ভয়াবহ কোভিড পরিস্থিতি: স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বড় বিপর্যয়ের মধ্যে ভারত
Terrible Covid situation

“রোগী উপচেপড়া হাসপাতালগুলোর গেটে অ্যাম্বুলেন্সের সারি, কোভিড সংক্রমিত রোগীদের পরিজনদের অক্সিজেনের জন্য কাতর আবেদন জানিয়েও বিফল হওয়া এবং গণদাহ - এই দৃশ্য মিথ্যা বলতে পারে না। শহর-নগর থেকে গ্ৰামাঞ্চল, ধনী থেকে দরিদ্র, চলমান হত্যালীলা কাউকেই রেহাই দিচ্ছে না। ... নরেন্দ্র মোদীর দূরদর্শিতার অভাব, ঔদ্ধত্য এবং জনপ্রিয়তা আদায়ের চেষ্টাই স্পষ্টত এমন পরিস্থিতির পিছনে কারণ যা এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে এবং যার জন্য বিদেশী সাহায্যের প্রয়োজন। ২০২০ সালে দেশের জন্য নির্মম বন্দিত্বর আদেশ জারি করে, লক্ষ-লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকদের উপেক্ষা করার মধ্যে দিয়ে দেশকে পঙ্গু করে তুলে ও মর্মান্তিক যন্ত্রণার মধ্যে ঠেলে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী ২০২১’র গোড়ায় তাঁর প্রহরাকে শিথিল করে তোলেন। … স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শর চেয়ে জাতীয়তাবাদী বুলির ওপর ভর করে, জনগণের সুরক্ষার চেয়ে আত্মগৌরবের দিকে ঝুঁকে শ্রীযুক্ত মোদী পরিস্থিতিকে সংকটাপন্ন করেই তুলেছেন।” এখানে যা উদ্ধৃত হল তা ভারতের কোনো মোদী-সমালোচক ভাষ্যকারের কথা নয়। ফ্রান্সের সংবাদপত্র ‘ল্য মঁদ’এর ২৭ এপ্রিলের সম্পাদকীয়তে এমনই মন্তব্য করা হয়েছে। যে মোদী আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের কোভিডকে পরাস্ত করার বড়াই করেছিলেন, কোভিড চিকিৎসার জন্য ভারতকে টিকা সহ বিশ্বের ওষুধের ভাণ্ডার বলে বর্ণনা করেছিলেন, বিশ্বের দরবারে কোভিড ত্রাতা সেজেছিলেন, সেই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেই আজ ভারতের সঙ্কটজনক কোভিড পরিস্থিতির জন্য সরাসরি মোদীকেই দায়ী করা হচ্ছে। দৈনন্দিন সংক্রমণে ভারত আমেরিকাকে ছাড়িয়ে বিশ্বে আজ প্রথম - গত ৭ মে দৈনিক সংক্রমণ চার লক্ষর গণ্ডি পেরিয়ে দাঁড়ায় ৪,১৪,১৮৮। আজ আসমুদ্র হিমাচলে অক্সিজেনের জন্য হাহাকার, জীবনদায়ী ওষুধের অমিল, রয়টারের হিসেব অনুসারে দিল্লী রাজ্যে প্রতি চার মিনিটে একজনের কোভিডে মারা যাওয়া, অক্সিজেন ও জীবনদায়ী ওষুধের ব্যাপক কালোবাজারি, কোভিডে মৃত্যুর সংখ্যাকে গোপন করার মরিয়া প্রচেষ্টা - এমনই কোভিড পরিস্থিতির মুখে আজ ভারতবাসী। সঙ্কটের কয়েকটা দিকে তাকানো যাক।

শয্যা সঙ্কট: কোভিডে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বিপুল আকার নেওয়ায় হাসপাতালগুলোতে শয্যার চাহিদাও বেড়ে চলেছে। আক্রান্তদের সংখ্যা এতই বিশাল যে তাদের একটা ক্ষুদ্র অংশেরও ভর্তির প্রয়োজনের তুলনায় লভ্য শয্যার সংখ্যা একেবারেই অপ্রতুল বলে প্রতিপন্ন হচ্ছে। একটা পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যেতে পারে সঙ্কটের মাত্রা। দিল্লীর এক কেন্দ্রীয় হাসপাতালে শয্যার মোট সংখ্যা ১০,০০০, তার মধ্যে কোভিড রোগীর জন্য সংরক্ষিত শয্যার সংখ্যা ১,৮০০। ঐ সংরক্ষিত সংখ্যাকে বাড়িয়ে ৭,০০০ করার জন্য দিল্লীর মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীবাল চিঠি লিখেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কাছে।

অক্সিজেনের আকাল: এপ্রিল মাসের তৃতীয়-চতুর্থ সপ্তাহে দেখা গেল, অক্সিজেনের অভাবে কোভিড চিকিৎসা বিপর্যয়ের মুখে। একের পর এক রাজ্যে (দিল্লী, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, কর্ণাটক যার কয়েকটি) অক্সিজেনের অভাবে বহু রোগীর মৃত্যু ঘটল, রোগীদের অবস্থা ক্রমেই আরও সঙ্কটজনক হয়ে আসছে দেখার পরও তাদের নাকের নলে অক্সিজেন জোগান দেওয়া গেল না। অক্সিজেনের সাহায্যে বেঁচে থাকা রোগীদের পরিজনদের উদ্দেশ্যে একাধিক হাসপাতালে নোটিস ঝোলানো হল - রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় সরকারকে অনুরোধ করা সত্ত্বেও অক্সিজেনের ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না, তাঁরা যেন রোগীদের অন্যত্র সরিয়ে নেন।

মে মাসের গোড়াতেও অক্সিজেন সঙ্কটের সুরাহার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। কেন্দ্রের কাছ থেকে প্রয়োজনমতো অক্সিজেন না পেয়ে বেশ কিছু রাজ্যকে আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়েছে। গত ৭ মে সুপ্রিম কোর্ট তাদের রায়ে বলেছে - কর্ণাটক হাইকোর্ট এবং দিল্লী হাইকোর্ট সংশ্লিষ্ট রাজ্য দু’টির জন্য প্রতিদিন যথাক্রমে ১,২০০ টন ও ৭০০ টন অক্সিজেন সরবরাহের যে নির্দেশ কেন্দ্রকে দিয়েছে তা একেবারেই যথাযথ এবং কেন্দ্রীয় সরকারকে তা সুনিশ্চিত করতে হবে। অক্সিজেন সরবরাহকে স্বচ্ছভাবে চালনা করতে সুপ্রিম কোর্টকে এমনকি ডাক্তার ও আমলাদের নিয়ে ১২ সদস্যের এক টাস্কফোর্স গঠন করতে হয়েছে।

টিকা: জনমুখী নীতির অভাব ও কোম্পানিকে মুনাফাবাজি করতে দেওয়া কোভিড টিকা বাজারে আসার সাথে-সাথে অনেক দেশই, বিশেষভাবে উন্নত দেশগুলো গণটিকাকরণের নীতি নেয় এবং এতে সুফলও মেলে। ভারত কিন্তু একদিকে টিকা কর্মসূচী শুরু করে এবং অন্যদিকে টিকা কূটনীতি চালিয়ে ভারতে উৎপন্ন টিকা বিভিন্ন দেশে রফতানি করতে থাকে। এই দ্বিমুখী নীতি টিকা ক্ষেত্রেও মোদী সরকারের দূরদর্শিতার অভাবকে প্রকট করে তোলে। দেশের কোভিড সংক্রমণ লাগামছাড়া হয়ে উঠে টিকার চাহিদাকে ঊর্ধ্বমুখী করায় ঘাটতিও চূড়ান্ত আকার নেয়। কোথাও টিকা নেওয়ার জন্য ভোর থেকেই লম্বা লাইন পড়ে, লাইনে অনেক ঘন্টা দাঁড়ানোর পরও মজুত ফুরিয়ে যাওয়ায় টিকা মেলে না, অনেক টিকা দান কেন্দ্রেই নোটিস ঝোলাতে হয় - সরবরাহ নেই, তাই টিকা দান বন্ধ আছে ও কিছুদিন থাকবে। যাঁরা টিকার প্রথম ডোজ নিয়েছেন, তাঁদের অনেকেরই দ্বিতীয় ডোজ নেওয়াটা প্রশ্নের মুখে পড়ে।

চারটে রাজ্য ও একটা কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে নির্বাচনের মরশুমে কেন্দ্র ১৯ এপ্রিল টিকা নীতিতে পরিবর্তনের কথা ঘোষণা করে। এতদিন চালানো শুধুই ডাক্তার-নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, ফ্রন্টলাইন ওয়ার্কার্স ও ৪৫ বছরের বেশি বয়সীদের টিকাদান নীতি থেকে সরে এসে কেন্দ্র ঘোষণা করল, ১ মে থেকে টিকা সব প্রাপ্তবয়স্কই পাবে - অর্থাৎ, ১৮ থেকে ৪৫ বছর বয়সীদেরও টিকা দানের আওতায় আনা হল। তবে এদের টিকাদানের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করে সেই দায়িত্ব কেন্দ্র ঠেলে দিল রাজ্যগুলোর ঘাড়ে। সমস্ত প্রাপ্ত বয়স্ক টিকা কর্মসূচীর আওতায় আসায় টিকার চাহিদাও তরতর করে বেড়ে চলল এবং এর সাথেই জোরালো হয়ে উঠল নিখরচায় গণটিকাকরণের দাবি।

টিকার দাম নির্ধারণ নিয়ে সংশ্লিষ্ট কোম্পানি দুটোকে (সিরাম ইনস্টিটিউট, যাদের টিকা কোভিশিল্ড এবং ভারত বায়োটেক, যাদের টিকা কোভ্যাক্সিন) বিপুল মুনাফাবাজি করতে দেওয়ার অভিযোগ উঠল মোদী সরকারের বিরুদ্ধে। কেন্দ্র টিকা প্রস্তুতকারক কোম্পানি দুটোর কাছ থেকে প্রতি ডোজ টিকা কেনে ১৫০ টাকা দরে। টিকা নীতিতে পরিবর্তনের সাথেই কেন্দ্র টিকা প্রস্তুতকারক সংস্থা দুটোকে স্বেচ্ছাচারীভাবে টিকার দাম নির্ধারণ করতে দিল। সিরাম ইনস্টিটিউট জানাল, যে টিকা তারা কেন্দ্রীয় সরকারকে ১৫০ টাকায় বিক্রি করছে, রাজ্য সরকারকে তা কিনতে হবে ৪০০ টাকায় ও বেসরকারী হাসপাতালকে কিনতে হবে ৬০০ টাকায়। আর ভারত বায়োটেক রাজ্য সরকার ও বেসরকারী হাসপাতালগুলোর জন্য টিকার দাম নির্ধারণ করল যথাক্রমে ৬০০ ও ১,২০০ টাকা। তাদের বিরুদ্ধে মুনাফাবাজির অভিযোগ ওঠায় দুই সংস্থাই রাজ্য সরকারগুলোকে বিক্রির দাম কমানোর কথা ঘোষণা করে জানিয়েছে, সিরাম ইনস্টিটিউট রাজ্য সরকারকে তাদের টিকা বিক্রি করবে প্রতি ডোজ ৩০০ টাকা ও ভারত বায়োটেক বিক্রি করবে প্রতি ডোজ ৪০০ টাকায়। বেসরকারী হাসপাতালগুলোকে বিক্রির দাম অপরিবর্তিতই থাকবে।

কথায় বলে, সংকট অনেকের কাছেই মওকা হয়ে ওঠে। ভারতে লাগামছাড়া কোভিড সংক্রমণের পরিস্থিতিতে টিকার চাহিদা প্রবল আকার নেওয়ায় দুই টিকা প্রস্তুতকারক সংস্থাই এই পরিস্থিতিতে মুনাফার বিরাট সুযোগ দেখছে। তারা যখন কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রতি ডোজ টিকা ১৫০ টাকায় বিক্রি করে, তখন তারা নিজেদের ক্ষতি করে বিক্রি করে না, ঐ দামে তাদের লাভও থাকে। উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কেন্দ্র সরকার সিরাম ইনস্টিটিউটকে যে ৩,০০০ কোটি টাকা এবং ভারত বায়োটেককে ১,৫০০ কোটি টাকা দিয়েছে, সেই বিষয়টাকেও হিসেবের মধ্যে নিতে হবে। অতএব, রাজ্য সরকারগুলোকে এবং বেসরকারী হাসপাতালগুলোকে কেন্দ্রীয় সরকারের দামের দ্বিগুণ থেকে আটগুণ দামে বিক্রির সিদ্ধান্ত তাদের বিপুল মুনাফাবাজিকেই দেখিয়ে দেয়। আর গোটা ব্যাপারটায় মোদী সরকারের নীরবতা তাদের কোম্পানিদ্বয়ের পৃষ্ঠপোষক রূপেই প্রতিপন্ন করছে।

কিন্তু ভারতবাসীকে কেন এই বিপর্যয়ের মধ্যে পড়তে হল? এটা কি অনিবার্যই ছিল? ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা ভাইরাসের নিজেকে রূপান্তরিত করা, সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের আসন্নতার কথা বলে আসছিলেন। এই সতর্কবার্তাকে উপেক্ষা তো করাই হল, বিপরীতে প্রধানমন্ত্রী সহ বিজেপি নেতারা এমন কিছু কর্মসূচীতে নিজেদের এবং জনগণকে সমাবেশিত করলেন যা কোভিড সংক্রমণকে বিস্তৃতভাবে ছড়াতে যথেষ্ট অবদান রাখল।

পশ্চিম বাংলায় নির্বাচনকে প্রলম্বিত করা হল আট দফায় (নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ সহ বিজেপি নেতৃবৃন্দের প্রচারে সুবিধা করে দিতেই এমন নির্ঘন্ট নির্ধারিত হয়েছিল বলে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে যাকে একেবারে ভিত্তিহীন বলা যাবে না)। সব বড় দলই বড়-বড় জনসমাবেশ ঘটিয়ে কোভিড সংক্রমণের পালে হাওয়া দিল। এছাড়া, নির্দিষ্ট সময়কালের এক বছর আগে হরিদ্বারে কুম্ভমেলা অনুষ্ঠানের গেরুয়া ক্যাডারদের দাবিতে সম্মতি দিয়ে নরেন্দ্র মোদী লক্ষ-লক্ষ মানুষের সমাবেশকে অনিবার্য করে তুলে ব্যাপক হারে কোভিড সংক্রমণের পথ প্রশস্ত করে দিলেন।

আজ মোদীকে কেউ যখন ‘সুপার স্প্রেডার’ বলছেন তাকে একেবারে অমূলক বলা যাবে না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী কি তাঁর দায় স্বীকার করবেন? আসুন, আমরা একেবারে ঘোড়ার মুখের কথা শুনি। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের স্বামী পি প্রভাকর বলছেন, “প্রধানমন্ত্রী তাঁর জনপ্রিয়তা, রাজনৈতিক পুঁজি, বাকপটুতা দিয়ে তাঁর ক্ষমতাকে ও সরকারের হৃদয়হীন আচরণকে আড়াল করছেন।” দিল্লীর জনৈক আইনজীবীর আত্মীয়র মৃত্যুতে উদ্বিগ্ন হয়ে দিল্লী হাইকোর্টের বিপিন সাঙ্ঘি ও রেখা পল্লির বেঞ্চ বলে – “সমস্যা হল এখানে না আছে ডাক্তার, না আছে নার্স, না আছে ওষুধ, না আছে অক্সিজেন। এটা সম্পূর্ণ রাষ্ট্রের ব্যর্থতা। পরিস্থিতি ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছে।”

কিন্তু এই ব্যর্থতাকেই কি আমরা আমাদের নিয়তি বলে মেনে নেব? রাষ্ট্রটাকে পাল্টানোই কি আমাদের অভীষ্ট হবে না?

Vaccination

 

দেশের পরিস্থিতির দাবি - সেন্ট্রাল ভিস্টা নয়, চাই গণটিকাকরণ।

ভারতে আজ পর্যন্ত যতজন প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসেছেন, নরেন্দ্র মোদী তাদের মধ্যে সবচেয়ে অসংবেদী রূপে প্রতীয়মান হচ্ছেন। বারবারই তাঁকে এমন সব কর্মসূচী হাতে নিতে দেখা গেছে যেগুলিতে নাগরিকের কল্যাণের চেয়ে তাঁর সংকীর্ণ অভিপ্রায়ই প্রকট হয়েছে। আজ সারা দেশ যখন ভয়াবহ অতিমারীর কবলে, সুপ্রিম কোর্টও যখন পরিস্থিতিকে জাতীয় জরুরি অবস্থা বলে অভিহিত করছে, তখন বিভিন্ন মহলের সমালোচনাকে উপেক্ষা করে নরেন্দ্র মোদী সেন্ট্রাল ভিস্টা প্রকল্পকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় থাকছেন। দেশের জাতীয় রাজধানী আজ অভূতপূর্ব মাত্রার স্বাস্থ্য সঙ্কটে নিমজ্জিত, সমস্ত হাসপাতালে শয্যা-অক্সিজেন-জীবনদায়ী ওষুধের হাহাকার, বিনা চিকিৎসায় রোগীদের মারা যাওয়া সেখানে এক সাধারণ ঘটনা, শ্মশানগুলোতে গণচিতা সদাজ্বলন্ত। এই পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে সার্বিক নজর না দিয়ে বিশালাকায় এই নির্মাণযজ্ঞের ওপর অগ্ৰাধিকার প্রদান নাগরিকদের প্রতি কোন দায়িত্ববোধের পরিচয় বহন করে?

সেন্ট্রাল ভিস্টা হল জাতীয় রাজধানী নয়া দিল্লীর রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে ইণ্ডিয়া গেট পর্যন্ত বিস্তৃত সাড়ে তিন কিলোমিটার দীর্ঘ রাজপথ। এরই দু’পাশের পরিবেশকে ঢেলে সাজানো, অনেক ভবন ভেঙ্গে নতুন করে গড়ে তোলা, এক নতুন সংসদ ভবন নির্মাণ, বিভিন্ন মন্ত্রকের অফিস নির্মাণ এবং প্রধানমন্ত্রীর নতুন বিলাসবহুল বাসভবন নির্মাণের পরিকল্পনাই হল সেন্ট্রাল ভিস্টা প্রকল্প। এই প্রকল্পের আনুমানিক খরচ ধরা হয়েছে ২০,০০০ কোটি টাকা। বিশেষজ্ঞদের যদিও অনুমান, শেষমেষ খরচ হবে আরও অনেক বেশি। বর্তমান পরিস্থিতিকে বিবেচনায় রাখলে এই বিপুল ব্যয়কে কি ন্যায়সঙ্গত বলা চলে? অবহেলিত স্বাস্থ্যক্ষেত্রের বিভিন্ন প্রয়োজন মেটাতে, নাগরিকদের চিকিৎসা পরিষেবা লাভকে আর একটু অনায়াস করার লক্ষ্যে এই অর্থ ব্যয়িত হলে রাষ্ট্রের মানবতাবাদী মুখ হয়ত একটু উজ্জ্বল হত।

সম্প্রতি ব্রিটেনের দ্য মেইল সংবাদপত্রে সেন্ট্রাল ভিস্টা প্রকল্প নিয়ে একটা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। ঐ নিবন্ধে বলা হয়েছে, “নরেন্দ্র মোদীর অহমিকার কলঙ্কজনক স্মৃতিসৌধ: লক্ষ-লক্ষ মানুষ যখন অতিমারীতে আক্রান্ত, ভারতের আত্মম্ভরী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তখন এমন মূল্যে এক সুবিশাল প্রকল্প নির্মাণ করছেন যে অর্থ দিয়ে ৪০টা হাসপাতাল তৈরি করা যেত। এখন তাঁর দেশ প্রতিবাদে নেমেছে।” সেন্ট্রাল ভিস্টা প্রকল্পে ব্যয়কে অপচয় রূপে গণ্য করে ঐ নিবন্ধে আরও বলা হয়েছে, “তাঁর চারপাশে মৃত্যু এবং নৈরাশ্য বিরাজ করলেও এই বেশরম বক্তৃতাবাজ … এই বিষয়ে অনড় রয়েছেন যে নতুন ভবন নির্মাণের অভিযান, বিদ্রুপ করে যেটাকে ‘মোদীর স্বপ্ন’ বলে অভিহিত করা হচ্ছে, দ্রুতগতিতে চলতে থাকবে।” সেন্ট্রাল ভিস্টা প্রকল্পের অবিমৃশ্যকারিতা এইভাবে শুধু দেশে নয়, বিদেশেও প্রবলভাবে সমালোচিত হচ্ছে।

ওপরে আমরা এই অভিমত ব্যক্ত হতে দেখলাম যে, সেন্ট্রাল ভিস্টা প্রকল্পে ব্যয়িত অর্থ হাসপাতাল সহ স্বাস্থ্যক্ষেত্রের পরিকাঠামো নির্মাণে ব্যয়িত হলেই তা ন্যায্য, নগরিক স্বার্থের অনুকূল বলে পরিগণিত হত। এই অভিমতও আবার জোরালো হয়ে সামনে আসছে যে, সেন্ট্রাল ভিস্টা প্রকল্পে নির্ধারিত অর্থে ১৮ থেকে ৪৫ বছর বয়সীদের ৮০ শতাংশের বিনামূল্যে টিকা দানের ব্যবস্থা করা যায়। উল্লেখ্য, কেন্দ্র সরকার প্রথমে ডাক্তার-নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, ফ্রন্টলাইন কর্মী ও ৪৫ বছর ঊর্ধ্বদের বিনামূল্যে কোভিড টিকা দেওয়ার কর্মসূচী নিয়েছিল। পরে টিকানীতিতে পরিবর্তন এনে তারা ঘোষণা করে যে, সমস্ত প্রাপ্ত বয়স্কই, অর্থাৎ, ১৮ থেকে ৪৫ বছর বয়স্করাও কোভিড টিকা নিতে পারবে। কেন্দ্র এই নীতি ঘোষণা করলেও এই নতুন বয়স্ক গোষ্ঠীর, ১৮ থেকে ৪৫ বছর বয়সীদের টিকাদানের দায় তারা নিজেদের ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলে রাজ্যগুলোর ঘাড়ে ঠেলে দেয়। ফলে, টিকা প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে টিকা কিনে এদের টিকাদানের ব্যবস্থা রাজ্যগুলোকেই করতে হবে। এই নীতির বিরোধিতা করে দেশের সর্বত্র এখন দাবি উঠছে - কেন্দ্রীয় সরকারকে নিখরচায় সর্বজনীন টিকাকরণের নীতি গ্ৰহণ করতে হবে। এটাই হবে কোভিডের প্রকোপ প্রশমণের লক্ষ্যে যথার্থ নীতি, এটাই হবে দেশের নাগরিকদের প্রতি দায়িত্বশীলতার যথাযোগ্য পরিচয়। সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ চলার মাঝে বিশেষজ্ঞরা আবার শোনাচ্ছেন আরও এক আশঙ্কার কথা - এ বছরেরই শীতে হানা দিতে পারে কোভিড সংক্রমণের তৃতীয় ঢেউ। বেশি সংখ্যক মানুষকে টিকা দিতে পারলে সেই তৃতীয় ঢেউয়ের মোকাবিলায় অনেকটা পথ এগিয়ে থাকা যাবে। অতএব, করদাতাদের দেওয়া অর্থের প্রতি সুবিচার করতে হলে সেন্ট্রাল ভিস্টা প্রকল্পের জন্য নির্ধারিত অর্থকে গণটিকাকরণ কর্মসূচীতে ব্যয়িত করাই বিধেয়।

কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর দম্ভ যেমন সীমাহীন, আবার জনগণের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে এমন কর্মকাণ্ডেও তিনি অবলীলায় মেতে ওঠেন। নোটবন্দি, অসংখ্য পরিযায়ী শ্রমিক এবং প্রান্তিক জনগণের চরম দুরবস্থায় পড়ার কথা বিবেচনা না করে দীর্ঘ পর্যায়ের কঠোর লকডাউন নামানো, কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের মাঝে হরিদ্বারে কুম্ভমেলায় লক্ষ লক্ষ জনসমাবেশে সম্মতি দেওয়া, কোভিড সংক্রমণের সম্ভাবনাকে উপেক্ষা করে নির্বাচন কমিশনের বকলমে পশ্চিম বাংলায় নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে অস্বাভাবিক সময়কাল ধরে প্রলম্বিত করা - এই সমস্ত কিছুই সাধারণ জনগণের কাছে সর্বনাশা হয়ে দেখা দিয়েছে। সেন্ট্রাল ভিস্টা প্রকল্পের কাজকে অব্যাহত রাখতে এবং দ্রুতগতিতে চালিয়ে নিয়ে যেতে এই প্রকল্পকে নরেন্দ্র মোদী ‘অত্যাবশ্যক পরিষেবা’র তকমা দিয়েছেন। করোনা পরিস্থিতির ভয়াভয়তার পরিপ্রেক্ষিতে দিল্লীতে এখন লকডাউন চলছে, আর তারমধ্যে ভিস্টা প্রকল্পের কাজের জন্য ১৮০টা গাড়ির অবাধ চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়েছে, তিন শিফটে প্রকল্পের কাজ চলছে। নতুন সংসদ ভবন নির্মাণের কাজ নভেম্বরের মধ্যে শেষ করার ফরমান দেওয়া হয়েছে। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তিতে মোদী জাতিকে উপহার দিতে চান অত্যাধুনিক সংসদ ভবন এবং নয়া দিল্লীর সৌন্দর্যায়ন। এবং অনেকেই যেমন বলছেন, এরমধ্যে দিয়ে ইতিহাসে নাম খোদাই করাও তাঁর অভিলাষ। কিন্তু ইতিহাস কোনটাকে মনে রাখবে - নরেন্দ্র মোদীর বানানো সেন্ট্রাল ভিস্টার নির্মাণকে, না কি স্বাস্থ্যক্ষেত্রের অভূতপূর্ব মাত্রার সঙ্কটে সরকারের দেখানো হৃদয়হীনতাকে? চারদিকে ওঠা হাহাকারে আমল না দিয়ে কোভিডে মৃত হাজার-হাজার মানুষের লাশের ওপর দিয়েই মোদীর সাধের নির্মাণ যজ্ঞের সমাধা হয়েছে, ইতিহাসে বড়-বড় কালো অক্ষরে তার উল্লেখকে কিছুতেই মুছে দেওয়া যাবে না।

– জয়দীপ মিত্র 

খণ্ড-28
সংখ্যা-17