তথাগত রায়ের ‘নগরীর নটী’ ফেটিশ
Tathagata Roy

বিরুদ্ধ দলের মহিলা প্রার্থীদের অবমাননা, তাদের প্রতি নারীবিদ্বেষী মন্তব্য ভোট প্রচারে নতুন নয়। ঊনত্রিশটি দেশে সমীক্ষা করে দেখা গেছে যে ৪৪% মহিলা রাজনীতিবিদদের খুন, ধর্ষণ বা অপহরণের হুমকি পেতে হয়, বা সত্যিই এসব অপরাধ ঘটে তাঁদের সঙ্গে।

পশ্চিমবঙ্গের সদ্য সমাপ্ত বিধান সভা নির্বাচন থেকেও তার ভুরি ভুরি নিদর্শন তুলে আনা যায়। যেমন নন্দীগ্রামে যেতে গেলে আটকে দেওয়া হয় মহিলা প্রার্থী মীনাক্ষী মুখার্জীকে আর বলা হয়, তাঁর আসার কথা ‘আগে জানলে ভয়ংকর পরিণতি হত’৷ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নারী হওয়ার তাঁকে ঘিরে নারীবিদ্বেষী মন্তব্যও কম হয়নি৷ সম্প্রতি খবর, যে সুরে প্রধানমন্ত্রী ‘দিদি, ও দিদি’ বলে মুখ্যমন্ত্রীকে ডেকেছিলেন দু-একটি জনসভা থেকে, সেই সুর নাকি ভারি পছন্দ হয়েছে এ রাজ্যের রাস্তার রোমিওদের। সেই সুরেই তারা মহিলাদের উত্যক্ত করছেন আজকাল।

ওদিকে মুখ্যমন্ত্রীর তথাকথিত ‘চোট পাওয়া’ পাটি সভায় ঈষৎ তুলে রাখতে হচ্ছে বলে, গোড়ালি দেখা যাচ্ছে বলে, বিরোধী দলের রাজ্য সম্পাদকও মুখ্যমন্ত্রীকে বারমুডা পরার পরামর্শ দিয়েছিলেন। এসব ভোটের আবহে নিত্যদিনের চক্ষু কর্ণের যন্ত্রণার কারণ।

কিন্তু নিজেরই দলের নারী প্রার্থীদের বারংবার অপমান করার, প্রায় স্লাট-শেইম করার নজির গড়েছেন বিজেপির অন্যতম ‘শিক্ষিত’ নেতা, মেঘালয়ের প্রাক্তন রাজ্যপাল তথাগত রায়। তিনি এর আগেও তাঁরই দলের নারী প্রার্থীদের ‘নগরীর নটী’ বলে সম্বোধন করেছিলেন৷ তাঁরা দোলের দিন বিরুদ্ধ দলের এক নেতার সঙ্গে সেলফি তুলেছিলেন। সে কারণেই আক্রোশ। বাক্যবন্ধটি যে রবীন্দ্রনাথের ‘অভিসার’ কবিতা নেওয়া নেওয়া তা বাঙালি মাত্রেই জানে। বাসবদত্তা সম্পর্কে কবি বলেছিলেন, ‘নগরীর নটী চলে অভিসারে যৌবন মদে মত্তা’। যদিও বাসবদত্তার কালে বেশ্যারা ছিলেন নগরে সম্মাননীয়া। তাঁদের বৃত্তিকেও হীন ভাবা হত না৷ কিন্তু বাসবদত্তার ‘যৌবন মদে মত্তা’ অভিসারী রূপটি একজন মহিলা রাজনৈতিক প্রার্থীর উপর আরোপ করা কতটা যুক্তিসঙ্গত, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। সে নারীরা আবার বক্তার নিজেরই দলের প্রার্থী। তাঁরা অভিনয় জগত থেকে এসেছেন বলেই কি তাঁদের ‘নগরীর নটী’ বলা হল? কিন্তু বাসবদত্তার কাল আর এ কাল তো সমান নয়। এ কালে নটীরা আবশ্যিক ভাবে বেশ্যাবৃত্তি অবলম্বনও করেন না৷ আবার বেশ্যাবৃত্তিও তার সম্মান খুইয়েছে। যতই যৌনকর্মকে শ্রমের মর্যাদা দেওয়ার দাবি তোলা হোক, আম্রপালি বা বাসবদত্তার মতো সম্মান পান না আজকের যৌনকর্মী। তাই সে সব রেফারেন্সে কোনো নারী অসন্তুষ্ট হতেই পারেন। অনভিজ্ঞ প্রার্থীদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা নিয়ে বর্ষীয়ান নেতার বক্তব্য থাকতেই পারে। কিন্তু তিনি যেন নারী হিসেবেই তাদের খাটো করে দেখতে তৎপর, যেন ‘নগরীর নটী’ বা যৌনবস্তু বা পার্টির শোকেসে সাজানোর জন্য সুদৃশ্য সামগ্রী ছাড়া কিছু ভাবতেই পারছেন না।

কার্যক্ষেত্রে অবশ্য দেখা গেল, নারীবাদী কর্মী ও নাগরিকরাই তথাগতবাবুর এই দুর্বিনীত টুইটারের নিন্দা করলেন। আক্রান্ত প্রার্থীরা নীরব থাকলেন বা অতি মৃদু প্রতিবাদ করলেন।

এরপর ভোট হল। ফলও বেরোলো। ফল বেরোনোর পর ক্রুদ্ধ তথাগত রায় একই বাক্যবন্ধ ব্যবহার করে আবারও ফেসবুকে পোস্ট করলেন। এবারের পোস্টটি ছিল এরকম : ‘পায়েল শ্রাবন্তী পার্নো ইত্যাদি ‘নগরীর নটীরা’ নির্বাচনের টাকা নিয়ে কেলি করে বেড়িয়েছেন আর মদন মিত্রর সঙ্গে নৌকাবিলাসে গিয়ে সেলফি তুলেছেন (এবং হেরে ভূত হয়েছেন) তাঁদেরকে টিকিট দিয়েছিল কে? কেনই বা দিয়েছিল? দিলীপ-কৈলাশ-শিবপ্রকাশ-অরবিন্দ প্রভুরা একটু আলোকপাত করবেন কি?’

অর্থাৎ হারের দায় চাপালেন প্রার্থীর উপর। অযোগ্য প্রার্থী নির্বাচনের দায় চাপালেন ‘কারিয়াকর্তা’-দের উপর। কিন্তু ‘কেলি,’ ‘নৌকাবিলাস’ আর ওই ‘নগরীর নটী’ কথাগুলি থেকেই গেল স্লাটশেমিং-এর দ্যোতক হয়ে। প্রশ্ন জাগে, পরাজিত পুরুষ প্রার্থীদেরও কি একই ভাষায় ভর্ৎসনা করেন তথাগতবাবু? বলা বাহুল্য, করেন না।

এ বিষয়ে অন্যতম পরাজিত প্রার্থী তথা অভিনেত্রী শ্রাবন্তীর প্রতিক্রিয়া অবশ্য তাড়াতাড়িই পাওয়া গেছে। তিনি ‘পার্টির টাকা’ ওড়ানোর অভিযোগের তীব্র বিরোধিতা করেছেন। বাকি অংশটুকু সম্পর্কে নীরবই থেকেছেন।

মেয়েরা যে কেবল পুরুষের সন্তান উৎপাদন, যৌনসুখ প্রদান এবং গৃহকর্মের সাধনের জন্য, এই মনোভাব বিজেপির আদর্শগত উৎসমুখ আরএসএস কখনও গোপন করেনি৷ আরএসএস যে দুর্গাবাহিনী পরিচালনা করে, বিজেপির আছে যে মহিলা মোর্চা, তা নারীর এই সনাতনী রূপকেই তার শক্তির উৎস বলে মানে। এই ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতান্ত্রিক দলে মহিলারা তবু যোগ দেন, এই দলের হয়ে মহিলারা তবু ভোটে দাঁড়ান, ঠিক যেভাবে অনেক মহিলাই সমাজে ও পরিবারে পিতৃতন্ত্রের বাহক হয়ে ওঠেন, পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রচারক হয়ে ওঠেন। এ বড় দুর্ভাগ্যের বিষয়।

আমাদের আরও ভাবা দরকার, যে দলের একজন অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত নেতাই অহরহ স্লাট শেইম করতে থাকেন, তাও আবার নিজেরই দলের প্রার্থীদের, সেই দলের ৭৭ জন বিধায়ক বিধান সভায় থাকাটা কতটা কাঙ্ক্ষিত, তা নারী নাগরিকদের জন্য কতটা হিতকর। চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট হোম, তাই নিজের বাড়ির নারীদের সম্মান করার শিক্ষার মাধ্যমেই লিঙ্গসাম্যের দীক্ষা শুরু হয়। যে দল নিজের দলের মেয়েদেরই যোগ্য সম্মান দিতে অক্ষম, সে কীভাবে গোটা দেশের মেয়েদের সম্মান দেবে কী করে? কী করেই বা তাদের অধিকারের লড়াই-এ ভূমিকা নেবে?

– শতাব্দী দাশ  

খণ্ড-28
সংখ্যা-16