বার বার তিন বার, যেন না হয় শেষবার
Repeatedly three times

সাম্প্রদায়িক শক্তিকে পরাজিত করে তৃতীয় বারের জন্য মাননীয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে ক্ষমতায় এনেছেন রাজ্যের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। স্বাভাবিক আশা, মাননীয়া রাজ্যের মানুষের এই রায়কে সম্মান দেবেন এবং আগামী দিনে রাজ্যে আর্থ-সামাজিক সমস্যাগ্রস্ত মানুষের কথা শুনবেন ও তার সমাধানে সচেষ্ট হবেন।

করোনা অতিমারীর কারণে ইতিমধ্যেই আংশিক লকডাউন শুরু হয়ে গিয়েছে। ৫ মে থেকে ১৫ মে সরকারের পক্ষ থেকে লোকাল ট্রেন, পরিবহন, দোকান-বাজার, সরকারী অফিস সম্পর্কিত কিছু বিধিনিষেধ ঘোষণা করা হয়েছে। যা কার্যত বড় মাত্রায় লকডাউনে পরিণত হয়েছে। রাজ্যের মানুষও করোনা মোকাবিলায় সরকারকে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করতে সচেষ্ট রয়েছেন। কিন্তু, মানুষের খাদ্য, মজুরি ও চিকিৎসার নিশ্চয়তা ব্যাতিরেকে করোনা মোকাবিলা করা সম্ভব নয় বলেই আপামর জনগণ মনে করছেন। গতবছর সরকারি আদেশনামা অনুযায়ী সরকারী প্রতিষ্ঠানে লকডাউন পর্যায়ে কর্মচারীদের বেতন প্রদান করা হলেও বেসরকারী সংস্থা এবং অসংগঠিত শিল্পের শ্রমিকদের বেতন বা মজুরি দেওয়া হয়নি। এমনকি বহু শ্রমিককে চাকরি থেকে ছাঁটাই করা হয়েছে, আজও তারা বেকার। বহু মানুষ অর্থ, খাদ্য এবং চিকিৎসার অভাবেও মারা গেছেন। গতবছরের ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার আগেই আবার আংশিক লকডাউন শুরু হওয়ায় রাজ্যের শ্রমজীবী মানুষ আশঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন।

এই রকম অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে সকল শ্রমজীবী মানুষের খাদ্য, বেতন/মজুরি/ চাকরির নিশ্চয়তা এবং চিকিৎসার দায়িত্ব রাজ্য সরকারকে নিতে হবে। যে সকল অসংগঠিত শিল্পের শ্রমিকরা কাজে যেতে পারছেন না তাঁদের মাসিক ৭,৫০০ টাকা এবং বাড়ীর দুয়ারে খাদ্য সামগ্রী পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে।

বিগত দু’দফায় ‘দিদিকে বলো’ বা নবান্নে আবেদন নিবেদন করে যারা কোন সমাধান পাননি তাদের কথা শোনায় মনযোগী হতে হবে। কয়েকটি ক্ষেত্রের অসহায় শ্রমিক কর্মচারীদের দীর্ঘদিনের সমস্যা ও দাবিগুলি আজও অমীমাংসিত থেকে গেছে, যে শ্রমিক কর্মচারীরা তৃতীয় দফায় মা-মাটি-মানুষের সরকার গঠনে বিশেষ ভুমিকা নিয়েছেন। তাঁদের সমস্যাগুলি নিম্নরূপ।

(১) সরকারী পরিবহন শিল্পের শ্রমিক

এই শিল্পের শ্রমিকরা অত্যন্ত ঝুঁকির সাথেই কাজ করে চলেছেন। ইতিমধ্যে করোনা আক্রান্ত হয়ে একাধিক শ্রমিকের মৃত্যুও হয়েছে। এই শিল্পের সকল শ্রমিকদের করোনা অতিমারী চলাকালীন ৩০ লক্ষ টাকার জীবনবীমা চালু করা অত্যন্ত জরুরি। মৃত শ্রমিক পরিবারের একজন সদস্যকে চাকরি এবং করোনা আক্রান্ত শ্রমিকদের চিকিৎসার সুবন্দোবস্ত করতে হবে।

ধ্বংসপ্রায় এই শিল্পের পুনরুজ্জীবনের জন্য সংস্থার সকল ইউনিয়নগুলির সাথে আলোচনা করে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সকল কন্ট্রাক্টর, অস্থায়ী ও ফ্রাঞ্চাইজি সংস্থার অধিনস্ত কর্মীদের অবিলম্বে স্থায়ীকরণ প্রয়োজন।

এই শিল্পের কর্তৃপক্ষ শ্রম আইনের তোয়াক্কা না করে যখন তখন যাকে ইচ্ছা কাজ থেকে বসিয়ে দেওয়ার যে নিয়ম চালু করেছিল তাতে আজ শতাধিক শ্রমিক তাঁদের পরিবার নিয়ে অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন। এবিষয়ে প্রাক্তন পরিবহন মন্ত্রীর কাছে ‘অল ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট ট্রান্সপোর্ট সংগ্রামী শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের’ (এআইসিসিটিইউ) পক্ষ থেকে বিস্তারিত লিখিতভাবে জানানোও হয়েছে। কিন্তু, কোন সমাধান হয়নি। আপনার কাছে অনুরোধ এই বিষয়টিতে আপনি হস্তক্ষেপ করুন যাতে ঐ শতাধিক শ্রমিক তাদের কাজ ফিরে পান এবং বকেয়া বেতন পেয়ে তাদের পরিবারের সদস্যদের অনাহারের হাত থেকে বাঁচাতে পারেন।

(২) কলেজ ক্যাজুয়াল কর্মচারী

পশ্চিমবঙ্গের কলেজগুলির প্রায় ৫ হাজারের অধিক ক্যাজুয়াল কর্মচারী পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন কলেজে দীর্ঘ ৫ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত কাজ করে আসছেন। কলেজ ভিত্তিক গভর্নিং বডির মাধ্যমে এঁদের নিয়োগ করা হয়েছে। বেতনেরও কোন নির্দিষ্ট কাঠামো না থাকায় ২,০০০ থেকে ১০,০০০ টাকা বেতন দেওয়া হয়। লকডাউন পর্যায়ে অনেক কলেজের কর্তৃপক্ষ এঁদের বেতনও দেননি। এঁরা বিগত ৪ বছরেরও অধিককাল যাবত তাঁদের সমস্যার কথা সরকারের কাছে জানিয়ে আসছেন। বেশ কয়েকবার ‘পশ্চিমবঙ্গ কলেজ ক্যাজুয়াল কর্মচারী সমিতি’র পক্ষ থেকে উচ্চশিক্ষা মন্ত্রীর সাথে দেখা করে তাঁদের দাবিগুলি জানিয়েছেন। এখনো কোনো সমাধান না হওয়ায় আপনার হস্তক্ষেপ অত্যন্ত জরুরী। অবিলম্বে -- (১) গত বছরের লকডাউন পর্যায়ের বেতন প্রদান করা হোক, (২) গেস্ট টিচারদের কলেজ গভর্নিং বডি নিয়োগ করলেও, তাঁদের যেমন বেতন কাঠামো আছে সেরকম ক্যাজুয়াল কর্মীদের জন্যও বেতন কাঠামো চালু করা, এবং (৩) যতদিন না স্থায়ীকরণ হচ্ছে ততদিন রাজ্য সরকারের সার্কুলার ৩৯৯৮F(p2) অনুযায়ী এঁদেরকে স্বীকৃতি ও সুবিধা প্রদান করা হোক।

(৩) স্বনিযুক্ত শ্রম সংগঠক (এসএলও)

রাজ্য সরকারের শ্রম দপ্তরের অধিনে প্রায় ৫ সহস্রাধিক কর্মীরা (এসএলও) বছরের পর বছর কাজ করে আসছেন। রাজ্যের বিভিন্ন কর্পোরেশন, পৌরসভা, পঞ্চায়েত এলাকার অসংগঠিত শ্রমিকদের কাছ থেকে সামাজিক সুরক্ষা যোজনার ২৫ টাকা সংগ্রহ করলে ২ টাকা কমিশন হিসাবে তারা পেতেন। কিন্তু গত ১৯ মার্চ ২০২০ তারিখের সরকারি সার্কুলারের (৬৪৮/৪৮/ WBUSWWB) পরিপ্রেক্ষিতে সেই কাজ বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে শ্রমমন্ত্রীর সাথে ঐ কর্মচারীদের প্রতিনিধিরা দেখা করে ডেপুটেশন দেন। শ্রমমন্ত্রী কর্মচারিদের আগামীদিনে নির্দিষ্ট কাজ এবং নির্দিষ্ট বেতন প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু আজও তার সমাধান হয়নি। গতবছর লকডাউন পর্যায় থেকে এঁরা পরিবার পরিজন নিয়ে অভুক্ত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। এমতাবস্থায়, আপনার হস্তক্ষেপ অত্যন্ত জরুরি। এইক্ষেত্রের কর্মচারীদের অবিলম্বে এককালীন আর্থিক সহযোগিতা ও আগামীদিনে নির্দিষ্ট কাজ ও নির্দিষ্ট বেতন কাঠামো প্রণয়নের জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য অনুরোধ করছি।

(৪) বেসরকারী পরিবহন শিল্পের শ্রমিক

আমাদের রাজ্যে হাজার হাজার বেসরকারী পরিবহন শিল্পের শ্রমিক আছেন। যারা লকডাউন পর্যায়ে খাদ্য এবং আর্থিক সংকটের মধ্যে দিয়ে দিন কাটিয়েছেন। এঁদের কারুর রেশন কার্ড না থাকলেও আগামী ছ’মাস সবাইকে বিনামূল্যে রেশন দেওয়া হোক এবং ৭,৫০০ টাকা করে দেওয়া হোক। অতিমারীর পর্যায়ে এই সকল কর্মীদের ৩০ লক্ষ টাকার জীবনবীমা করা হোক।

(৫) বেসরকারী সংস্থার শ্রমিক কর্মচারী

গতবছর সরকারী নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও বহু বেসরকারী সংস্থার কর্তৃপক্ষ তাদের শ্রমিক কর্মচারীদের লকডাউন পর্যায়ের বেতন দেয়নি, এমনকি কাজ থেকে বসিয়েও দিয়েছে। এইসব কর্তৃপক্ষ যাতে বকেয়া বেতন প্রদান করে, কাজে ফিরিয়ে নেয় এবং বর্তমান আংশিক লকডাউন পর্যায়ে তাদের বেতন ও চাকরির নিশ্চয়তা থাকে তারজন্য আপনার হস্তক্ষেপ অত্যন্ত জরুরি।

(৬) সরকারী-বেসরকারী স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান, পৌরসভার কর্মী, ‘আশা’ ও আইসিডিএস ও মিড-ডে-মিল কর্মী

অতিমারির পর্যায়ে সরকারী, বেসরকারী স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান, পৌরসভার সাফাই বিভাগে কর্মরত সকল স্থায়ী, অস্থায়ী কর্মী, ‘আশা’ ও আইসিডিএস ও মিড-ডে-মিলে কর্মরত কর্মীদের ৩০ লক্ষ টাকার জীবনবীমা করা এবং করোনা আক্রান্ত কর্মীদের বেতন সহ চিকিৎসার সুবন্দোবস্ত করা প্রয়োজন।

(৭) স্ট্রীট হকার, রেল হকার, রিক্সা চালক, ছোট দোকানদার তথা অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমজীবী মানুষ

লকডাউনের ফলে এইক্ষেত্রের হাজার হাজার শ্রমজীবী মানুষ গতবছর অসহায় এবং অভুক্ত অবস্থায় দিন কাটিয়েছেন। ‘প্রচেষ্টা’ প্রকল্পের টাকা সবাই পাননি। সকলকে আগামী ৬ মাস বিনা পয়সায় রেশন ও ৭,৫০০ টাকা আর্থিক সাহায্যের জন্য আপনার হস্তক্ষেপ অত্যন্ত জরুরি। ‘প্রচেষ্টা’ প্রকল্পে অফলাইন ও অনলাইনে ফর্ম পূরণের মাধ্যমে আর্থিক সাহায্য প্রদান করা হোক এবং অর্থের পরিমাণ ১০,০০০ টাকা করারও আবেদন তারা জানিয়েছেন।

আশা করব এই সমস্ত বিষয়ে তৃতীয় দফার সরকার বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করবে। অবশ্যই আশা করব মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী শ্রমিক কর্মচারী সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিদের সাথে সাক্ষাতে আলোচনা করবেন। গত দু’দফার মতো কারো সাথে দেখা না করার ঔদ্ধত্য পরিহার করবেন এবং জনগণের উপর ভরসা বাড়িয়ে আমলা নির্ভরতা কাটিয়ে উঠবেন।

- দিবাকর ভট্টাচার্য 

খণ্ড-28
সংখ্যা-18