঙ্ককে” দায়ী করা হয়েছে তার উৎস রয়েছে একচেটিয়া হিন্দু ভোটব্যাঙ্ক গড়ার তাদের ব্যর্থতা জনিত হতাশার মধ্যে। “ন্যায়নিষ্ঠ ভোটব্যাঙ্ক” বলে যে একটা বস্তু আছে সেটা স্বীকার করার সাধ্য ওদের নেই। ধর্মীয় পরিচিতি নির্বিশেষে এমন সমস্ত ভোটার যাঁরা সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সমতা ও ন্যায়ের জন্য ব্যাগ্র।

নির্বাচনী রায়কে কেন্দ্র করে বিজেপি সাম্প্রদায়িক ভাবাবেগ উস্কিয়ে তুলতে চাইছে, এবং তা শুধু পশ্চিমবাংলার মধ্যেই নয়, দেশজুড়ে। মোদী সরকারের সৃষ্টি করা সর্বনাশা কোভিড-১৯ বিপর্যয় থেকে ওরা দৃষ্টিকে সরিয়ে দিতে উন্মুখ। ব্যাপক হারে মাথাচাড়া দেওয়া এই অতিমারী আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট অক্সিজেন ঘাটতি, হাসপাতালের শয্যা এবং ওষুধপত্রের অভাবের কারণে। এ সত্ত্বেও, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা সাহায্য যাতে পীড়িত জনগণের কাছে পৌঁছয় তা সুনিশ্চিত করতে সক্রিয় উদ্যোগ নেওয়ার পরিবর্তে মোদী সরকার ৩০০ জন উচ্চ পদস্থ সরকারী কর্তাব্যক্তিদের নিয়ে “পারসেপশন ম্যানেজমেন্ট” (জনমানসে তৈরি হওয়া নেতিবাচক ধারণার মোকাবিলা করা) বিষয়ে অনলাইনে একটি কর্মশালা সংগঠিত করে! এই কর্মশালার লক্ষ্য ছিল সরকারী কর্তাব্যক্তিদের এমনভাবে প্রশিক্ষিত করা যাতে তাঁরা “সরকার সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা তৈরি করতে পারেন”, “সদর্থক ঘটনাবলী ও সাফল্যকে ফলপ্রসূভাবে তুলে ধরে ধারণাকে” ইতিবাচক করতে সক্ষম হন, এবং সরকারকে “সংবেদনশীল, উদ্যোগী, তৎপর সহানুভূতিশীল, কর্মঠ, ইত্যাদি” রূপে দেখাতে সমর্থ হন। মোদী সরকার যথারীতি কোভিড আক্রান্ত জনগণের জীবন রক্ষার পরিবর্তে নিজেদের ভাবমূর্তি বাঁচানোটাকেই ধ্যানজ্ঞান করছে।

অতিমারী কালে জনগণের জীবন রক্ষা নিয়ে যে সরকার একেবারেই বিচলিত নয়, যারা ভাবমূর্তি নির্মাণ এবং সাম্প্রদায়িক আখ্যান তৈরির লক্ষ্যেই নিজেদের উদ্যমকে টিকিয় রাখে, ক্ষমতায় থাকার যোগ্যতা সেই সরকারের নেই। কোভিড-১৯ সংকট থেকে বাঁচার সুযোগ যদি ভারতকে আদৌ পেতে হয় এবং অধিকতর মানুষের মৃত্যুর সংখ্যায় লাগাম পরাতে হয় তবে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে নরেন্দ্র মোদীকে অবশ্যই পদত্যাগ করতে হবে। আর পশ্চিমবাংলা সম্পর্কে বলতে হবে যে, হিংসাকে শক্ত হাতে রোখা এবং সমস্ত সংস্থান ও উদ্যমকে রাজ্যে কোভিড-১৯ অতিমারী মোকাবিলার লক্ষ্যে চালিত করার দায়িত্ব অবশ্যই ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের ওপরই বর্তাচ্ছে।

এম এল আপডেট এডিটরিয়াল, ৫ মে, ২০২১

খণ্ড-28
সংখ্যা-16