ভ্যাকসিনের বন্দোবস্ত করতে ও কোভিড থেকে দেশবাসীকে বাঁচাতে মোদী সরকার অক্ষম
government is unable to arrange vaccines

স্বাস্থ্য গণদ্রব্য হিসেবে পরিগণিত হওয়া উচিৎ হলেও, কালানুক্রমিকভাবে স্বাস্থ্যের বাণিজ্যিকিকরণ করা হয়েছে। পরিষেবার বাণজ্যিকিকরণ করা হলে তা নিয়ে ফাটকা হবে, ‘কালোবাজারি’ হবে। অবশ্য কালোবাজারি, মুনাফাবাজি, ফাটকা এই সমস্ত বিষয়গুলিতো মুক্তবাজারের অর্থনীতিতে অপরাধ থাকে না। ফলে অবাধ অর্থনীতিকে সার্বিক মেনে নিলে গণদ্রব্য ব্যতীত অন্য সকল দ্রব্যই অবাধ অর্থনীতির নিয়মে চলবে, অর্থাৎ সেগুলির দাম বাজার নির্ধারিতই হবে। যেহেতু স্বাস্থ্যের বাণিজ্যকিকরণ হয়েছে তাই হাসপাতালের শয্যা, চিকিৎসা, অক্সিজেন, ওষুধ, আইসিইউ প্রভৃতির প্রাপ্যতা ও মূল্য বাজারের নিয়ম মেনে হবে তাতে কেউ চিকিৎসা পাক বা না পাক। তেমনটাই ভারতীয় জনতা পার্টির দৃষ্টিভঙ্গি। এই অবস্থান থেকেই কোভিড-১৯ প্রতিষেধক টিকাকে দেখছে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার। তা যদি না হয় তাহলে কোন ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় সরকার কোভিড১৯’র প্রতিষেধক সকলের কাছে বিনামূল্যে পৌঁছে দেবার পরিবর্তে অধিকাংশকেই অর্থের বিনিময়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত করল?

বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশগুলি পর্যন্ত কোভিড১৯’র প্রতিষেধক তাদের দেশের সমস্ত অধিবাসীদের বিনামূল্যে দেওয়ার  ব্যবস্থা করেছে। পশ্চিমী দুনিয়ার দেশগুলি মায় মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত প্রতিষেধককে গণদ্রব্য হিসেবে ধরেছে কারণ যদি বিনামূল্যে সকলকে টিকা দেওয়াই সংক্রামক রোগ থেকে মৃত্যু কমানোর সর্বোত্তম উপায়। এমনটা নয় যে ওইসব দেশগুলি সমাজতান্ত্রিক বা তাদের মাথাপিছু আয় এতটাই কম যে দেশের অধিবাসীরা টিকা কিনতে পারবে না, তবুও সার্বজনীন টিকাকরণের জন্য ওই সমস্ত দেশ বিনামূল্যেই টিকা দেওয়ার রাস্তা বেছে নিয়েছে। অপরদিকে আমাদের দেশের কেন্দ্রীয় সরকার প্রথমে সরকারী হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বিনামূল্যে টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা ৪৫ বছরের ঊর্ধ্বের অধিবাসীদের জন্য, এবং স্বাস্থ্যকর্মী, চিকিৎসক সমেত বিভিন্ন কিছু গোষ্ঠির জন্য করলেও, পাশাপাশি বেসরকারী হাসাপাতালগুলিতে অর্থের বিনিময়ে টিকা গ্রহণের উপায়ও চালু রেখেছিল। সেক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার সিরাম ইনস্টিটিউট থেকে কোভিশিল্ড ও ভারত বায়োটেক থেকে কোভ্যাক্সিন কিনে তা রাজ্য সরকারগুলিকে বিনামূল্যে ও বেসরকারী হাসপাতালগুলিকে প্রতি ডোজ ১৫০ টাকা মূল্যে দিচ্ছিল। পরবর্তীতে ১৮ থেকে ৪৫ বছরের জনগোষ্ঠির ক্ষেত্রে টিকা চালু করার সময়ে কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য সরকারগুলিকে বিনামূল্যে টিকা দিতে অস্বীকার করে ও তাদের সিরাম ইনস্টিটিউট ও ভারত বায়োটেক থেকে তা সংগ্রহ করতে বলে।

ফলে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে টিকা দেওয়ার দায়িত্ব থাকল কেবল ৪৫ ঊর্ধ্ব অধিবাসীদের, যার সংখ্যা সামগ্রিকে প্রায় ৩২ কোটি। কেন্দ্রীয় সরকারের বক্তব্য অনুযায়ী সরকার সিরাম ইনস্টিটিউট বা ভারত বায়োটেকের কাছ থেকে টিকা প্রতি ডোজ ১৫০ টাকা মূল্যে কিনবে। ফলে টাকার অঙ্কে একটি ডোজের দায়ের পরিমাণ ৪,৮০০ কোটি টাকার মতো, দুটি ডোজের দায় দাঁড়াবে ৯,৬০০ কোটি টাকা। যদিও সিরাম ইনস্টিটিউটের বক্তব্য অনুসারে তারা কেন্দ্রীয় সরকারকে কেবল প্রথম ১০ কোটি ডোজ ১৫০ টাকায় দেবে বলেছে ও বাকি ডোজ অধিক দামে সরকারকে নিতে হবে। সিরাম ইনস্টিটিউট প্রতি ডোজের দাম ধার্য করেছে রাজ্য সরকারের জন্য ৩০০ টাকা ও বেসরকারী হাসপাতালের জন্য ৬০০ টাকা; ভারত বায়োটেকের দাম রাজ্য সরকারের জন্য ৬০০ টাকা ও বেসরকারী হাসপাতালের জন্য ১২০০ টাকা প্রতি ডোজ। ওদিকে ১৮ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে থাকা অধিবাসীদের জনসংখ্যা প্রায় ৬০ কোটি। যদি রাজ্য সরকারগুলি বিনামূল্যে টিকা দিতে চায় তাহলে তাদের খরচা পড়তে পারে ৩৬ হাজার কোটি টাকা থেকে ৭২ হাজার কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় সরকার টিকাকরণের সিংহভাগের দায় রাজ্য সরকারগুলির ঘাড়ে ফেলে দিচ্ছে।

যেহেতু কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী ২৪ এপ্রিল বলেছেন যে, কেন্দ্রীয় সরকার সমস্ত টিকাই ১৫০ টাকা প্রতি ডোজ হিসেবে পাবে কারণ তারা অগ্রিম অর্ডার দিয়েছেন ও তার মাধ্যমে টিকা সংক্রান্ত ঝুকিও বহন করেছেন, তাহলে যদি সরকার সমস্ত টিকাকরণের দায় নিত, তাহলে ১৮ ঊর্ধ্ব জনসাধরাণের জন্য লাগত ২৭ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। টিকাকরণের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার ২০২১-২২’র বাজেটে ৩৫ হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ রেখেছে। ফলে বাজেটের টাকাতেই টিকাকরণ হয়ে যেত। এমনকি সার্বজনীন টিকাকরণের জন্য লাগত ৪২ হাজার কোটি টাকার কম। ফলে কেন্দ্রীয় সরকার কেন সকলকে বিনামূল্যে টিকা দেবে না তার কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা নেই।

কেন্দ্রীয় সরকারের হঠাৎ টিকাকরণের ক্ষেত্রে পিছু হটা রাজ্যগুলিকে দুদিক দিয়ে ফ্যাসাদে ফেলেছে। ভ্যাকসিন সংক্রান্ত সমস্ত সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় সরকার নিয়েছে। কোন কোম্পানি ভ্যাকসিন বানাবে, কীভাবে তার কাছে অর্ডার দেওয়া হবে, কত ভ্যাকসিন কোন কোন দেশে রফতানি করা হবে এসমস্ত সিদ্ধান্তই কেন্দ্রীয় সরকার নিয়েছে। সাধারণত ভ্যাকসিন প্রস্তুতের ক্ষেত্রে বহু দেশে আগেই অর্ডার দেয় ও অগ্রিম দিয়ে থাকে। যদি ভ্যাকসিনটি সাফল্য না পায় তাহলে ঝুকি থাকে। অন্য দিকে তেমন ঝুকি নেওয়া হয় বলে প্রস্তুতকারক সংস্থা কম মূল্যে দেওয়ার চুক্তি করে। এই সমস্ত চুক্তিই এতাবৎ কাল কেন্দ্রীয় সরকার করেছে, যারফলে প্রতি ডোজ ১৫০ টাকা দরে সরবরাহ করছে প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলি। রাজ্য সরকারের তেমন চুক্তি করার কোন অধিকারই ছিল না। ফলে এখন তাদের দ্বিগুণ বা চারগুণ মূল্যে টিকা কিনতে হবে। যদি কেন্দ্রীয় সরকার আগেই রাজ্য সরকারগুলিকে এব্যাপারে জানাত তাহলে সরকারগুলি প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলির সঙ্গে চুক্তি করতে পারত।

প্রতিষেধকের বিষয়ে সব থেকে খারাপ দিক হল প্রতিষেধকের যোগান না থাকা। রাজ্য সরকারগুলিকে যেকোনো দেশ বা সংস্থা থেকে ভ্যাকসিন যোগাড় করার অনুমতির কথা বলা হলেও, তা অর্থহীন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বের অন্য ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলি কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদন বা মধ্যস্থতা ছাড়া ভ্যাকসিন যোগান দিতে চাইছে না। অপরদিকে আমেরিকার সংস্থাগুলি এই মুহূর্তে ভ্যাকসিনে যোগান দিতে অপারগ কারণ তাদের অর্ডারবই পরিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। সিরাম বা ভারত বায়োটেকের উৎপাদন ক্ষমতাও প্রয়োজনমত যোগান দিতে পারছে না। এপর্যন্ত মোট জনসংখ্যার মাত্র ১০% প্রথম ডোজ নিতে পেরেছে ও ৩% দুটো ডোজই নিতে পেরেছে। যদি সমস্ত অধিবাসীদের ভ্যাকসিন দিতে হয় তাহলে প্রায় ২৮০ কোটি ডোজ লাগবে। যদি এক বছরের মধ্যে তা দিতে হয় তাহলে হিসেব অনুযায়ী প্রতি মাসে ২৩ কোটি ভ্যাকসিন ডোজের যোগান চাই। এমনকি এক বছরের মধ্যে  কেবল ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে সকলকে দিতে গেলেও মাসে সাড়ে পনেরো কোটি ডোজের প্রয়োজন। এই মুহূর্তে সিরাম ও ভারত বায়োটেকের যৌথ উৎপাদন ক্ষমতা মাসে সাড়ে আট কোটি ডোজ।

ভ্যাকসিন নিয়ে এই সংকট তৈরি করেছে মোদী সরকারের অদূরদর্শিতা ও আত্মতুষ্টি। মোদীজি ভেবেছিলেন কোভিড চলে গিয়েছে তাই ভ্যাকসিন না হলেও চলবে। ঢিমেতালে টিকাকরণ চালিয়ে গিয়ে কোভিডকে পরাস্ত করার ক্রেডিটও নেবেন, বাজটের বরাদ্দ অর্থও বাঁচবে। তাই এপ্রিল মাসের ১৯ তারিখ পর্যন্ত রাজ্যগুলিকে সরাসরি প্রতিষেধক কিনতে বা চুক্তি করতে দেননি। দ্বিতীয় ঢেউএ দেশজোড়া চিতার আগুন দেখে নিজেদের এলেম বুঝতে পেরেছে সরকার। ফলে সমস্ত দায় চাপাতে রাজ্য সরকারগুলিকে শিখন্ডি খাড়া করাচ্ছে। মোদী সরকার প্রমাণ করে দিয়েছে ভ্যাকসিনের বন্দোবস্ত করতে ও কোভিড থেকে দেশবাসীকে বাঁচাতে তারা অক্ষম।

-- অমিত দাশগুপ্ত 

খণ্ড-28
সংখ্যা-19