সলিল বিশ্বাস, সলিলদা, আপনাকে বলছি স্যার, শুনছেন!
Salilda, I'm telling you sir, listening!

সিপিআই(এমএল)’র চিরকালীন শুভানুধ্যায়ী, অল ইন্ডিয়া পিপলস ফোরামের জাতীয় কাউন্সিল সদস্য অধ্যাপক সলিল বিশ্বাস প্রয়াত হয়েছেন গত ২১ মে গভীর রাতে। জন্ম ১৯৪৫ সালে, ফলে মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল প্রায় ৭৬ বৎসর। মৌলানা আজাদ কলেজ থেকে ইংরাজী সাম্মানিক নিয়ে স্নাতক হওয়ার পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ হন। ষাটের দশকের শেষদিকে নকশালপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে জুড়ে যান তিনি। পরে অল্প কিছুদিন দার্জিলিং গভার্নমেন্ট কলেজে পড়ানোর পরে তিনি আমাদের কলেজে অর্থাৎ হেরম্বচন্দ্র কলেজে যোগদান করেন এবং সেখান থেকেই ভারপ্রাপ্ত অধ্যাপক (অধ্যক্ষ) হিসেবে অবসর নেন ২০০৭ সালে। সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ না দিলেও নকশালপন্থী সংগঠনগুলি বিশেষত লিবারেশনের সঙ্গে তার যারপরনাই ঘনিষ্টতা ছিল। নাগরিক, গণতান্ত্রিক শিক্ষা, সাংস্কৃতিক আন্দোলন, কর্মসূচী, বিক্ষোভ এসবেই তাঁর উপস্থিতি ছিল ধারাবাহিক। প্রথাগত শিক্ষার বিপ্রতীপে বিকল্প শিক্ষার জন্য, দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের সন্তানদের শিক্ষার পিছনে তিনি শ্রমদান করেছেন বিপুল উৎসাহে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত শ্রমজীবী দরিদ্র মানুষের ভাষায় তাদের জন্য তাদের প্রয়োজনীয় শিক্ষা কী হতে পারে তা নিয়ে চিন্তা করে গেছেন। অসুস্থ শরীরে কোভিড-১৯ অতিমারীর মধ্যে পাওলো ফ্রেইরির শিক্ষণ পদ্ধতি নিয়ে লিখেছেন ‘ফ্রেইরি চর্চা - পাঁচ কাহন’, গত জানুয়ারির গোড়ায় যা প্রকাশিত হয়েছে। গত শতাব্দীর আটের দশকে সমমনস্ক শিক্ষকদের নিয়ে শুরু করেছিলেন ‘ফোরাম ফর এডুকেশন’, যা একদিকে পশ্চিমবঙ্গ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির মধ্যে প্রেসার গ্রুপ হিসেবে কলেজশিক্ষার উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করেছে, অপরদিকে বিভিন্ন নিম্নবিত্ত বস্তির শিশুদের পড়াশোনা করিয়েছে। অবসরের পরে তিনি বেলুড়ে শ্রমজীবী বিদ্যালয়ে পড়াতেন নিয়মিত, যতদিন পর্যন্ত সেই বিদ্যালয় চলেছে।

সলিলদার সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৯৪ সালে, হেরম্বচন্দ্র কলেজে যখন আমি বাংলার অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করি। নবাগত আমি চুপচাপ নজর করতাম সকলকে। ঋজু, সৌম দর্শন সলিলদা যেন একটু গম্ভীর প্রকৃতির কিন্তু ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির ছোঁওয়া। কিছুদিনের মধ্যেই আলাপচারিতার শুরু। জানিনা কী এক অমোঘ রসায়নে অচিরেই পাশের চেয়ারে আমার স্থান হয়ে গেল। শিক্ষকতা করতে এসে আমার শিক্ষার শুরু। একদিন একটা বই হাতে দিলেন, বললেন পড়ে দেখ; ‘আপনাকে বলছি স্যর’। বারবিয়ানা স্কুল থেকে, অনুবাদক সলিল বিশ্বাস। নিলাম, পড়লাম, বিস্মিত হলাম, ভাবতে শুরু করলাম। ক্রমে ক্রমে আবিষ্কার করতে লাগলাম ওঁর নানান ধরনের লেখা। তাঁর ডাইনোসরের দ্বীপ, ডলফিনের রাজ্যে, সাইল্যাস টিম্বারম্যান ইত্যাদি গ্রন্থ হাতে আসতে লাগল। কী অসাধারণ লেখার ভঙ্গি। অনুবাদ হলেও এক একটি স্বতন্ত্র সৃষ্টি। ইতিমধ্যে কাজ চলছে ইউটোপিয়ার। আমার সৌভাগ্য হল ওনার খসড়া পড়ার। লিখে বলতেন পড়ে দেখ পাঠক হিসেবে কোনো অসুবিধে লাগছে কিনা। টুকটাক মন্তব্য করতাম। উনি সেগুলি উপযুক্ত মনে হলে গ্রহণ করতেন।

সহজ মানুষ ছিলেন। তাঁর পান্ডিত্যের গভীরতা বোঝা কিন্তু সহজ ছিলনা। চমক লাগত এক একদিক যখন উন্মোচিত হত। কালো আমেরিকান কবিদের কবিতার অনুবাদ করলেন, ছায়া হারলেম, মিথেন ফোয়ারার প্রেম। এগুলি শুধু কবিতার অনুবাদ নয়, কবিদের পরিচিতি, রাজনৈতিক সামাজিক প্রেক্ষাপটের ইতিহাস সব তথ্যই বিদ্যমান। সেই একই যত্নে পেলাম বোরহেসের ছোটোগল্পের দুটি সংকলন। কত অজানা তথ্য জলের মত সহজ করে হাতে তুলে দিতেন। দেশ বিদেশের কত ভান্ডারের আগল খুলে যেত তাঁর রচনার জাদুদন্ডে। বলে রাখি তাঁর প্রতিটি লেখায় ব্যক্ত হত সমাজ রাজনীতির কঠোর বাস্তব সত্য। মাটি থেকে পা কখনও ওঠেনি কিন্তু মস্তক ছিল উন্নত, দৃষ্টি ছিল সুদূর প্রসারী। প্রসঙ্গত একটা মজার কথা মনে পড়ছে, তাঁর এক ঘনিষ্ঠ সমবয়সী সহকর্মী একবার প্রশ্ন করেছিলেন, তুই খালি অনুবাদই করবি, নিজে লিখবি না? তার, বেচারার জানার কথাও নয়, তিনি কী করে জানবেন কত স্বরচিত কবিতা, গল্পের মনি মুক্তা ছডিয়ে আছে বাংলার বিভিন্ন পত্র পত্রিকায়। মননঋদ্ধ, যুক্তিবাদী প্রবন্ধের কথা তো ছেড়েই দিলাম। তাঁর আগ্রহ ছিল সমস্ত সমসাময়িক বিষয়ে। তাঁর শেষ প্রকাশিত গ্রন্থ ‘ফ্রেইরি চর্চা - পাঁচ কাহন’। তার বছর দেড়েক আগে থেকে তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত, তারও আগে স্ট্রোকের ধাক্কা সামলেছেন, কিন্তু শারীরিক অসুস্থতা কখনই তাঁর জ্ঞানপিপাসু মনকে ক্ষান্ত করতে পারেনি।

কম্প্যুটার তখন সবে নড়ে চড়ে বিশাল শরীরে নানা জটিল প্রক্রিয়া নিয়ে আবির্ভূত। সলিলদা শিখে ফেললেন। সেই মানুষটি আবার যখন নেট দুনিয়া এল সেখানেও উৎসুক হলেন। পড়ে নেড়ে শিখে ফেললেন। সেই সলিলদা এরপর লিখে ফেললেন ইন্টারনেট নামে একটি অসাধারণ গ্রন্থ, বাংলা ভাষায় সেই সময়ে এই বিষয়ে লেখা প্রথম গ্রন্থ। একাধিক সংস্করণও হয়েছিল সেই  বইটির।

সলিলদা ছিলেন ইংরেজি ভাষা সাহিত্যের অধ্যাপক। ছিলেন পরিশ্রমী ও ছাত্রদরদী শিক্ষক। পড়ানোর বিষয়ে কখনো কোনো ত্রুটি রাখতেন না। ইংরেজি ভাষায় জ্ঞানগর্ভ প্রচুর প্রবন্ধ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বিভিন্ন পত্রিকার পাতায়। তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ ছিল ‘পেগাস্যাস’ পত্রিকা প্রকাশ ও সম্পাদনা। হেরম্বচন্দ্র কলেজের ইংরেজি বিভাগের পত্রিকা হিসেবে তা আত্মপ্রকাশ করে। বিভিন্ন কলেজের ইংরেজির অধ্যাপকদের থেকে লেখা সংগ্রহ করে তা নিখুঁত সম্পাদনায় প্রকাশ করতেন। সেই পেগাস্যাসকে কেন্দ্র করে একটি সোসাইটিও গড়ে ওঠে। ইংরেজি চর্চা করেন যাঁরা তাঁদের কাছে এই পেগাস্যাস এক অনন্য সম্পদ। এসবের সঙ্গে তাঁর আরও একটি শখ ছিল, ছবি তোলা। ফটোগ্রাফি তাঁর আদত নেশার জায়গা। ১৯৯৭ সালের ২৫ মে নকশালবাড়ির ৪০ বছরে শহিদ মিনারে সিপিআই(এমএল)-এর যে সভা হয়েছিল সেখানে ছবি তুলতে হাজির ছিলেন তিনি।

২০০৭ সালে কলকাতা পার্টি কংগ্রসেও তিনি এসেছিলেন ওপেন কনভেনশনে, মেট্রো চ্যানেলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের বিভিন্ন সম্মেলনে, সৃজন উৎসবেও যোগ দিয়েছেন তিনি।

এই আপাদমস্তক প্রচার বিমুখ সমাজ সচেতন রাজনীতিমনস্ক পন্ডিত মানুষটি আমাদের খুব কাছাকাছি ছিলেন। ওঁর মতো দৃঢ়চেতা মানবদরদী, শিক্ষক, সংগঠক, বন্ধুবৎসল, মানুষের সংশ্রবে থাকতে পারাও এক অসীম পাওনা। কোনো বিশেষণটিই আলঙ্কারিক নয়, আক্ষরিক। একবিংশ শতাব্দীর একবিংশতম বর্ষের মে মাসের একবিংশতম দিনে তিনি একক গমনে অন্তর্হিত হলেন।

-- নবনীতা চক্রবর্তী 

খণ্ড-28
সংখ্যা-19