হকের পাওনা দিতেই হবে
must be paid

একটা বাজেট বছর গড়িয়ে গেল তবু কোভিড ছাড়ে না। প্রধানমন্ত্রী বহু বড় বড় কথা বলেছিলেন, নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কোভিডের মোকাবিলায় ভারত হবে 'আত্মনির্ভর'! রুখে দেওয়া দেখিয়ে জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন নেবে! এরকম অনেক কিছু শুনিয়েছিলেন! আর আজ? কোভিডের প্রকোপ সবচেয়ে মারণঘাতী প্রতিপন্ন হয়েছে দুনিয়ায় যে প্রথম তিনটি দেশে, সেখানে ভারত ঘুরেফিরে রয়ে যাচ্ছে বরাবর। কোভিডের এই সংক্রমণে একদিকে জীবননাশ থামছে না, অন্যদিকে আরও অনেক দিক থেকে জর্জরিত হচ্ছে ব্যাপকতম জনজীবন। এ যন্ত্রণা কর্মহীনতার ভীড়ে পিষ্ট হওয়ার, নতুন করে কাজ উধাও হয়ে যাওয়ার; খাদ্য, বস্ত্র, পুষ্টি,স্বাস্থ্য, শিক্ষার বঞ্চনা-প্রতারণার শিকার হয়ে চলার। এই দুঃসহ পরিস্থিতি জ্বলন্ত কিছু দাবি রাখে আশু উপশম পাওয়ার। দাবিগুচ্ছ উঠেছে রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারের উভয়পক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। প্রধান দায়-দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের, যেহেতু রাজ্যওয়ারি সংগৃহীত রাজস্বের সিংহভাগের দখল নেয় কেন্দ্র। এই অবস্থায় খতিয়ে দেখা দরকার, কেন্দ্রীয় সরকার কি করছে, রাজ্য সরকার কি করছে? পরিস্থিতিতে এখন কোভিড ঝড়, লকডাউনের জেরে ঘনিয়ে আসা ভঙ্গুর অর্থব্যবস্থা, তার উপর ‘ইয়াসে’র তোড়ে জীবনযাপনের খোরাক যোগানোর সংকট আরও বাড়বে। লক্ষ লক্ষ মানুষ এখন ভিটে মাটি ছাড়া, সহায় সম্বলহীন। কেন্দ্র গত বছরের আমফান ত্রাণের অর্থ বরাদ্দ করার ক্ষেত্রে যথারীতি তীব্র বৈষম্য ও বঞ্চনা করেছিল। রাজ্যের তরফে যে পরিমাণ অর্থ ও দ্রব্যের দাবি করা হয়েছিল, তার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ দিয়েছিল মোদীর কেন্দ্র। আমফান ত্রাণের কিছু কিছু আত্মসাৎ করার ঘটনা ঘটেছিল সত্য, তবে মানুষের বিক্ষোভে তার অনেকটা ফেরত পাওয়া গিয়েছিল, সেসব ফেরত দেওয়াতে মুখ্যমন্ত্রীও চাপ দিয়েছিলেন। বিজেপি সদ্য সম্পন্ন হওয়া নির্বাচনে আমফান দুর্নীতি নিয়ে একপেশে রাজনীতি করেছে, জবাব দিতে পারেনি দুর্নীতির ছুতোয় রাজ্যের মানুষের ত্রাণের পাওনা অর্থ কেন্দ্র দেবে না কেন? শুধু কি তাই! রাজ্যের শাসকদের একচোখা নীতির কারণে কেন্দ্রের ঘোষিত কৃষকদের ক্ষতিপূরণ প্রকল্পের টাকা মার যেতে বসেছিল। আবার সেই মানুষের চাপেই রাজ্য সরকার বাধ্য হয় অযৌক্তিক অবস্থান বদল করতে, অগত্যা কৃষকদের নামের তালিকা পাঠানো শুরু করে। আর যে বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার নতুন “তিন আইন'” এনেছে কৃষকদের সর্বস্বান্ত করতে, বিপরীতে কর্পোরেট পুঁজির থাবায় কৃষিকে তুলে দিতে, সেই বিজেপি পশ্চিমবাংলার কৃষকদের জন্য কতই না ‘দয়ার সাগর’ সাজার প্রচার চালিয়েছিল! ‘প্রধানমন্ত্রী কৃষক সম্মান নিধি’ প্রকল্পের আর্থিক সাহায্যের ডালি সাজিয়ে। তারপর যেই নির্বাচনে বিজেপি হেরে গেল এখন কেন্দ্র এরাজ্যের কৃষকদের জন্য মাত্র এককালীন দু'হাজার টাকা করে দিয়ে হাত তুলে নিচ্ছে! অথচ প্রতিশ্রুতি ছিল আরও বেশি। বিগত বছরটির জন্য ছয় হাজার করে তিন কিস্তিতে দেওয়া হবে কৃষক পিছু মোট আঠারো হাজার টাকা। সংকট অনুপাতে এটুকু আর্থিক খয়রাতি এমন কিছু নয়। তারপর যদি তার শুধু মুড়োটা দিয়ে বাকী সব না দেওয়া হয় সেটা কাটা গায়ে নুনের ছিটে দেওয়ার মতই। এতো চাষি সমাজের 'না হলেই নয়' অবস্থা সামাল দিতে যৎসামান্য অনুদান। তাও কেন্দ্রের এই প্রকল্প কেবল আবাদী জমির মালিক চাষিদের জন্য, ভাগচাষি-বর্গাচাষিদের জন্য নয়। কিন্তু শেষোক্ত বর্গের চাষিদেরও ঐ ‘সম্মান নিধি’ প্রকল্পের অর্থ পাওয়া উচিত। সেটা না দেওয়া মানা যায় না। বিজেপি বাংলার নির্বাচনী প্রচারে প্রতিশ্রুতি দেয় রেশনে খাদ্যদ্রব্য সরবরাহের পরিমাণ আরও বাড়ানো হবে। যদিও মোদী সরকার দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পরপরই গণবন্টণ ব্যবস্থার কোটা থেকে এক বিশাল জনসংখ্যাকে ছেঁটে দেয়, প্রাপকদের প্রাপ্য পাওয়া জনিত বিভিন্ন ভাগে বর্গভুক্ত করে। নানা বাহানায় এইসব উৎকট কর্তনকাণ্ড সংগঠিত হয়। এসব যে ভাবের ঘরে চুরি করে করা হয়েছিল তা সদ্য কয়েকটি রাজ্যে এক লপ্তে বিধানসভা নির্বাচনের চাপের মুখে পরোক্ষে মানতে হয়েছে। বিশেষ করে বাংলায় নির্বাচনী প্রচারে কেন্দ্রের পরিচালক দলটি গণবন্টণ ব্যবস্থা মারফত পণ্যদ্রব্য সরবরাহের বিষয়ে নতুন কিছু প্রতিশ্রুতি দেয়। তা পুনর্বিবেচনার পরিচয় হিসেবে ধরে নেওয়াই স্বাভাবিক। বিজেপি বলেছিল সুলভে চাল-গম-আটা সহ কেজি প্রতি ত্রিশ টাকায় ডাল, পাঁচ টাকায় চিনি, তিন টাকায় নুন দেওয়া হবে। কিন্তু নির্বাচন চুকে যাওয়ার পরে আর সেসবের নাম করছে না। অভাবী মানুষের হকের পাওনা নিয়ে ভোটের আগে-পরে এরকম ছিনিমিনি করতে দেওয়া যায় না। কেন্দ্রকে তার হিসাব চোকাতেই হবে। হিসাব আরও নেওয়ার আছে। গতবছর লকডাউনের ফাঁস চড়ানোয় ছিন্নমূল হয়ে যায়, বেঘোরে শেষ হয়ে যায় অগণিত পরিযায়ী শ্রমিকের জীবন! কেন্দ্র তাদের খাদ্য ও নগদ অর্থ কিছুই দেয়নি, ঘরে ফেরার পরিবহন খরচ দেয়নি, তাদের তালিকা তৈরি করেনি। বছর চলে গেল কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর শূন্যগর্ভ ঘোষণার। ‘এক বছরের মধ্যে – এক দেশ এক রেশন কার্ড’ – পলিসি কার্যকর করার! এবার আবার লকডাউনের সময়ে সর্বোচ্চ আদালত নির্দেশ দিয়েছে পরিযায়ী শ্রমিকদের বিনামূল্যে রেশন দিতে হবে, তাদের পরিবার-পরিজনদের আহারাদির জন্য গণখাবার শিবির করতে হবে। যুক্তিসঙ্গত বিবেচনা করে তাদেরকে নগদ অর্থও দিতে হবে। বিভিন্ন সংগঠন ও মঞ্চ থেকে দাবি তোলা হয়েছে মাথাপিছু মাসিক ন্যূনতম সাড়ে সাত হাজার টাকা করে দেওয়া হোক। অন্তত যতদিন কর্মসংস্থানের স্বাভাবিক পরিস্থিতি না আসে ততদিন। এই দাবি পরিযায়ী শ্রমিক সহ সমগ্র অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমজীবীদের জন্য।

পশ্চিমবাংলার নব নির্বাচিত সরকার গত একবছর বিনামূল্যে রেশনে খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ করছে। এবার 'দুয়ারে রেশন' দেওয়ার পাইলট প্রকল্প শুরু করেছে। এছাড়া এখানে সরকারী আর্থিক সাহায্যের বিভিন্ন “শ্রী”, “সাথী” ও “বন্ধু” প্রকল্প চালু আছে; মুখ্যমন্ত্রী তিন বর্গের মহিলাদের জন্য তিন ধরণের মাসিক হাত খরচের প্রকল্পের কথা ঘোষণা করেছেন। কথা অনুযায়ী এসব যাতে দুর্নীতি ও বৈষম্য মুক্ত ভাবে চলে তার দায়িত্ব প্রতি পদে পদে রাজ্য সরকারের। অভাবী মেহনতী-পথবাসী ও অন্যান্য অংশের মানুষদের জন্য অতি সুলভে দৈনন্দিন তৈরি খাবারের কেন্দ্র চালু করা দরকার, রেশনে বিনামূল্যে খাদ্যদ্রব্য সরবরাহের পরিমাণ দ্বিগুণ করতে হবে।

এককথায়, আজকের পরিস্থিতি বিচার করে সাধারণ মানুষের হকের পাওনা সব দিতেই হবে।

খণ্ড-28
সংখ্যা-19